কিন্তু মেলাবেন না। (বাঁ দিকে) দিল্লির আক্রান্ত নাগরিক, ১৯৮৪; (ডান দিকে) ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০২ নিহত এহ্সান জাফরির স্ত্রী জাকিয়া জাফরি, গুজরাত, ২০১২।
২০০২ সালের গুজরাত গণহত্যার প্রসঙ্গ উঠলেই নরেন্দ্র মোদীর সমর্থকরা ১৯৮৪ সালের দিল্লির শিখ নিধনের কথা টেনে আনছেন। যেন একটা অন্যায় দিয়ে অন্য অন্যায়ের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব! আর বলছেন, ২০০২ থেকে গুজরাত এগিয়ে এসেছে বারো বছর। গণহত্যার দাগ মুছে অনেকখানি পথ হেঁটে এসেছেন নরেন্দ্র মোদীও। কাজেই, গুজরাত গণহত্যার ইতিহাস এই ২০১৪ সালে হয় অবান্তর, নয়তো অন্য এক অন্যায়ের দ্বারা ‘ন্যায্যতা’য় অধিষ্ঠিত। এই দ্বিমুখী প্রচারের দুটো দিকই ইতিহাস আর রাজনীতির ধোপে টেকে কি না, এই লেখায় তা বিচার করার চেষ্টা করব।
‘বড় গাছ পড়লে মাটি তো কাঁপবেই’ আর ‘প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে’— নিতান্ত সাধারণ কানেও কথা দুটো খুব এক রকম বাজবে। মায়া কোডনানির সঙ্গে সজ্জন কুমার বা জগদীশ টাইটলারের কোনও ফারাকও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ২০০২ সালের গুজরাত পুলিশকে দেখলে ১৯৮৪ সালের দিল্লি পুলিশের কথা মনে পড়াও স্বাভাবিক— রাস্তায় যখন নিরীহ মানুষের গলায় জ্বলন্ত টায়ার ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে অথবা মাতৃগর্ভ থেকে বের করে আনা হচ্ছে ভ্রূণ, ১৮ বছরের ব্যবধানে দুই ক্ষেত্রেই পুলিশ নিস্পৃৃহ দর্শকমাত্র ছিল। ২০০২ সালের জন্য নরেন্দ্র মোদীকে ধিক্কার জানালে অতি অবশ্যই ১৯৮৪ সালের জন্য কংগ্রেসকে, রাজীব গাঁধীকেও সমান ধিক্কার জানাতেই হবে। দুই গণহত্যাই সমান ভাবে নিন্দনীয়, সমান লজ্জার।
সমান লজ্জার হলেও, দুটো ঘটনা অন্য মাপকাঠিগুলোয় সমান কি? যে বিদ্বেষ শেষ পর্যন্ত দাঙ্গায় পরিণত হয়, দুই ক্ষেত্রে তার চরিত্রে ফারাক ছিল কি? কংগ্রেস আদর্শগত ভাবে শিখ-বিদ্বেষী, এমন দাবি মাস্টার তারা সিংহও করেননি, জার্নেল সিংহ ভিন্দ্রানওয়ালেও নন। শিখ-কংগ্রেস যে বিরোধ, তা মূলত রাজনৈতিক। এক স্তরে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের উচ্চাবচতা কেন্দ্রিক বিরোধ, অন্য স্তরে অখণ্ডতার সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরোধ। সেই বিরোধ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকার দায় বহুলাংশে ইন্দিরা গাঁধীর, সঞ্জয় গাঁধীর, জৈল সিংহের। অকালি দলের আনন্দপুর সাহিব ঘোষণাপত্রের রাজনৈতিক মোকাবিলা না করে ভিন্দ্রানওয়ালে নামক ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দানব নির্মাণের দায় অস্বীকার করার কোনও রাস্তা কংগ্রেস খোলা রাখেনি। ফলে, আশির দশকের গোড়ার দিকে স্বতন্ত্র খালিস্তানের দাবিতে যে তুমুল হিংসা পঞ্জাবকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল, এবং যে হিংসা শেষ পর্যন্ত ১৯৮৪-র নভেম্বরে শিখ নিধনের রাস্তা খুলে দিল, তার রাজনৈতিক দায়ও বহুলাংশেই কংগ্রেসের।
