প্রবন্ধ ১

যে আমাকে পথ বাতলেছিল তার খোঁজে

বিজেপি কংগ্রেসের ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী। আমরা এসে দাঁড়িয়েছি মতাদর্শহীনতার প্রেতভূমিতে। সেখানে কংগ্রেস, বিজেপি, বামপন্থী পার্টিগুলি ও আঞ্চলিক পার্টিগুলি আত্মাহীনতায় আক্রান্ত। মতাদর্শের উদ্ধার ছাড়া অন্য পথ নেই। দেবেশ রায়এই লেখাটার কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করছি বেশ কিছু দিন। পেরে উঠছিলাম না। যা বলব বলে খুঁজছি, সেটা বার বারই পিছলে যাচ্ছিল। একেবারেই হঠাৎ এক কবির কাছে দিশা পেলাম। সে কবিকে আমি চিনি না। তাঁর কবিতা পড়েছি বলেও মনে পড়ল না। কলেজ স্ট্রিট পাড়ার একটা বড় বাংলা বইয়ের দোকানের ভিতরে বইয়ের অলিগলিতে ঘুরছিলাম। মাঝে মাঝে যাই ওখানে— বাংলা লেখার বিষয়ের আধুনিক প্রসারের হাওয়া নিতে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share:

উত্তরাধিকার। মনমোহন সিংহ ও নরেন্দ্র মোদী। দিল্লি, ২০০৮

এই লেখাটার কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করছি বেশ কিছু দিন। পেরে উঠছিলাম না। যা বলব বলে খুঁজছি, সেটা বার বারই পিছলে যাচ্ছিল। একেবারেই হঠাৎ এক কবির কাছে দিশা পেলাম। সে কবিকে আমি চিনি না। তাঁর কবিতা পড়েছি বলেও মনে পড়ল না। কলেজ স্ট্রিট পাড়ার একটা বড় বাংলা বইয়ের দোকানের ভিতরে বইয়ের অলিগলিতে ঘুরছিলাম। মাঝে মাঝে যাই ওখানে— বাংলা লেখার বিষয়ের আধুনিক প্রসারের হাওয়া নিতে।

Advertisement

হঠাৎই এক যুবা, যে বয়সে সকলেই সুদর্শন, সেই ফাঁকফোকর দিয়ে আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন ও আমাকে আরও একটু ভিতরে যাওয়ার ইশারা করলেন। বুঝলাম, আমি যে শুনতে পাই না, এটা উনি জানেন। সেখানে তিনি তাঁর লেখা ও আঁকা কবিতার বইটি আমাকে দিলেন। কবির নাম মলয় ভট্টাচার্য।

সেই কবিতার বইটিই পড়ছিলাম ও আস্বাদ করছিলাম। কবিতার উপকরণগুলি— ছন্দ, অলঙ্কার, শব্দ নিয়ে খেলতে পারেন দেখে আস্বাদগ্রহণ চলছিল। থমকে যেতে হল— সরাই-মালিক বলছে: ‘ক্লান্তিহর ডাব, সুস্বাদু বকের মাংস, সুধা বিনামূল্যে সবই পেতে পারো। শুধু কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। সঠিক উত্তর চাইলে জেনে আসতেই পারো তার কাছে, যে তোমাকে পথ বাত্লেছিল’!

Advertisement

যে দুর্গমতা আমার এই লেখাটায় পৌঁছনোর বাধা ছিল, সেটা সহসা সুগম হয়ে গেল।

ভারতের রাজনীতিতে আমরা কি ঠিক তেমন একটি জায়গায় এসে পড়েছি, যেখানে আমরা পৌঁছইনি? বহু দিনের নির্ভর মধ্যপন্থা পথের পাশে অবশেষ হিসেবে পড়ে আছে। কংগ্রেসের পুনরুত্থানশক্তি নিশ্চয়ই বিস্ময়কর। স্বাধীনতার পর বহু বহু বার কংগ্রেস দলের ভিতরের দ্বন্দ্ব ভারতের রাজনীতিকে দিশা দিয়েছে। রাজাগোপালাচারির মতো নেতা কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গেছেন। কৃপালনী থেকে মোরারজি, এমনকী কংগ্রেসের পার্টিপ্রধান থেকে শুরু করে প্রাদেশিক প্রধানতম নেতারা ইন্দিরা গাঁধীর বিরুদ্ধে সমবেত হয়েছেন। তবু যে কংগ্রেস বার বার তার রাজনৈতিক সংহতি ফিরে পেয়েছে, তার প্রধান কারণ কংগ্রেস সারা ভারতের পক্ষে প্রয়োগযোগ্য রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্মসূচি উত্থাপন ও প্রমাণ করতে পেরেছিল। সেই মধ্যপন্থা খুব স্পষ্ট ছিল: প্রাইভেট ও পাবলিক অর্থনৈতিক নিরপেক্ষতা, জোটনিরপেক্ষতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, কেন্দ্র ও রাজ্যের প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা, প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা।

