নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়ের ছাত্র আমি। ’৭৭ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলাম। আজকের প্রধান শিক্ষক স্বামী বেদপুরুষানন্দের আমন্ত্রণে সম্প্রতি সেই আবাসিক বিদ্যালয়ে এক দিন কাটিয়ে এলাম। সারা দিন কচিকাঁচাদের সঙ্গে দিন কাটালাম। সন্ধ্যায় ওদের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতা। রাত্রিবাসও সেখানেই। ঘুরে ঘুরে দেখলাম খেলার মাঠ, ডাইনিং হলে একসঙ্গে খেলাম, সন্ধ্যায় প্রার্থনাগৃহে আরতিতে যোগ দিলাম, ছাত্রজীবনে যেমনটা নিয়মিত করতাম।
চল্লিশ বছর পর বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ২৪ ঘণ্টা কাটিয়ে এটাও কিন্তু বুঝলাম, নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের মতো এক প্রথিতযশা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কত রকম সমস্যায় ধুঁকছে। গোটা পৃথিবী তার প্রেক্ষিতে ভারত, তার পটভূমিতে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি ও সমাজতত্ত্বে যখন এত পরিবর্তনের ঝড়, তখন সেই পরিবর্তিত আর্থিক ও সামাজিক পটভূমিতে নরেন্দ্রপুর এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো তার প্রাচীন ভাবাদর্শের ধ্বজা উড়িয়ে কী ভাবে চলবে? কাজটা কিন্তু সহজ নয়।
বিশ্বায়নের ফলে ইন্টারনেট-ফেসবুক-মোবাইল-সোস্যাল মিডিয়ার যুগে রামকৃষ্ণ মিশনের এই বিদ্যালয়টি কী ভাবে অপরিবর্তিত এক সত্তা হিসাবে বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপের মতো টিকে থাকবে?
উদাহরণ দিচ্ছি। পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত নরেন্দ্রপুরের ছাত্রদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয় না। স্কুলে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ অবশ্য আছে। কিন্তু অনেক অভিভাবক চাইছেন, তাঁদের সন্তানদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের স্বাধীনতা দেওয়া হোক। হস্টেল জীবনে মোবাইল দেওয়া মানেই তার বহু অপপ্রয়োগের আশঙ্কা আছে। তা ছাড়া আবাসিক জীবনে একটা ন্যূনতম সাম্য বজায় রাখতে হয়। কেউ আই ফোন ব্যবহার করবে, কেউ সস্তার ফোন। কিন্তু এই অনুমতি না দেওয়ায় এখন কী হচ্ছে? সাংবাদিক হিসাবে ঘুরতে ঘুরতে সে তথ্য পেয়ে গেলাম কিছু ছাত্রের কাছ থেকেই। কিছু অভিভাবক রান্নার কিছু পাচক বা হস্টেলের কিছু কর্মীকে অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে তাঁদের মোবাইলের সাহায্যে সন্তানদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন বলে কেউ কেউ জানাল।
অভিভাবকেরা প্রায় সকলেই চান তাঁদের সন্তান যাতে ফার্স্ট বয় হয়। হয় ইঞ্জিনিয়ার নয়তো চিকিৎসক। যেন নরেন্দ্রপুর এই সব পেশার সফল ব্যক্তি তৈরির একটা কারখানা। ইঞ্জিনিয়ারিং আইআইটি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য ফিটজি-র মতো সংস্থা কোচিং দিয়ে এখন খুব জনপ্রিয়। বহু অভিভাবক চাইছেন স্কুলে ফিটজি-র ইউনিট খুলে দেওয়া হোক। দিল্লি পাবলিক স্কুল যদি করতে পারে, অন্যেরা নয় কেন? নরেন্দ্রপুরের স্কুলের সাবেক বক্তব্য, আমাদের শিক্ষাপদ্ধতি, পঠন-পাঠন পদ্ধতিতেই এত দিন ধরে ছাত্রেরা আইআইটি-তে একচেটিয়া সুযোগ পেয়েছে, তা হলে আজ ফিটজি-র দরকারটা কী? এই বিশ্বায়নের যুগে বাজার অর্থনীতিতে ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে বিতর্ক! নরেন্দ্রপুরকে স্বায়ত্তশাসিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দিয়েছে রাজ্য সরকার। কিন্তু এই স্বায়ত্তশাসনের অর্থ কী? তার সীমা কোথায়? এ সব এখনও সরকার লিখিত ভাবে স্পষ্ট করে দিতে সক্ষম হয়নি। শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে জটিলতা আছে— কতটা সেটা হবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে, কতটা হবে মিশন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে। আবার আগে অনেকেই আবাসিক হতেন, গুরুকুলের আবাসিক শিক্ষার ঐতিহ্য ছিল। এখন শিক্ষকেরা মূলত বহিরাগত। তাঁরা কেউ কেউ বাইরে প্রাইভেট প্র্যাকটিসও করেন।
আসলে শুধুমাত্র শিক্ষক বা অভিভাভবককে একতরফা দোষ দিলেও হবে না। এটা সামগ্রিক ভাবে ভারতের সমাজ ব্যবস্থার চালচিত্র। একটি ঘটনা শুনলাম, কলকাতার কোনও এক বিখ্যাত স্কুলে এক ছাত্র পড়াশোনায় অমনোযোগী বলে শিক্ষক মহাশয় অভিভাবককে ডেকে পাঠান। তা সেই ছাত্রের মা সব শুনে নিজের ছেলেকে বলেছেন, বেটা মন দিয়ে পড়ো, না পড়লে কী হবে? এই মাস্টারের মতো তোমাকেও একটা স্কুলের মাস্টার হতে হবে। ডু ইউ ওয়ান্ট দ্যাট ওনলি? কী ভয়ঙ্কর ভাবুন তো!
****** ******* *******
নরেন্দ্রপুর আমার কাছে এক দারুণ কেস স্টাডি বা নমুনা সমীক্ষা। ১৮৫৭ সালে কলকাতা চেন্নাই মুম্বই শহরে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হয়েছিল। সমাজতাত্ত্বিক আন্দ্রে বেঁতে স্মরণ করিয়েছেন, সেই ঔপনিবেশিক ভারতে এই বিশ্ববিদ্যালয় যখন স্থাপিত হয় তখনও কিন্তু এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ধর্ম নিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। মেয়েদের পঠনপাঠনেও বাধানিষেধ ছিল না। জাতপাত বা আর্থিক শ্রেণির জন্যও যোগ্যতায় বাধা হয়নি। অথচ, সেই একই সময় ইংল্যান্ডের দুই প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ড কেমব্রিজেও কিন্তু ছিল চার্চের আধিপত্য। মেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ ছিল না। আন্দ্রে বেঁতে দেখিয়েছেন, ইউরোপেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাম্য প্রতিষ্ঠায় কত সময় লেগেছে।
আসলে ভারতেও আজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির অভিমুখ নিয়ে এসেছে বিরাট সমস্যা। ভারতের নবজাগরণের পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয় বেশি সংখ্যক মানুষকে স্নাতক ডিগ্রি দিয়ে তাদের চাকরি দেওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য। তখন এ হেন বিপুল মধ্যবিত্ত সমাজ ছিল না। ফলে ডিগ্রি দেওয়ার কারখানা থাকলেও কিন্তু সেখানে মেধাতন্ত্র বা মেরিটোক্র্যাসি-র জন্ম দেওয়া সম্ভব হত। আন্দ্রে বেঁতে তাঁর ইউনিভার্সিটিস অ্যাট দ্য ক্রসরোড্স গ্রন্থে নানা বক্তৃতা ও প্রবন্ধ সঙ্কলনে বলেছেন, উনবিংশ শতাব্দীতে বিশ্ববিদ্যালয় মেধার উৎকর্ষ নিয়ে ভেবেছে, কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শিক্ষার অভিমুখ ‘মাস ইউনিভার্সিটিস’। মূল প্রশ্ন হল, সামাজিক সাম্য ও অসাম্য নিয়ে। মেধার উৎকর্ষ সমাজে অসাম্য তৈরি করছে, আবার আমরা বেশি সংখ্যক মানুষকে শিক্ষার আলো দিয়ে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা তৈরি করতে চাইছি। নরেন্দ্রপুরও আমজনতার স্কুল তো কী? কঠিন পরীক্ষা দিয়ে সেখানে পড়ার সুযোগ পেতে হয়। তা হলে এটিও তো মেধার উৎকর্ষ নিয়ে ভাবিত? মেরিটোক্র্যাসি?