কিন্তু সেই দায় কংগ্রেসের আদর্শের কারণে নয়, ভ্রান্ত রাজনীতির কারণে। বাংলাদেশ যুদ্ধের জয়ের জোয়ারে ভেসে কংগ্রেস আকালি দলের রাজনৈতিক দাবিকে কার্যত পাত্তা দেয়নি। তার পর জরুরি অবস্থার গা-জোয়ারিতে ধামাচাপা দিতে চেয়েছে সব অসন্তোষকে। এই ভুলগুলো, অন্যায়গুলো সংশোধন করা যেত। প্রাদেশিক ক্ষমতা বৃদ্ধির দাবিকে প্রাপ্য গুরুত্ব দিলে হয়তো এড়ানো যেত বিচ্ছিন্নতাবাদী দাবি। কিন্তু কংগ্রেসের যে সিদ্ধান্তগুলি শেষ অবধি দাঙ্গা ডেকে এনেছিল, তার মূলে ছিল, আদর্শবাদ নয়, রাজনৈতিক ঔদ্ধত্য। এখানেই বিজেপি-র সঙ্গে, ২০০২ সালের সঙ্গে কংগ্রেসের, ১৯৮৪ সালের ফারাক।
যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের গর্ভে বিজেপি-র জন্ম, এবং এখনও বিজেপি মূলত যে রাজনৈতিক আদর্শ বহন করে চলেছে, তা হিন্দু জাতীয়তাবাদের। এর এক দিকে আছে হিন্দুত্বের ‘অতীত গৌরব’ জাগিয়ে তোলার দুর্মর আকাঙ্ক্ষা, অন্য দিকে ইসলামি সংখ্যালঘুদের প্রতি ‘ভয়’। এবং সেই ভয়কে জয় করার অস্ত্র হল সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম আর রাষ্ট্রকে এক করে দেখার প্রবণতা। হিন্দুদের বাইরে যে ‘অপর’, তার প্রতি আপসহীন বিদ্বেষই হিন্দু জাতীয়তাবাদের সার। এই আদর্শগত কারণেই বিজেপি কংগ্রেসের থেকে আলাদা। ১৯৩০-এর দশক থেকে— যখন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের নেতারা হিন্দুত্বের সঙ্গে ভারতীয়ত্বের সুতো বাঁধতে ব্যস্ত ছিলেন— কংগ্রেস ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা থেকে সচেতন ভাবে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে বাদ রেখেছিল। নেহরুর দৃষ্টিভঙ্গিতে জাতি ছিল জাত-ধর্ম-বর্ণের পরিচয়হীন ব্যক্তিমানুষের সমষ্টি। আর গাঁধী জাতি বলতে বুঝেছিলেন বিভিন্ন ধর্মের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, কিন্তু কোনও সংজ্ঞাতেই সেই জাতির ধারণার মধ্যে এক ধর্মের চেয়ে অন্য ধর্মের উচ্চতর অবস্থানের প্রশ্ন ছিল না। এখানেই কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদের ধারণা হিন্দুত্ববাদীদের জাতীয়তাবাদের ধারণার চেয়ে প্রবল ভাবে আলাদা; দ্বিতীয় দল আদর্শগত ভাবে চেয়েছিল, সংখ্যালঘুরা হিন্দুত্বকেই শ্রেয় বলে স্বীকৃতি দিক, এবং বড় জোর দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে থেকে যাক ভারতে।
১৯৮৪ সালের শিখ নিধন আর ২০০২ সালের গুজরাত গণহত্যাকে এই প্রেক্ষিতে দেখলে স্পষ্ট হবে, কেন দুটো ঘটনাই সমান নিন্দনীয় হওয়া সত্ত্বেও সমতুল নয়। বিজেপি যে ভাবে মুসলমান বিদ্বেষের ঐতিহ্য বহন করে এসেছে, কংগ্রেস তা কখনও করেনি। ফলে ১৯৮৪ সালের শিখ নিধন, তা যতই নিন্দনীয় হোক না কেন, তাকে কংগ্রেসের কোনও আদর্শের প্রতিফলন হিসেবে দেখা মুশকিল। এই দাঙ্গাকে রাজধর্ম থেকে ভয়াবহ বিচ্যুতি বললে ঠিক হয়। কিন্তু ২০০২ সালের গুজরাত দাঙ্গায় বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ভূমিকায় একটি উত্তরাধিকারের ছাপ স্পষ্ট। হিন্দু জাতীয়তাবাদের আদর্শগত উত্তরাধিকার। বাজপেয়ী যতই বলুন, একে কেবল রাজধর্ম পালনে ব্যর্থতা বলে চালানো মুশকিল। ১৯৮৪ সালে কংগ্রেসের ভূমিকা আর ২০০২ সালে বিজেপি-র ভূমিকার মধ্যে ফারাক হল— প্রথমটি আদর্শ এবং রাজধর্ম থেকে বিচ্যুতি, দ্বিতীয়টি আদর্শের পথে অবিচল থাকা।
