রাষ্ট্রের অন্তরাত্মায় আঘাত করিলে সে প্রবল প্রত্যাঘাত করিতে চাহিবেই। খাস প্যারিসের বুকে বিধ্বংসী আক্রমণ কেবল বহু নাগরিকের প্রাণ হরণ করে নাই, দেশের সরকারকে নাগরিকদের নিরাপত্তা রক্ষায় অপারগ বলিয়া প্রমাণ করিয়াছে। তদুপরি, বেশ কিছু কাল ধরিয়াই ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া ওলাঁদ-এর জনপ্রিয়তা তলানিতে, ফলে অভিশপ্ত শুক্রবারের পরে নিছক রাজনৈতিক আত্মরক্ষার তাগিদেও ইসলামিক স্টেট-এর বিরুদ্ধে তাঁহার ‘নির্দয় যুদ্ধ’ ঘোষণা প্রায় পাভলভীয় প্রত্যাবর্ত ক্রিয়ার মতোই অবধারিত ছিল। সন্ত্রাসী হানা ও তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া অনিবার্য ভাবেই ৯/১১-র তুলনা টানিয়া আনিয়াছে। ২০০১-এর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতোই ২০১৫-র ফ্রান্সের ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ও একই সঙ্গে ভিতরের ও বাহিরের। এক দিকে, শত্রুর সদর দফতরে বোমাবর্ষণ। অন্য দিকে, নিরাপত্তা জোরদার করিতে কঠোর আইন ও তাহার কঠোরতর প্রয়োগ। সন্ত্রাসের কারিগরদের সন্ধানে প্রবল অভিযানের সঙ্গে সঙ্গে ওলাঁদ দেশে জরুরি অবস্থা জারি রাখিয়া রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণ হইতে অনেক দূর অবধি রেহাই দিতে চাহিতেছেন, কারণ— পরিচিত যুক্তি— ‘নাগরিকের অধিকার রক্ষার ষোলো আনা দায় কাঁধে লইয়া ইসলামিক স্টেটের মতো শত্রুর সহিত লড়াই করা যায় না।’
বাহিরের এবং ভিতরের দুই যুদ্ধই যুগপত্ জরুরি এবং বিপজ্জনক। আইএস-এর দানবীয় শক্তিকে প্রতিহত করিতে তাহার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের প্রয়োজন আছে, এই সত্য সম্ভবত এখন সর্বজনস্বীকৃত। এমনকী ব্রিটিশ লেবার পার্টির নায়ক জেরেমি করবিনও আইএস-এর বিরুদ্ধে বিমান হানার প্রতিবাদে তাঁহার পরিচিত ভাষণ প্যারিস কাণ্ডের পরে আপাতত সংবরণ করিয়াছেন। কিন্তু ইহাও সত্য নহে যে, স্রেফ বোমাবর্ষণ করিয়া জঙ্গি ঘাঁটি ভাঙিয়া দিতে পারিলেই সমস্যা মিটিয়া যাইবে। ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন বিমান হানা সমস্যার সমাধান করিতে পারে নাই, বরং পশ্চিম এশিয়ার বর্তমান মহাসংকট সৃষ্টির প্রধান কারণ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। বোমার আঘাতে জঙ্গি ঘাঁটির সহিত জনজীবনও ধ্বংস হইতে বাধ্য। সেই ধ্বংস প্রতিনিয়ত আক্রমণকারীর প্রতি বিদ্বেষ এবং ঘৃণায় প্রবল ইন্ধন দেয়, এক একটি বোমারু অভিযান হইতে কত মানববোমার সৃষ্টি হয়, তাহার হিসাব জর্জ ডব্লিউ বুশ কষেন নাই, ফ্রঁসোয়া ওলাঁদও এখন কষিতে নারাজ। এই বে-হিসাব বিপজ্জনক।
সমান বিপজ্জনক সন্ত্রাসের মোকাবিলায় নাগরিক অধিকার খর্ব করিবার উদ্যোগ। ফ্রান্স তথা ইউরোপের বিপন্নতা অনস্বীকার্য। বিপদের মোকাবিলায় আপত্কালীন তত্পরতা নিশ্চয়ই জরুরি। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি জরুরি অবস্থা জারি করিয়া জঙ্গি দমন করিতে চাহিলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্র বিনষ্ট হইতে পারে। নাগরিকের স্বাধীন জীবনাচরণের সম্পূর্ণ অধিকার সেই চরিত্রের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বাক্স্বাধীনতা, নিজস্ব মত ও রুচি মাফিক ধর্মাচরণের অধিকার, অবাধ চলাচলের অধিকার— এই সমস্তই উদার গণতন্ত্রের অপরিহার্য শর্ত। বস্তুত, গণতন্ত্রের প্রতিকূল সমস্ত শক্তির বিরুদ্ধে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রামেও এই স্বাধীনতাই সমাজ ও রাষ্ট্রকে স্থায়ী সামর্থ্য জোগায়। নিরাপত্তার তাগিদে স্বাধীনতা খর্ব করিলে সাময়িক সুবিধা হইতে পারে, কিন্তু সমাজ উত্তরোত্তর তাহার স্বাস্থ্য ও শক্তি হারায়, অ-গণতন্ত্রের ব্যাধি সেই দুর্বল দেহে সহজে বাসা বাঁধে। সেই বিপদ এমনকী ফ্রান্সের পক্ষেও প্রাসঙ্গিক। ফরাসি সমাজ ও সংস্কৃতি ‘স্বাধীনতার প্রতীক’ হিসাবে বন্দিত। সেই মর্যাদা অকারণ নহে, ইতিহাসপ্রসূত। কিন্তু তাহাকে রক্ষা না করিলে ইতিহাস অন্য পথে চলিতে পারে। সেই পথের নাম কানাগলি।