সংখ্যাতাত্ত্বিক আঁক কষিয়া ঠিক বলিয়া দিতে পারিতেন, গোটা রাজ্যে একটি পরীক্ষার জন্য যদি চুরানব্বইটি শহরের কয়েকশো সেন্টারের উদ্দেশ্যে হাজার কয়েক বস্তাভর্তি প্রশ্নপত্র পাঠাইতে হয়, তাহা হইলে বস্তা মাঝরাস্তায় হাপিশ হইবার সম্ভাবনা ঠিক কত শতাংশ। তাত্ত্বিক না হইয়াও অবশ্য একটি অনুমান সহজেই সম্ভব: শতাংশের অঙ্কটি বেশ উপরের দিকেই হইবে। সুতরাং হুগলির শ্রীরামপুরের দিকে ছুটন্ত বাস হইতে যে টেট পরীক্ষার প্রশ্নসমেত বস্তাসমূহের মধ্যে একটি বস্তা বেমালুম অদৃশ্য হইল, তাহাতে আশ্চর্যের কিছু নাই। স্বাভাবিক প্রত্যাশিত বলিয়াই ইহা মানিয়া লওয়া উচিত। অথচ শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বেজায় আশ্চর্য হইয়া ক্ষুব্ধ ঘোষণা করিলেন, অগস্ট-শেষের পরীক্ষাটি পিছাইয়া অতঃপর অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে হইবে। রাজ্যব্যাপী প্রায় তেইশ লক্ষ পরীক্ষার্থী পঞ্চাশ হাজার আসনের জন্য পরীক্ষায় বসিতেছিলেন। পরীক্ষা শেষ মুহূর্তে পিছানোয় তাঁহাদের ভোগান্তির একশেষ হইল। টেট পরীক্ষা পরিচালনা করে রাজ্য সরকার। তাহাদেরও পরীক্ষার নূতন ব্যবস্থাদির জন্য আর্থিক ক্ষতি ও ভোগান্তি অনেকটাই, ধরিয়া লওয়া যায়। তবে সে সকল প্রশ্নই পার্শ্বীয়। কেন্দ্রীয় প্রশ্ন একটিই। এত কিছু সমস্যা তো এই জন্যই যে, কোনও এক আশ্চর্য ভাবনাদৈন্যের দরুন গোটা রাজ্যের এতগুলি জেলা জুড়িয়া যত স্কুল, সব কয়টির শিক্ষক নির্বাচনের জন্য একটিমাত্র কেন্দ্রীভূত পরীক্ষাব্যবস্থাই চালাইতে চায় আমাদের রাজ্য? অন্য কোনও পথই তাহারা ভাবিতে পারে না। কেন সরকারকেই এই বিপুল ব্যাপক বন্দোবস্তের ভার বহিতে হইবে? স্কুলগুলিকে নিজের নিজের শিক্ষক নির্বাচনের দায়িত্ব দেওয়া যাইবে না কেন? তাহাতে কোন ক্ষতি— শাসক দলের হাত হইতে নিয়ন্ত্রণ ও পুরস্কার বিতরণের ক্ষমতা খানিকটা কমিয়া যাওয়া ছাড়া?
রাজনৈতিক সিদ্ধির কথা মাথায় রাখিয়াই নিশ্চয় কেন্দ্রীভূত পরীক্ষার নীতিটিতে এত উৎসাহ বোধ করিয়াছিল তিন দশকের বাম রাজ। কেন্দ্রীকরণই ক্ষমতার একমুখিতার উৎস, সুতরাং বিদ্যালয়গুলিকে টেট ও এসএসসি এবং কলেজগুলিকে সেট পরীক্ষার আওতায় আনিতে পারিলে সরকারের ক্ষমতা বেশ জাঁকাইয়া প্রকাশ ও প্রচার করা যায়। স্বভাবতই, ক্ষমতায় আসা ইস্তক তৃণমূল কংগ্রেসও চট করিয়া এই শিক্ষানীতির মাহাত্ম্য বুঝিয়াছে। প্রবলতর উৎসাহে পরীক্ষার কেন্দ্রীকরণের আয়োজনে মনোনিবেশ করিয়াছে। ফলে টেট পরীক্ষার প্রয়োজনীয় বয়সসীমা আরও বাড়িয়াছে, প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা কমিয়াছে। পরীক্ষার্থী-সংখ্যা লাফাইয়া বাড়িয়াছে।
‘রাজনৈতিক’ এখন সর্বব্যাপী সর্বত্রবিহারী। তাহাকে পার হইয়া অন্য কোনও সামাজিক অর্থনৈতিক শিক্ষানৈতিক প্রশ্নেরই কোনও অর্থ নাই। কিন্তু যদি তর্কের খাতিরে ‘রাজনৈতিক’-এর কঠোর কব্জার বাহিরে পা রাখিয়া সেই প্রশ্নগুলি তোলা যায়, তবে বলিতে হয় যে, স্কুলগুলিকে নিজের পরীক্ষা লইতে দিলেও শিক্ষার মান লইয়া দুশ্চিন্তার কারণ নাই। শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ করিবার জন্য, সরকারের অর্থ সহায়তা বাড়ানো বা কমানোর সিদ্ধান্তের জন্য পরীক্ষায় স্কুলগুলির ফলাফল ও তাহাদের সামগ্রিক শিক্ষা-পরিবেশের দিকে নজর রাখিলেই চলে। যদি কোনও স্কুল ভাল ফল না করে, নিজের স্বার্থেই সে উপযুক্ততর শিক্ষকের খোঁজ করিবে, নিয়োগ করিবে। মাত্র কয়েক দশক আগেই এ দেশে এবং এই রাজ্যে এই পদ্ধতিতেই বড় শহরে ও ছোট শহরতলিতে স্কুলগুলি চলিত। তাহাতে যে শিক্ষাব্যবস্থা ভাঙিয়া পড়িতেছিল, এমন প্রমাণ দর্শানো যাইবে না। আর, এত রাজসূয় আয়োজন কি রাজ্যের সরকারি বা আধা-সরকারি বিদ্যালয়গুলির প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার গতি সত্যই চমৎকারী করিতে পারিয়াছে?