আবার এক-একটি ক্লাসে শতাধিক ছাত্র। এরা সবাই তো ফার্স্ট বয় নয়। আন্দ্রে বেঁতে বলছেন, আসলে সাম্য ও অসাম্য, দুই-ই থাকবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অসাম্য দূর করতে পারবে না, কিন্তু সকলকে আরও বেশি বেশি করে সুযোগ দেবে যাতে প্রত্যেকে নিজের প্রতিভা বিকাশের যথেষ্ট সুযোগ পাবে। আন্দ্রে বেঁতে এটাকে বলেছেন, ইন্ডিভিজুয়াল মবিলিটি। স্বাধীনতার পরই সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশনের প্রধান করা হয়। তখন রাধাকৃষ্ণণ-ও তার রিপোর্টে বলেছিলেন, Intellectual work is not for all, it is only for the intellectually competent.
ফ্রান্সে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা গঠনের প্রধান জনক ছিলেন নেপোলিয়ন। তিনিও খোলাখুলি বলেছেন, ‘কেরিয়ারস ওপেন টু ট্যালেন্ট’। তবে নরেন্দ্রপুরের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে শিক্ষার সঙ্গে গবেষণার কাজকেও আরও বেশি করে যুক্ত করতে হবে। আমি নিজে দেখেছি, ঠাকুর-মা-স্বামীজির ভাবাদর্শে পরিচালিত নরেন্দ্রপুর বিদ্যালয় কখনওই ধর্মনিরপেক্ষতার পথ থেকে বিচ্যুত হয়নি। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম বছরে ইলাহাবাদ, তার পর আলিগড়ে গিয়ে পর পর দু’বছরে দু’টি বক্তৃতায় নেহরু বলেছিলেন, বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘হিন্দু’ বলা বা আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়কে মুসলিম বলাটা আমার আদৌ পছন্দ হয় না। নরেন্দ্রপুরে কত সংখ্যালঘু ছাত্র আমাদের সহপাঠী ছিল, আজও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বহু ছাত্র এই প্রতিষ্ঠানে আছে। তবে ভারতীয় সংস্কৃতির পঠনপাঠনে অতীতেও জোর দেওয়া হত, আজও হয়।
কিন্তু এটা রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী পরিচালকেরা বুঝতে পারছেন, শিক্ষা ব্যবস্থা আজ এক রূপান্তর পর্বের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সাবেক শিক্ষা ব্যবস্থাকে অতীত মূল্যবোধে কতটা ফেলব আর কতটা রাখব, সে এক মস্ত বড় প্রশ্ন। আমরা দেওয়াল পত্রিকায় লিখতাম, ছবি আঁকতাম। জুনিয়র স্কুলে অদ্বৈতানন্দ ভবনে এখনও ‘বর্ণালী’ নামের সেই দেওয়াল পত্রিকা বের করছে ছাত্রেরা। প্রশ্ন, এই দেওয়াল পত্রিকা নিয়ে ৪০ বছর আগে আমাদের যে উৎসাহ ছিল তা সত্যি সত্যিই আছে তো? এখন ইন্টারনেটে পত্রিকা তৈরি বা ব্লগ লেখার প্রতি তাদের আকর্ষণের তীব্রতা অনেক বেশি নয়তো? আমরা জোর করে সেই পুরনো আঙ্গিকের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখতে বাধ্য করছি না তো? যেমন, আমাদের সময়ে ফুটবল-ক্রিকেট ছিল, সুইমিং পুল বা সাঁতার শেখার আলাদা ক্লাস ছিল না। এখন তো দেখলাম নতুন সুইমিং পুল তৈরি হয়েছে।
তাই, ছাত্রেরা শিক্ষকদের মানছে না, ছাত্রেরা বিদ্রোহী হয়ে উঠছে, এই অভিযোগের পাশাপাশি শিক্ষণকেও নিয়মিত আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। আর শিক্ষানীতিতে চাই ভারসাম্য। মডেল স্কুল বা প্রিপারেটরি স্কুল গঠনের মাধ্যমে মেধার উৎকর্ষ সমাজের জন্য জরুরি। মেকলে-কার্জন সেই মডেল শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন। আবার সকলকে শিক্ষিত করা ও স্বাক্ষর করার অভিযানে নিযুক্ত করাটাও প্রয়োজন। শিক্ষার জগতে এই সাধারণত্ব ও অসাধারণত্বের মিলন প্রয়োজন। যা আজ ভয়াবহ ভাবে দুর্লভ। সর্বভারতীয় স্তরে শিক্ষানীতির এই দৈন্য ঘুচবে কী করে? এক জন নরেন্দ্র মোদী এসেই এই সমস্যার সমাধান করে দেবেন, এমন ভাবাটা কল্পনাবিলাস!