সম্পাদকীয় ২

যাহা শিখিবার

সদ্য-প্রয়াত লি কুয়ান ইউ-কে (১৬ সেপ্টেম্বর ১৯২৩ - ২৩ মার্চ ২০১৫) বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হইতে দেখা সম্ভব। নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যুর পর কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রো ব্যতীত গোটা দুনিয়ায় তাঁহার তুল্য আর কোনও রাষ্ট্র-নির্মাতা নেতা জীবিত ছিলেন না। অবশ্য, প্রতিবেশী মালয়েশিয়ার মহাথির মহম্মদকেও ভোলা উচিত হইবে না। অন্য দিকে, মার্গারেট থ্যাচার বা রোনাল্ড রেগনের পর তিনিই প্রকৃত দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রনায়কদের শেষ প্রতিনিধি ছিলেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৫ ০০:০৩
Share:

সদ্য-প্রয়াত লি কুয়ান ইউ-কে (১৬ সেপ্টেম্বর ১৯২৩ - ২৩ মার্চ ২০১৫) বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হইতে দেখা সম্ভব। নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যুর পর কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রো ব্যতীত গোটা দুনিয়ায় তাঁহার তুল্য আর কোনও রাষ্ট্র-নির্মাতা নেতা জীবিত ছিলেন না। অবশ্য, প্রতিবেশী মালয়েশিয়ার মহাথির মহম্মদকেও ভোলা উচিত হইবে না। অন্য দিকে, মার্গারেট থ্যাচার বা রোনাল্ড রেগনের পর তিনিই প্রকৃত দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রনায়কদের শেষ প্রতিনিধি ছিলেন। বর্তমানের এই ওবামা-কেয়ারের দরাজ লঙ্গরখানার আমলে আর কোনও রাজনীতিক কি বলিতে সাহস করিবেন যে তিনি নিখরচার কল্যাণরাষ্ট্রে বিন্দুমাত্র বিশ্বাসী নহেন? তিনি সেই রাষ্ট্রনেতা, যিনি সদ্য-ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত দ্বীপরাষ্ট্রের তিনটি পৃথক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাম্প্রদায়িক সহাবস্থানকে বিপুল গুরুত্ব দিয়াছিলেন। ইংরাজিকে দেশের প্রধান ভাষায় রূপান্তরিত করিয়াছিলেন, যাহাতে ভাষা বিভেদের কারণ না হইয়া দাঁড়ায়। আবার, তিনিই প্রয়োজনে বজ্রমুষ্টিতে শাসনে বিশ্বাসী ছিলেন। ‘বিপজ্জনক’ কমিউনিস্টদের বিনা বিচারে জেলে পুরিতে বলিয়াছিলেন। ইন্দিরা গাঁধীর জরুরি অবস্থা জারি করিবার সিদ্ধান্তকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানাইয়াছিলেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আইনি প্যাঁচে বিপর্যস্ত করিতেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তাঁহার শাসনে সিঙ্গাপুর একটি আশ্চর্য পরিচয় লাভ করিয়াছিল— ‘দেশটি ডিজনিল্যান্ড, তবে সেখানে ফাঁসি দেওয়া হয়’।

Advertisement

গত সহস্রাব্দের সর্বাপেক্ষা তার্ত্যপূর্ণ আবিষ্কার কোনটি, এই প্রশ্নের উত্তরে ছাপাখানা, বিদ্যুৎ, রেল ইঞ্জিন বা ইন্টারনেটকে বাদ দিয়া তিনি বাছিয়া লইয়াছিলেন শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্রকে। বলিয়াছিলেন, এই যন্ত্রটি আবিষ্কার হওয়ার পূর্বে, শুধুমাত্র আবহাওয়ার কারণেই, ক্রান্তীয় এলাকার মানুষরা পশ্চিমি দুনিয়ার উৎপাদনশীলতা হইতে পিছাইয়া থাকিতেন। নিজের দেশটিকে প্রথম বিশ্বের গোত্রে লইয়া যাওয়ার লক্ষ্যটিকে কতখানি পাখির চোখ করিতে পারিলে এক জন নেতা এই ভাবে ভাবিতে পারেন, তাহা ভাবিয়া দেখার। ইহাই লি কুয়ান ইউ-এর অভিজ্ঞান। কোনও কেতাবি আদর্শ নহে, কোনও পূর্বনির্দিষ্ট মতবাদ নহে, যে পথে তাঁহার দেশ সর্বাপেক্ষা দ্রুত উন্নতি করিতে পারিবে, তিনি সেই পথ বাছিয়াছিলেন। একদা হ্যারল্ড লাস্কির ভাবশিষ্য এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শিবিরের অংশ হইয়াও ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহিত সৌহার্দ্য বজায় রাখিতে তাঁহার বাধে নাই। তেমনই, যাহাকে তিনি দেশের প্রকৃত উন্নতি বিবেচনা করিয়াছেন, তাহার স্বার্থে নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করিতেও তিনি দুই বার ভাবেন নাই।

বাজার অর্থনীতির প্রসারে তাঁহার উদ্যোগ ছিল আন্তরিক। দেং জিয়াওপিং যখন চিনে আর্থিক সংস্কারের জানালাগুলি খুলিতেছিলেন, লি কুয়ান ইউ তাঁহার পরামর্শদাতা ছিলেন। ভারতে নরসিংহ রাও ও তাঁহার অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহও বহু বার তাঁহার দ্বারস্থ হইয়াছিলেন। মুক্ত বাজারের প্রতি তাঁহার দায়বদ্ধতা শিক্ষণীয়। তাহার জন্য গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা হারাইবার প্রয়োজন নাই। তবে, গণতন্ত্রের ধ্বজা উচ্চে তুলিবার নামে ভারতে যাহা চলে, তাহার কতখানি গণতন্ত্র, আর কতটা নিজেদের অপদার্থতা ঢাকিবার অজুহাত, এই অবকাশে এক বার নিজেদের প্রশ্নটি করা ভাল। কী ভাবে বিভিন্ন ধর্ম, ভাষাভাষী গোষ্ঠীর মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করিতে হয়, কী ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যের উপর রাষ্ট্রীয় লাগাম পরাইতে হয়, তাহা অবশ্য শিক্ষণীয়। তাহা রাষ্ট্র নির্মাণের প্রাথমিক পাঠ।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন