মহামান্য সারমেয়
সরকারি হাসপাতালে কুকুরের ডায়ালিসিস-এর নির্দেশ সংক্রান্ত বিতর্কের সূত্রে বলা হয়েছে, ‘মানুষ যেখানে ডায়ালেসিসের সুযোগ না-পেয়ে দীর্ঘ প্রতীক্ষায় রয়েছে, সেখানে কুকুরের...’ ইত্যাদি।
তা হলে তো ধরে নিতে হচ্ছে, মানুষ আর কুকুরের সমানাধিকার নেই। কিন্তু পোষা কুকুরকে ঘিরে যে ভয়ানক পাশ্চাত্য-অনুগামী মানসিকতার মধ্যে রয়েছি আমরা এখন, তাতে করে তো এমনটা মনে হচ্ছে না। প্রতিবেশীর উচ্চ পেডিগ্রির কুকুর প্রবল চিৎকারে অতিষ্ঠ করে তুললেও কিছু বলা যাবে না, আর বললেও অপর প্রান্ত থেকে বেপরোয়া ‘বেশ করেছি’ শুনতে হবে। পোষা কুকুর এর ওর বাড়ির সামনে দিনের পর দিন মলত্যাগ করলেও তা মুখ বুজে মেনে নিতে হচ্ছে। কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, ঠিক মতো ট্রেনিং দিলে কুকুর কমোডে গিয়ে তার কাজ সেরে আসবে। এই ‘ঠিক মতো’ ব্যাপারটা কতটা ঠিক ভাবে চলছে তা তদারকি করার মতো কোনও পরিকাঠামো এখানে নেই। আবার ‘ঠিক’ কোনও কারণে কতক্ষণ কত ডেসিবেলে পড়শির কুকুর চিৎকার করলে তা সহনসীমার মধ্যে থাকবে তা নিয়েও নির্দিষ্ট কোনও নির্দেশিকা নেই। আর এই সবের প্রতিবাদ করলে ‘অ্যানিমেল হেটার’ বলে চিহ্নিত হতে হচ্ছে এখন।
মনে পড়ে যাচ্ছে, ছোটবেলায় পাড়ার কুকুর মোতি ছিল সবার কুকুর। পাড়ার মানুদি রোজ খেতে দিত তাকে। নিজেদের যা জুটত তা দিয়ে। সেখানে কোনও আড়ম্বর ছিল না। কোনও পেডিগ্রির গর্ব ছিল না। এই মোতি যখন শেষ অবস্থায় সারা শরীরে ঘা নিয়ে আমাদের বাড়ির সিঁড়ির তলায় আশ্রয় নিল, তখন শম্ভুনাথ পণ্ডিতে গিয়ে ১৪টা ইঞ্জেকশনের ঝুঁকি নিয়েও আমরা তাকে আশ্রয় দিয়েছি। অথচ, কুকুর নিয়ে নুইসেন্সের বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে আমরা হয়ে গেলাম পশুবিদ্বেষী, আর অন্য পক্ষ ‘পশুপ্রেমী’। সম্প্রতি হাওড়ায় আমাদের এক সহনাগরিক সারা দিন পরিশ্রম করে বাড়ি ফেরার পথে আট-দশটি কুকুরের প্রবল চিৎকারের মুখে পড়তেন। অবশেষে এক দিন তা ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করায় হাতাহাতি থেকে খুন অবধি পৌঁছয়। খুন হন ওই কুকুরগুলোর আশ্রয়দাতা এক পশুপ্রেমী। এই মর্মান্তিক ঘটনা থেকে কোনও শিক্ষা না নিয়ে পশুপ্রেমীরা সেখানে গিয়ে প্রায় শোকপ্রস্তাব পাঠ করে আসেন। কেউ বা আবার লিখে জানান যে, তাঁর পোষা কুকুরের চিৎকারে তিষ্ঠোতে না পেরে প্রতিবেশী জননেতা সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মীকে দিয়ে কেমন করে চিৎকার থামানোর ‘অনুরোধ’ পাঠান।
অতএব নিজের বাড়ির বারান্দায় থেকে বা গলি দিয়ে বেরুবার পথে প্রতিদিন প্রতিবেশীর কুকুরের প্রবল চিৎকারের মুখে পড়তে হচ্ছে। আর তার প্রতিবাদ করলে শুনতে হচ্ছে, ও যাদের পছন্দ করবে না তাদের দেখে এমনটাই করবে। পোষা কুকুরকে ঘিরে এহেন অশালীন স্পর্ধাই তো ডায়ালিসিস রুম অবধি আমাদের বোধবুদ্ধিকে টেনে নিয়ে গিয়েছে।
সবুজ মুখোপাধ্যায়। কলকাতা-৩৯
তারাই বড় হয়ে
কী করে চুপ থাকা যায়, সেটা কী ভাবে শিখব? বিদ্যালয় প্রাঙ্গণের মধ্যেই যখন একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্ররা কোনও বিশেষ, নির্দিষ্ট পার্টির মদতে পুষ্ট হয়ে সহপাঠী বন্ধুদের উপরই গুন্ডামি করে, বহিরাগত পার্টির লোক এসে তাদের গুন্ডামি করার রাস্তা প্রশস্ত করে তোলে, তখন এক জন শিক্ষক হিসেবে যন্ত্রণা হয়। তাই প্রতিবাদ করে ফেলি।
ক্লাস ফাইভে এই ছাত্ররাই যখন পড়তে আসে তখন প্রথম দিন মায়ের আঁচল ছেড়ে একটু একটু করে আমাদের ভরসা করে বড় হয়। তখন নিষ্পাপ মুখে অবলীলায় বলে, ম্যাডাম, ক্লাসে যাব না? ক্রমাগত নালিশ করে বন্ধুদের বিরুদ্ধে। ম্যাডাম, ও আমার ব্যাগে হাত রেখেছে। ম্যাডাম, আমার জামায় দাগ দিয়ে দিয়েছে।
তার পর সেই কচি মুখের ভাষাগুলো বদলে যায়। কেউকেটার মতো ভাবভঙ্গিতে তারা আমাদেরই সামনে দিয়ে মুখে সামান্য অনুগত হওয়ার ভান করে আর পিছনে ‘দেখে নেব’ ভাব করে পাশ দিয়ে চলে যায়। আর বহিরাগতদের মদতে আমাদের প্রিয় ছাত্রদের উচ্ছৃঙ্খলতার প্রতিবাদ করার জন্য কোনও শিক্ষককে ক্লাস থেকে বের করে ছাত্রদের সামনেই নির্মম ভাবে মারা হয়, তখন যন্ত্রণা দলা পাকিয়ে গলায় আটকে যায়।
পরমা রায়চৌধুরী। অশোকনগর, উত্তর চব্বিশ পরগনা