নিম্নতর জাতি উচ্চতর জাতিকে অনুকরণ করে অনুসরণ করে। নিম্নজাতির অধিকতর মর্যাদা দাবির প্রক্রিয়াকে সমাজতাত্ত্বিক শ্রীনিবাসন একদা নাম দিয়েছিলেন সংস্কৃতায়ন। সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, শ্রীনিবাসনের বিশ্লেষণে একটু সরলীকরণ ছিল। ব্যাপারটা এমন যে এই মর্যাদালাভের প্রক্রিয়া কোনও সংঘাত সৃষ্টি করবে না। এই ওঠা-নামার সামাজিক সচলতা চলতেই থাকবে। আসলে সামাজিক স্থিতিস্থাপকতা কখন ছিঁড়ে যাবে সেটাও বোঝা দরকার, সেই সঙ্কট বিন্দুতেই সামাজিক পরিবর্তন সাধিত হয়।
পশ্চিমবঙ্গে জাতিভেদের ভয়াবহ বিদ্রোহ দেখা যায়নি, কিন্তু পার্থবাবু দেখিয়েছেন গণশক্তি প্রকাশিত ‘ডায়াল’ নামক টেলিফোন ডিরেক্টরির নাম সমীক্ষা করে দেখা যাচ্ছে বাংলায় উচ্চবর্ণের আধিপত্য। ১৯৩১ সালের সেন্সাস অফ ইন্ডিয়ার রিপোর্টেও চামার ছিল শতকরা ২.১৮ ভাগ কিন্তু ইংরেজিতে সাক্ষরতা ছিল এরমধ্যে ০.৮৪ ভাগ। আর ব্রাহ্মণ ছিল শতকার ১৩.২৪ ভাগ, যার মধ্যে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ৩২.৩৯ ভাগ।
এটা থেকেই বোঝা যায়, পশ্চিমবাংলায় উচ্চবর্ণের আধিপত্য কী প্রবল। ডঃ রামশরণ শর্মার ‘প্রাচীন ভারতে শূদ্র’ গ্রন্থ থেকে জানতে পারছি অতীতে কৃষিজীবিতার ক্ষেত্রে কিন্তু সমাজ যথেষ্ট আর্থিক সম্মান দিত। কৌটিল্যর অর্থশাস্ত্রে কৃষি-শ্রমিক ও গোপালকদের যে বেতন ধার্য করেন তার পুনরাবৃত্তি করেছেন যাজ্ঞবল্ক্য নারদ কাত্যায়ম। ‘শান্তিপর্ব’ ও ‘বৃহস্পতি স্মৃতি’তেও কৃষি শ্রমিকদের উচ্চতর বেতন হারের কথা বলা হয়েছে। তবে এই কৃষি শ্রমিকরা হয়ত ভাগচাষি ছিলেন না। কিন্তু এটা স্পষ্ট আধুনিক যুগে শ্রমিকদের প্রতি অন্যায় অসাম্যর মনোভাব বেড়েছে বই কমেনি। বৌদ্ধধর্মও জাতপাত বিরোধিতায় সাহায্য করেছিল। বুদ্ধর মতো সাধারণ অবস্থায় যে লোকটির আপনি দাস- কর্মকারের মতো ব্যবহার করেন, তিনি যদি সঙ্ঘে যোগ দেন, তাহলে তার প্রতি আপনি কেমন আচরণ করবেন? রাজা বুদ্ধর দর্শন মেনে স্বীকার করছেন যে তাঁর সঙ্গেও সম্মাননীয় ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির মতো আচরণ করবেন। আসন, চীবর, পিন্ড-পাত্র, শয়ন-আসন ও ঔষধ-পথ্য দিয়ে তাঁকে সম্মান জানাবেন। (বিনয়-পিটক)
সমস্যা হচ্ছে, বৈষ্ণব ধর্মই হোক আর বৌদ্ধ ধর্মই হোক, ভারতীয় সমাজে জাতিভেদ বর্ণভেদের অবসান ঘটাতে পারেনি। উল্টে এ দেশে দলিত ও নিম্নবর্গের আইডেনটিটি নিয়ে রাজনীতি তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ মণ্ডল কমিশনের বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়ে গোটা দেশ জুড়ে ঝড় তোলেন। সুরিন্দর এস জোডকা (প্রফেসর অব সোসিওলজি অ্যান্ড চেয়ারপার্সন-সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব সোশ্যাল সিস্টেমস জেএনইউ, নয়াদিল্লি, অক্সফর্ড) প্রকাশিত ‘কাস্ট’ গ্রন্থে এক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য পেশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ভারতে পলিটিকস অব আইডিওলজি থেকে এক নীরব রূপান্তর হয়েছে সেটি হল ভারতের রাজনীতি। পলিটিক্স অব রিপ্রেসেন্টেশন অর্থাৎ মতাদর্শের রাজনীতি থেকে ভারতের রাজনীতি জনপ্রতিনিধিত্বের রাজনীতিতে স্থানান্তরিত হয়েছে। ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ সালে ভারতের নানা প্রান্তে যে আঞ্চলিক দলগুলির বিকাশ হয়েছে তাতে এই গ্রামীণ কৃষি প্রধান জাতপাতের প্রতিনিধিত্বের রাজনীতি লুক্কায়িত ছিল। ১৯৬৭ সালে আটটি রাজ্যে কংগ্রেস প্রথম বিধ্বস্ত হয়, স্বাধীনতার পর প্রথম জোট-রাজনীতির যাত্রাপথ শুরু হয় যার সঙ্গে আঞ্চলিক রাজনীতি ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত।
