সাংবাদিকতা এবং গণজ্ঞাপনের পড়ুয়ারা পড়াশোনার সময় হাতে কলমে কাজ শেখার সুযোগ পেয়ে থাকেন। নিজস্ব চিত্র।
সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে হয়। এ ক্ষেত্রে কী ভাবে কথা বলতে হবে, কী ভাবে একটি তথ্যকে খবরের আঙ্গিকে লিখতে হবে— সেই সমস্ত বিষয়গুলি থিয়োরি আকারে শেখানো হয়ে থাকে। পাশাপাশি, বইয়ের বাইরের জীবনে সাংবাদিকতার পড়ুয়ারা কী ভাবে কাজ করবেন, কী ভাবে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি অনুযায়ী খবরের গুরুত্ব অনুযায়ী তথ্য সংগ্রহ করবেন, তা শেখার উপরও জোর দেওয়া হয়ে থাকে। স্নাতকোত্তর স্তরে সোশাল কিংবা কমিনিউটি আউটরিচ-এর কাজ করতে হত। বর্তমানে জাতীয় শিক্ষানীতি, ২০২০ অনুযায়ী, স্নাতক স্তরের পড়ুয়াদেরও বিষয়টি নিয়ে চর্চা করতে হয়।
সোশ্যাল কিংবা কমিনিউটি আউটরিচ কী?
কোনও জনগোষ্ঠী এলাকায় গিয়ে তাদের কোনও বিশেষ সমস্যা এবং তার সমাধানের পথ খুঁজে বার করার চেষ্টা করেন সাংবাদিকতা এবং গণজ্ঞাপনের শিক্ষার্থীরা। এ ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহ, স্কুলছুট থেকে শুরু করে সাইবার অপরাধ, অনলাইন ব্যাঙ্কিং পরিষেবার সুবিধের মতো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজের সুযোগ রয়েছে। তবে, কাজটি দলবদ্ধ ভাবে (প্রতিটি দলে আট থেকে ১০ জন থাকা আবশ্যক) সম্পূর্ণ করতে হবে। কাজ শেষ হওয়ার পর রিপোর্ট আকারে পেশ করা হয়ে থাকে।
সাইবার প্রতারনা সংক্রান্ত বিষয়ে স্থানীয়দের বোঝাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা। — ফাইল চিত্র।
সাংবাদিকতার পাঠ গ্রহণে কেন গুরুত্বপূর্ণ?
সংবাদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথোপকথনের পাশাপাশি, স্থানীয় এলাকার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা আবশ্যক। এ ছাড়াও স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারলে ভবিষ্যতে কাজের ক্ষেত্রেও তা লাভজনক হতে পারে। সবটাই সোশ্যাল বা কমিউনিটি আউটরিচের মাধ্যমে করা সম্ভব।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা এবং গণজ্ঞাপন বিভাগের অধ্যাপক রাজেশ দাস জানিয়েছেন, এলাকাভিত্তিক সমস্যা নিয়ে পাঠরত অবস্থায় কাজ করতে পারলে কথোপকথনেও সাবলীল হয়ে ওঠার সুযোগ রয়েছে, যে দক্ষতা সাংবাদিকতা এবং গণজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে থাকা আবশ্যক। এই ধরনের আউটরিচ প্রোগ্রাম থেকেই জানা গিয়েছে, গ্রামে তো বটেই, শহরের স্কুলগুলিতেও বাল্যবিবাহ কিংবা অল্পবয়সে মা হয়ে ওঠার প্রবণতা রয়ে গিয়েছে। তা রুখতে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকাদেরও পথে নামতে হচ্ছে।
মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজের সাংবাদিকতা ও গণজ্ঞাপন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক বিশ্বজিৎ দাস জানিয়েছেন, পুথিগত জ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগের কথা ভেবেই এই কো কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিগুলিকে সাজানো হয়ে থাকে। সামাজিক সমস্যার সমাধান, এবং সেই বিষয়টি নিয়ে লাগাতার সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা— এই সমস্তটাই শিক্ষার্থীদের পরবর্তী পর্যায়ের জন্য দক্ষ করে তুলবে। স্নাতক স্তরেই বিষয়টি আসায় তাঁরা স্থানীয় এলাকার সমস্যা নিয়ে অনেক বেশি ওয়াকিবহাল থাকার সুযোগ পাবেন।
বাল্যবিবাহ কিংবা অল্পবয়সে মা হয়ে ওঠার কারণে কী সমস্যা হতে পারে, তা নিয়ে স্কুলছাত্রীদের বিশেষ আঙ্গিকে বোঝাচ্ছেন স্নাতকোত্তর স্তরের পড়ুয়ারা। নিজস্ব চিত্র।
রাজ্যের কোথায়, কেমন কাজ হয়?
মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজের সাংবাদিকতা ও গণজ্ঞাপন বিভাগের তরফে ২০২৫-এ শান্তিনিকেতনের সোনাঝুরির হাটের বিক্রেতা এবং ক্রেতাদের নিয়ে একটি কমিউনিটি আউটরিচ প্রোগ্রাম করা হয়েছে। তাতে বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে ওই হাটকে কেন্দ্র করে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, খাদ্যাভাস, ব্যবসার প্রেক্ষাপটে প্রভাব নিয়ে কাজ করেছেন স্নাতক স্তরের পড়ুয়ারা। পড়ুয়াদের নিয়ে পরবর্তী কালে স্থানীয় হাটের ব্যবসায়ীদের নিয়েও কাজ করার পরিকল্পনাও রয়েছে।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণজ্ঞাপন বিভাগের তরফে ২০২৩ থেকে ন্যাশনাল সোশ্যাল সার্ভিস (এনএসএস) এবং স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় পথনাটিকার মাধ্যমে সাইবার অপরাধ ও আইন, স্কুলছুট এবং তার নেপথ্যে বাল্যবিবাহ, কিশোর বয়সে গর্ভধারণ সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে একাধিক কমিউনিটি আউটরিচ আয়োজন করা হয়েছে। বিভাগের চতুর্থ সেমেস্টারের আট থেকে ১০ জনের একটি দল জেলার বিভিন্ন স্কুলগুলি এবং গ্রাম থেকে শহরের বিভিন্ন এলাকায় উল্লিখিত বিষয় নিয়ে পথনাটিকার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করেছে।
সরকারি সহায়তা:
স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে সাংবাদিকতা এবং গণজ্ঞাপন বিভাগের পড়ুয়ারা সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি, স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতাও পেয়ে থাকেন। সে ক্ষেত্রে তাঁরা কী ভাবে কাজ করতে চাইছেন, তার জন্য আগে থেকে সরকারি আধিকারিকের অনুমতি নেওয়াও প্রয়োজন।
সাংবাদিকতা এবং গণজ্ঞাপনের পাঠক্রম জনসাধারণের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের বাস্তবপ্রয়োগে বেশি জোর দিয়ে থাকে। — ফাইল চিত্র।
পূর্ব বর্ধমানের জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক রামশঙ্কর মণ্ডল জানিয়েছেন, স্কুলছুটের মতো সমস্যা রুখতে জেলাস্তরের প্রশাসনের তরফে অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত ভাবে আলোচনা করা হয়ে থাকে। তবে, এই ধরনের উদ্যোগকেও প্রশাসন সবসময় উৎসাহ দিয়ে থাকে। তাই, পড়াশোনার বাইরেও কেউ যদি নিয়মিত ভাবে কাজ করতে চান, সে ক্ষেত্রে তাঁরা প্রশাসনের নির্দিষ্ট দফতরে নিজেদের পরিকল্পনা জানানোরও সুযোগ পাবেন।
সাংবাদিকতা এবং গণজ্ঞাপনের পাঠক্রম জনসাধারণের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের শিক্ষা দেয়। কিন্তু সেই শিক্ষার ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ কোন কোন পদ্ধতিতে করা যেতে পারে, সেই সমস্ত অভিজ্ঞতা কমিউনিটি বা সোশ্যাল আউটরিচের মাধ্যমে গ্রহণ করার সুযোগ থাকে। কমিউনিটি আউটরিচের মাধ্যমে পথনাটিকার সংলাপ বা পোস্টারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছবি আকারে সাজিয়ে জনসাধারণকে সচেতন করা এবং তাঁরা কেমন প্রতিক্রিয়া দিলেন, তা পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে নিজেদের সংযোগবৃদ্ধির সুযোগ শিক্ষার্থীরা পেয়ে থাকেন। এতে ভবিষ্যতে পেশায় প্রবেশের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।