আলো ক্রমে আসিতেছে। এশিয়া হইতে পশ্চিমে। পূর্বগগনের দীপ্তরশ্মিতে ধীরে ধীরে আলোকিত হইতেছে পশ্চিম। পরিবার কিংবা বংশের গুরুত্ব ক্রমে ছ়়ড়াইয়া পড়িতেছে অনালোকিত দুনিয়ায়, যেখানে এত কাল ব্যক্তিসর্বস্বতার আ়ড়ালে খামখাই ঢাকা পড়িত পরিবারতন্ত্রের মহিমা। পিতৃপরিচয়ে পুত্র বা পুত্রী, স্বামীর গৌরবে গরবিনি স্ত্রী যে আদৌ ফেলনা নহেন, সমাজের অন্যান্য নাগরিকের অপেক্ষা অধিকার-মাহাত্ম্যে যে তাঁহারা বেশ কিছুটা আগাইয়া থাকেন, তাই সহজেই নেতৃত্বের শিরোপা দাবি করিবার উচ্চতায় সমারূঢ় হইতে পারেন, তাহা শিখিয়া লইয়াছেন মার্কিন গণতন্ত্রীরাও। দুই-দুই বার প্রেসিডেন্ট পদে অভিষিক্ত নেতার পত্নী সে দেশের আগামী নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হইতে চলিয়াছেন। কেবল নেত্রী নহেন, এশীয় আলোকে উদ্ভাসিত মার্কিন জনসমাজও এই নূতন ডেমোক্র্যাট প্রার্থীর আবির্ভাবে প্রশ্নহীন ভাবে প্রসন্ন। ১৯৯৪ ও ১৯৯৮, বিল ক্লিন্টনের দুই বিজয়ের পর হিলারি ক্লিন্টন যদি ২০১৬ সালে ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তাহা হইলে ক্লিন্টন পরিবার বারো বৎসর আমেরিকার প্রথম পরিবার হইবার অভূতপূর্ব সৌভাগ্যের অধিকারী হইবে।
ঐতিহ্য রফতানির এই দৃষ্টান্তের সঙ্গে সঙ্গে এশিয়া তাহার দুর্লভ বিশিষ্টতাটি হারাইল। এই মহাদেশের বিভিন্ন দেশে এত দিন এই একান্ত এশীয় ধারার উদ্যাপন চলিত। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মুজিব-কন্যার কথা মনে আসিবে। মনে পড়িবে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট সলোমন বন্দরনায়েকের পত্নী সিরিমাভো বন্দরনায়েকের কথা, এবং তাঁহার প্রেসিডেন্ট-কন্যা চন্দ্রিকা বন্দরনায়েকের কথা। পিতা মাতা ও অপত্য— একই পরিবারের তিন সদস্য রাষ্ট্রপ্রধান হইবার এই দৃষ্টান্ত এখনও বিশ্বে বিরল। (দুই দফার ইউপিএ শাসনের সুযোগে সনিয়া গাঁধী ও তাঁহার তনয় এই রেকর্ড স্পর্শের চেষ্টা করিতে পারিতেন, কিন্তু গতস্য শোচনা নাস্তি।) পাকিস্তানে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট-এর কন্যা বেনজির প্রেসিডেন্ট হন নাই, কিন্তু বিরোধী নেত্রী হিসাবে যশোভাগিনী হইয়াছিলেন। অধিকতর কৃতী ও যশোময়ী হন মায়ানমারের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট-পুত্রী অাং সান সু চি। কিন্তু সর্বাপেক্ষা দীর্ঘ বংশপরম্পরার গরিমায় গরীয়সী দেশ ভারত, যেখানে নেহরু-গাঁধী পরিবার চার পুরুষ ধরিয়া নেতৃত্বের একক অভিলাষে নিমজ্জিত। নেহরু-কন্যা ইন্দিরা, ইন্দিরা-পুত্র রাজীব, রাজীব-পত্নী সনিয়া, সকলের ক্ষেত্রেই ভারতীয় সমাজ সংশয়বিদ্ধ হইয়াছে গণতন্ত্র এই বংশানুক্রমী নেতৃত্বের যথার্থ মঞ্চ কি না, তাহা ভাবিয়া। এই সংশয় চূড়ান্ত হয় রাজীব-পুত্র রাহুলের ক্ষেত্রে, যিনি অজস্র সুযোগ সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত নেতৃত্ব-গুণের বিন্দুসম পরিচয়ও দিতে পারেন নাই।
রাহুলের উদাহরণটি হিলারি স্মরণে রাখিতে পারেন। উত্তরাধিকার যদিও বা সুযোগ সৃষ্টির পথ হয়, দক্ষতা বা সাফল্যের পথ হইতে পারে না। শেখ হাসিনা বা ইন্দিরা গাঁধী তাঁহাদের নিজস্ব ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও যোগ্য রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু সুযোগ সত্ত্বেও যদি প্রাপ্ত পদের সম্মান রক্ষা করা না যায়, তাহা হইলে ইতিহাস অতি নির্দয় হইবে, ভাবী প্রজন্মের নিকট হাস্যাস্পদ হইতে হইবে। হিলারি ক্লিন্টন এখনও পর্যন্ত সরকারি দায়িত্ব পালনের কাজে, সেনেটে জনপ্রতিনিধিত্বের কাজে, বিদেশ মন্ত্রক পরিচালনার কাজে সাফল্য দেখাইয়াছেন ঠিকই, কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থীর নিকট এ সবের অপেক্ষাও অনেক বড়় নেতৃত্বগুণ প্রত্যাশিত। হয়তো তিনি পারিবেন। হয়তো তাঁহার মধ্য দিয়া প্রাচ্যের বংশগরিমার সহিত পশ্চিমের দক্ষতা-সংস্কৃতির একটি সুযোগ্য মিশেল ফুটিবে। হয়তো।