আবার নব্বুইয়ের দশকে মধ্যবিত্ত সমাজের বিপুল প্রসার হলেও সে ক্ষেত্রে শুধু সংস্কৃতায়ন নয় এর মধ্যে অভিজাত তন্ত্রের গ্রামিণীকরণের ঘটনাও হয়েছে, যাকে বলা হয়েছে রুরালাইজেশন অব এলিটিসম। এ অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গে ’৭৭ সালে সিপিএম তথা বাম ক্ষমতায় এসে বাংলার এই নিম্নবর্গ দলিত ও কৃষিজীবী সমাজের রাজনৈতিক পরিসরকে প্রধান ভোটব্যাঙ্ক করে তোলে। সেই সব মূঢ় মুখে ভাষা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হলে, সেই স্বপ্নভঙ্গের ফল হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দখল করে নেন সেই রাজনৈতিক পরিসর। এখন আবার বিজেপি সেই রাজনৈতিক পরিসর দখল করতে উদ্যত।
প্রশ্ন হল, গ্রামীণ নিম্নবর্গ সত্যই কি কলকাতার নাগরিক সমাজের একাংশের মতো একই ভাবে তিতিবিরক্ত। এ আর দেশাই সম্পাদিত রুরাল ‘সোসিওলজি অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে পশ্চিমবাংলার কেস স্টাডি করতে গিয়ে বলা হয়েছে, পশ্চিম বাংলায় গ্রাম ও শহরের মধ্যে রাজনৈতিক ওসমোসিস কম হয়। অর্থাৎ শহর ও গ্রামের মধ্যে রাজনৈতিক চিন্তার অভিস্রবণ ধীর গতিতে হলে শহরের মনোভাব গ্রামে পৌঁছতে আরও সময় লাগে। তবে নবান্নের রাজনীতিতে কোনও পরিবর্তন না হলে ধীরে হলেও অভিস্রবণ গ্রামে যেতে বাধ্য। সময় লাগতে পারে। সিপিএমও এই একই কারণে শহরে জনপ্রিয়তা হারিয়েও বহু দিন ক্ষমতাসীন ছিল।
এ এক অদ্ভুত নতুন ধরনের পরিচিতির রাজনীতি। অধ্যাপক কাঞ্চা ইলিয়া হায়দরাবাদের মেঠলানা আজাদ ন্যাশনাল উর্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব সোশ্যাল এক্সক্লুশান অ্যান্ড ইন্ক্লুসিভ পলিসি’র অধিকর্তা। তিনি সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন। নাম ‘হোয়াই আই অ্যাম নট আ হিন্দু’। এই বইতে তিনি লিখেছেন যে দক্ষিণ ভারতের এক প্রত্যন্ত গ্রামে নিরক্ষর এক পরিবারে তাঁর জন্ম। জাত ছিল কুরুমা। পেশায় তারা ছিল ভেড়া প্রতিপালনকারী সম্প্রদায়। নিজেদের জমিও ছিল না। জমির মালিকের কাছ থেকে জমি ধার নিয়ে বাবা ভেড়া চাষ করতেন। তার জন্য তাদের বিশেষ ভেড়া প্রতিপালন কর (পুল্লানা লেভি ফর শিপ ব্রিডিং) দিতে হত তেহশিল অফিসে। কাঞ্চা ইলিয়া বলছেন, ওখানকার স্থানীয় হিন্দু ধর্ম, সংস্কৃতি, উৎসব আচার-আচরণ কোনও কিছুর সঙ্গেই আমাদের সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির মিল ছিল না। আমাদের একটাই পরিচিতি ছিল সেটা হল আমাদের শূদ্র জাতি পরিচিতি। তাই নিজেকে ‘নন-হিন্দু’ যদি নাও বলি, ‘ান-হিন্দু’ তো বলতেই হবে।
দলিতায়ন ও হিন্দুকরণ এই দুটি বিষয়কে তিনি পৃথক করেছেন। বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবার এর ঠিক উল্টো কাজটাই করছে। তারা হিন্দু সমাজকে সুসংহত করার জন্য উচ্চবর্ণ দলিতের মিলন ঘটাতে চান। পশ্চিমবঙ্গের ভোটের রাজনীতিতেও সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত। অন্য দিকে প্রশ্ন একটাই কলকাতা শহরে শুধু নয়, সমগ্র বাংলায় নিম্নবর্গ নিজেদের হিন্দু পরিচিতি সম্পর্কে কতটা সচেতন না কি তারা অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া নিম্নবর্গ হিসাবে ক্ষমতায়ন চাইছে? এখানে আর একটি প্রশ্ন হল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসনে কি নবান্ন কি জেলা দলিত ওবিসি আমলার প্রতিনিধিত্ব কতখানি? গ্রামীণ পঞ্চায়েত ও পুরসভা স্তরেই বা এই সমাজের আনুগত্য কোন দিকে?
(শেষ)