শুধু ইতিহাসের প্রশ্ন নয়। অনেকেই বলেন বিজেপি নিজেকে বারে বারে বদলেছে। কিন্তু ঘটনা হল, সে হিন্দুত্ববাদের ছাতাটি ছাড়েনি। জনতা জোট ভেঙে বেরিয়ে ফের ভারতীয় জনসঙ্ঘ তৈরি করার বদলে দলনেতারা তৈরি করেছিলেন ভারতীয় জনতা পার্টি— এক দিকে জনতা জোটের নৈতিক গ্রহণযোগ্যতায় নিজেদের দাবি বজায় রাখতে, অন্য দিকে জনসঙ্ঘের ‘সাম্প্রদায়িক’ পরিচয় মুছে ফেলতে। তাঁদের রাজনীতির ধারাতেও বদল এসেছিল। হিন্দুত্ববাদের চেয়ে তুলনায় বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রশ্ন। অবশ্য এটা একেবারে নতুন পথ ছিল না। জনসঙ্ঘও এক সময় ‘গাঁধীবাদী সমাজতন্ত্রের’— সে শব্দবন্ধের অর্থ যা-ই হোক না কেন— পথে হাঁটার কথা বলেছিল। কিন্তু সমস্যা হল, জনসঙ্ঘের মতোই, বিজেপিও একটা যথার্থ স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল হয়ে উঠতে পারেনি। ১৯৮০’র জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত দলের সুতো বাঁধা থেকেছে সঙ্ঘ পরিবারের হাতেই। বার বারই সংঘাত হয়েছে, কিন্তু এখনও অবধি শেষ হাসির অধিকার কখনও পরিবারের হাতছাড়া হয়নি। কাজেই, সঙ্ঘ পরিবারের অতীত ও বর্তমানকে বাদ রেখে বিজেপি-র রাজনীতি বোঝা সম্ভব নয়। এবং সেই ইতিহাস বলবে, ২০০২ সালের গণহত্যাকে ভুলে যাওয়া যায়, এমন পরিস্থিতি এখনও বিজেপি তৈরি করতে পারেনি।
আদৌ পারবে কি না, ২০১৪ সালে প্রশ্নটা ক্রমেই বড় হচ্ছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্নচিহ্নের নাম নরেন্দ্র মোদী। যে হিন্দু জাতীয়তাবাদের সঙ্গে প্রকাশ্যে একটা দূরত্ব তৈরি করতে বিজেপি নেতৃত্ব বহু কালক্ষেপ করেছে, মোদী তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে জানিয়েছেন, তিনি ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদী’। উন্নয়নের গল্প দূরে ঠেলে এখন তাঁর প্রতিটি জনসভায় নির্ভুল ভাবে উঠে আসছে হিন্দুত্বের চিহ্নগুলো। যে ভাবে হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণের স্বপ্ন দেখতেন বিনায়ক দামোদর সাভারকর, মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর, সেই পথের প্রায় সব দিকচিহ্নকেই ফিরিয়ে আনছেন মোদী। ক্ষমতায় এলে তিনি কোন পথে হাঁটতে পারেন, তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। তাঁকে দেখলে অনেকেরই যদি বুক কাঁপে, যদি ভয় হয় যে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের ওপর এক বিপুল আঘাত হানছেন এবং হানবেন তিনি, খুব দোষ দেওয়া যায় কি?