জরুরি অবস্থায় ইন্দিরা গাঁধীই এই শেষ দুটি নিরপেক্ষতা নষ্ট করেছিলেন। তারই ফলে ভারতের রাজনীতির মধ্যপন্থা চিরকালের জন্য টাল খেয়ে গেল। ’৭৫ না-হলে ’৭৭ হত না।

’৭৭-এ একটা অনুমান, প্রমাণ হয়ে গেল— কংগ্রেসের বিকল্প ব্যবস্থা, অনেক পার্টির মিলিত মঞ্চ। জনতা পার্টি ও জনতা পার্টির সরকার হয়ে দাঁড়াল স্বাধীন দেশ হওয়ার পর থেকে ১৯৫৭-র দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা পর্যন্ত কংগ্রেস যেমন ছিল বহু মতাদর্শের ও কর্মসূচির মিলিত মঞ্চ, তেমনই একটি মঞ্চ। তফাত একটা ছিল বটে। ১৯৪৭ থেকে ’৫৭ কংগ্রেস শাসকদল হিসেবে কর্মসূচির ঐক্য তৈরি করছিল এবং কর্মসূচির সেই ঐক্যের সঙ্গে দেশের বেশির ভাগ মানুষের মতের মিলই রাজাজি থেকে কৃপালনী পর্যন্ত বড় বড় নেতাদের অবান্তর করে দিয়েছিল। জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বের অবিসংবাদিতা ছিল এখানেই। আর, জনতা পার্টি ও সরকার তৈরি হল কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে। তাদের নিজেদের কর্মসূচি ছিল না। তাঁরা বাধ্যত কংগ্রেসের কর্মসূচিই অনুসরণ করলেন, যতটা পারলেন। মধ্যপন্থা হয়ে উঠল যেন এক ললাটলিখন— সরকার পরিচালনার জন্য মতাদর্শ আর প্রয়োজনীয় থাকল না।

রাজনীতি তো মতাদর্শ ছাড়া হয় না। জাতীয় সম্মতির ভিত্তিতে মতাদর্শের রাজনীতি যদি আর অনিবার্য না থাকে, তা হলে আঞ্চলিক বা জাতপাতের ভিত্তিতে আংশিক সম্মতিই মতাদর্শ হয়ে ওঠা স্বাভাবিক। ’৭৭-এর জনতা সরকারের পর থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত এই আঞ্চলিক, জাতপাতভিত্তিক ও বৃত্তিগত ইউনিয়ন-ভিত্তিক স্বার্থের সম্মতি, মতাদর্শের জায়গা দখল করে নিল। মতাদর্শ যেন একটা পাত্র মাত্র। সব কিছুই এঁটে যায়।

মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করার কর্মসূচি নিয়ে ভি পি সিংহ জাতীয় সম্মতি তৈরি করতে পারবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু সম্মতি তো দূরের কথা, তার ফলে জাতীয় অসম্মতি বেশ হিংস্র চেহারা নিল। হিন্দু সমাজ নিজেদের বর্ণের স্বার্থে পরস্পরের উল্টো পথে চললেন। পশ্চিমবঙ্গে জাতপাত বা আঞ্চলিকতা মতাদর্শ হয়ে ওঠার পথে বাধা আছে। সেই জায়গাটা নিল জঙ্গি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন, প্রধানত বামপন্থীদেরই নেতৃত্বে। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের আঞ্চলিকতাও আঞ্চলিকতাই, কিন্তু ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিপরীতে এক বৃত্তিগত সংগঠন। কোনও জাতীয় স্তরের ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে এই দিশা দেখাতে পারেনি। ১৯৭৭ থেকে ১৯৯২-এর মধ্যে কোনও সর্বভারতীয় শিল্পের শ্রমিকবিরোধী বা জাতীয় স্বার্থবিরোধী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনও রাজ্যের ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন সচেতনতা তৈরির আন্দোলন করেছে বলে মনে পড়ে না। অথচ মতাদর্শ বলে তো তাকেই, যা অব্যবহিত প্রয়োজনের অতিরিক্ত।

তেমন অপরিহার্য অতিরিক্ততার অভাবেই ১৯৯২-তে কেন্দ্রে যখন কংগ্রেসের সরকার, এবং নরসিংহ রাও-এর সেই সরকার মনমোহন সিংহের নেতৃত্বে যখন আমাদের অর্থনৈতিক নিরপেক্ষতাকে ব্যক্তিগত বিনিয়োগ-ভিত্তিক অর্থনীতিতে বদলে ফেলছেন, ঠিক তখনই বাবরি মসজিদ ভাঙা হল। ঘটনাটা এমন নয় যে, কংগ্রেস অর্থনীতি করে আর বিজেপি দাঙ্গা করে। ঘটনাটা এই যে, কংগ্রেস যদি ৪২ বছর ধরে লালিত ও সম্মত পরিকল্পিত অর্থনীতি থেকে সরে আসতে পারে, তা হলে বিজেপি-ও লালিত ও সম্মত অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি থেকে সরে আসতে পারে। একই হিংস্রতায়। ১৯৭৭ না হলে ১৯৯২ হয় না।

