নি র্বাচনের ঢাকে কাঠি পড়িলে রাজনীতিকরা প্রয়াগের মেলায় রাজা হর্ষবর্ধন হইয়া উঠেন, ইহা ভারতে অবিসংবাদী সত্য। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমনিতেই উদারহস্ত। পা়ড়ার ক্লাব হইতে মসজিদের ইমাম, তাঁহার বদান্যতা বহুমুখী, শুধু রাজনৈতিক আনুগত্য থাকিলেই যথেষ্ট। তাহার উপর নির্বাচনী ২০১৬ দরজায় কড়া না়ড়িতেছে। তিনি যে দানছত্র খুলিয়া বসিবেন, তাহা প্রত্যাশিতই ছিল। সেই খয়রাতি যে সরকারি টাকাতেই হইবে, তাহাতেও সন্দেহ ছিল না। অতএব, তিনি যখন দুই লক্ষ সরকারি চাকুরির (তাঁহার দেওয়া হিসাব অবশ্য বলিতেছে এক লক্ষ নব্বই হাজার চাকুরি, কিন্তু সংখ্যাতত্ত্বে পাঁচ শতাংশ গোলমাল মাফ করিয়া দেওয়াই দস্তুর) কথা ঘোষণা করিলেন, তখন কেহ বিস্মিত হন নাই। তবে, বিস্মিত হওয়ার কারণ বিলক্ষণ আছে। মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্তটি শুধু জনমোহিনী নহে, তিনি ‘পিছন দিকে আগাইয়া’ চলিয়াছেন। তাঁহার ঘোষিত চাকুরির ৬৩ শতাংশ সরকারের গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি পদের জন্য। এমন চাকুরি, যেখানে যথার্থ কোনও কাজ নাই। প্রযুক্তি আসিয়া সেই পদের কাজ লইয়া গিয়াছে। এখন খাতা লিখিবার প্রয়োজন বিস্তর কমিয়াছে, চিঠি পৌঁছাইয়া দিতেও বেয়ারার প্রয়োজন অনেক কম। কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট সেই কাজের দায়িত্ব লইয়াছে। কাজেই, কনিষ্ঠ করণিক বা বেয়ারাদের আর কাজ নাই। এই কারণেই বামফ্রন্ট ২০০৩-০৪ সাল নাগাদ এই গোত্রের পদে নিয়োগে রাশ টানিয়াছিল, যাহাতে কালক্রমে এই পদগুলি মুছিয়া যায়। সেই কারণেই এতগুলি পদ শূন্য ছিল। আধুনিকীকরণের একটি প্রক্রিয়া চলিতেছিল। অতি মন্থর, কিন্তু নির্দিষ্ট গন্তব্যে তাহার যাত্রা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভোটের পায়ে সেই প্রক্রিয়াটিকে বলি দেওয়ার ব্যবস্থা করিলেন। পশ্চিমবঙ্গ তীব্র গতিতে মান্ধাতা অভিমুখে ছুটিতেছে।
কেহ বলিতেই পারেন, পদগুলি ছিল বলিয়াই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই কাজটি করিতে পারিলেন। পূর্বেই পদগুলি বিলুপ্ত করা উচিত ছিল। সেই ঔচিত্য লহিয়া প্রশ্ন নাই। কিন্তু, বাস্তব বলিবে, সরকার এই ভাবেই চলে। কাগজে-কলমে স্বীকৃত না হইলেও কিছু নীতি থাকে, এবং সেগুলি মানিয়া চলাই দস্তুর। অপ্রয়োজনীয় পদগুলিকে ছাঁটিয়া ফেলিবার এই প্রক্রিয়াটিও তেমনই একটি নীতি ছিল। তাহার ধারাবাহিকতা বজায় রাখিবার দায় ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তিনি সম্ভবত নিজেও জানেন, এই পদগুলি বাহুল্যমাত্র। কিন্তু, অর্থনীতি তাঁহার বিষয় নহে। সরকারের বেতন বাবদ খরচ মাসে সাড়ে সাত শতাংশ বা়ড়ুক, অর্থসংকট তীব্রতর হউক, তিনি ভোটের অঙ্ক কষিবেন। অতএব, সরকারি ব্যয়ে তাঁহার রাজনীতি দীর্ঘজীবী হইল। যাঁহারা এত দিন তাঁহার পতাকা বহিয়াছে, তাঁহাদের একাংশকে তিনি এই বার (অর্থ)শকতি দিলেন।
বিরোধী দলগুলি মুখে কুলুপ আঁটিয়াছে। যে রাজ্যের কপালে বিনিয়োগের ছিঁটেফোঁটাও জোটে না, যেখানে কর্মসংস্থানের নামগন্ধ নাই, সেখানে দুই লক্ষ চাকুরির বিরোধিতা করিয়া ভোটারের মন হারায় কোন আহাম্মক? এই রাজ্যে চাকুরি চাহিলে সরকারই ভরসা। অন্য দিকে, গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি অপেক্ষা গুরুতর কাজে নিয়োগ করা যায়, পশ্চিমবঙ্গে এমন চাকুরিপ্রার্থীর সংখ্যা নিতান্ত কম। যাঁহাদের যোগ্যতা আছে, তাঁহারা আর এই রাজ্যে নাই। যাঁহারা আছেন, তাঁহাদের অধিকাংশেরই নিয়োগ-অযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। কাজেই, তাঁহাদের চাকুরি দিলে এমন পদে দিতে হয়, যেখানে কাজ নাই। থাকিলেও, সেই কাজ করিতে দক্ষতা বা যোগ্যতার প্রয়োজন নাই। পশ্চিমবঙ্গের বেকারসমাজ ও গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি-র চাকুরি, প্রকৃত প্রস্তাবে, মণিকাঞ্চনযোগ। মুখ্যমন্ত্রী নেহাত ভুল করেন নাই।