১৯৯২-এর বাবরি-ধ্বংস না হলে ২০০২-এর গুজরাত দাঙ্গা হয় না। একটা মৌলিক তফাত আছে। বাবরি-ধ্বংসের সময় উত্তরপ্রদেশে বিজেপি ও কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার। রাজ্য সরকারের আপাত-উদাস সক্রিয় সমর্থনে ও কেন্দ্রীয় সরকারের শঠ-ঔদাস্যের ভণ্ডামির জোরে স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে বড় সাম্প্রদায়িক পাপ ঘটল।

২০০২-এর গুজরাতে ও কেন্দ্রে বিজেপি সরকার। সে দাঙ্গা শাসক পার্টি বিজেপি-র রাজ্যগত রাজনীতির প্রয়োজনে সংগঠিত দাঙ্গা, তাদেরই কেন্দ্রীয় সরকারের সতর্কবার্তা সত্ত্বেও। তখন নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রিসভার এক মহিলা সদস্য দাঙ্গাঘটিত অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেল খাটছেন, বর্তমানে প্যারোলে; আর এক সদস্য জালি-সংঘর্ষের মামলায় অভিযুক্ত, বর্তমানে বিজেপি-র ‘সভাপতি’; সেই মন্ত্রিসভার মুখ্য ছিলেন যিনি, তিনি সিবিআইয়ের বেকসুর ছাড়পত্র পান এবং তিনিই আজ ভারতের প্রধানমন্ত্রী।

একটা উদ্ভট কার্যপরম্পরায় বেশ মজা লাগতে পারে। ১৯৯৮-২০০৪-এর মধ্যে বাজপেয়ীর সরকার কিন্তু ‘উন্নয়ন’ নিয়ে খুব একটা হইহল্লা করেনি। যদিও ‘শাইন ইন্ডিয়া’ আওয়াজ তারা তুলেছে, তবু তাদের প্রধান ব্যস্ততা ছিল পাকিস্তান ইত্যাদি নিয়ে। ২০০৪ থেকে ২০১৪, এই দশ বছরে কংগ্রেস অর্থনৈতিক সংস্কারের হদ্দমুদ্দ করেছে। কংগ্রেস খুব সেয়ানা বুদ্ধিতেই ‘উন্নয়ন’ কথাটির বদলে ‘সংস্কার’ কথাটি ব্যবহার করত। কিন্তু কংগ্রেসই ‘উন্নয়ন’ বলতে জিডিপি ও সেনসেক্সকে একমাত্র নিরিখ করে তুলল। আর বৃহত্তর জনগণের স্বার্থ সুরক্ষার একমাত্র উপায় হিসেবে বেছে নিল পার্লামেন্টে বিভিন্ন অধিকারের বিল পাশ— খাদ্যের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, কাজের অধিকার।

এমনকী কংগ্রেসই একশো দিনের কাজ, বিপিএল কার্ড ও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে খয়রাতি চালু করে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক নিরপেক্ষতার পিন্ডি চটকাল। স্বাধীন ভারত মতাদর্শগত যে সম্মতির ভিত্তিতে নানা বাধাবিঘ্নের মধ্যেও নিজের বিশিষ্ট স্বাতন্ত্র্য আত্মমর্যাদার সঙ্গে রক্ষা করে আসছিল, কংগ্রেস নিজেই সেই মতাদর্শকে অবান্তর করে দিল।

বিজেপি কংগ্রেসের ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী। নরেন্দ্র মোদী মনমোহন সিংহেরই যথোচিত উত্তরাধিকারী।

কবি-র সরাইমালিক ‘অচ্ছে দিন’-এর সব প্রাপ্য বিনামূল্যে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন একটিমাত্র শর্তে যে আমাকে পথ বাতলেছিল তার কাছ থেকে সঠিক উত্তর জেনে আসতে হবে।

সেই উত্তরসন্ধান আজ আমাদের নিয়ে এসে ফেলছে মতাদর্শহীনতার প্রেতভূমিতে। সেখানে কংগ্রেস, ভারতীয় জনতা পার্টি, বামপন্থী পার্টিগুলি ও আঞ্চলিক পার্টিগুলি আত্মাহীনতায় আক্রান্ত।

মতাদর্শের উদ্ধার ছাড়া অন্য পথ নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন