Professor Ishan Chakraborty

পড়া নয় শুধু কানে শোনা! বাধা পেরিয়ে বহু পড়ুয়ার অনুপ্রেরণা যাদবপুরের শিক্ষক ঈশান চক্রবর্তী

সিনেমা দেখে বুঝিয়ে দিতেন মা। সকলের জন্য এই বুঝিয়ে দেওয়ার কাজটিই করতে চান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৯:২৭
Share:

যাদবপুরের শিক্ষক ঈশান চক্রবর্তী। নিজস্ব চিত্র।

বইয়ের পাতা থেকে কালো অক্ষরগুলি ঝাপসা হতে হতে মিলিয়ে গিয়েছে এক সময়। কিন্তু তাতে ম্লান হয়ে যায়নি স্বপ্ন। নিরন্তর চলার মধ্য দিয়েই লক্ষ্যে পৌঁছতে চান তিনি। ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করছেন। পড়ুয়াদের মধ্যে তৈরি করছেন নতুন আদর্শ। দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা যে লক্ষ্য পূরণের পথে বাধা হতে পারে না, প্রমাণ করে দিচ্ছেন। তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ঈশান চক্রবর্তী।

Advertisement

প্রশ্ন: পৃথিবী অনেক বদলে গিয়েছে, প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে। এই যে প্রতিবন্ধকতা, সে ক্ষেত্রে কি খানিক সাহায্য হচ্ছে?

ঈশান: অবশ্যই। আমি নিজেও সেই সাহায্য পেয়েছি। প্রযুক্তির সাহায্যেই তো শ্রাব্য (অডিয়ো) মাধ্যমে পড়াশোনা করেছি। আজ সেই প্রযুক্তি আরও এগিয়ে চলেছে। আমিও চাইছি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছু কাজ করে যেতে।

Advertisement

প্রশ্ন: কী কাজ করতে চান?

ঈশান: অনেকগুলি গবেষণার কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছি এই মুহূর্তে। বেশ কিছু পুরনো সিনেমার অডিয়ো বর্ণনার কাজ করছি। যাঁরা দেখতে পান না, তাঁরা শুনতে পাবেন। বুঝতে পারবেন কেমন হচ্ছে সেই ছবি। আমি চেষ্টা করছি এমন ভাবে প্রকাশ করতে, যাতে সকলে বুঝতে পারেন। তা ছাড়া, বাংলা ভাষায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষেরা কতটা ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবেন— এই বিষয় নিয়েও কাজ চলছে।

প্রশ্ন: সিনেমা দেখতে খুব ভালবাসেন না কি?

ঈশান: ‘দেখতে ভালবাসি’! আমার জন্য এটা খুবই অদ্ভুত কথা। আমি তো দেখতেই পাই না। কিন্তু আমি সিনেমা দেখি। ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’, ‘সিতারে জ়মিন পর’— সব ‘দেখেছি’। আসলে আমি শুনেছি। তবে আমি আজও জানি না শাহরুখ খান বা আমির খানের মুখের আদল কেমন! কণ্ঠস্বরের মাধ্যমেই দুনিয়াটা দেখি আমি।

প্রশ্ন: এই প্রতিবন্ধকতা কি একেবারে জন্মগত?

ঈশান: না। ছোটবেলায় আমি দেখতে পেতাম। তবে, দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ ছিল। ১৯ বছর বয়সের পর সম্পূর্ণ ভাবেই অন্ধকার হয়ে গেল চার দিক। তবে হাল ছাড়িনি।

প্রশ্ন: কী হল হঠাৎ ওই বয়সে?

ঈশান: জন্ম থেকেই দুই চোখে কর্নিয়াল অস্বচ্ছতা ছিল। অনেক চিকিৎসা করেও তেমন সুরাহা হয়নি। যখন আমার ১৯ বছর বয়স, তখন ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে থাকলাম দৃষ্টিশক্তি আরও ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। আগামী দিনে যে আর কিছুই দেখতে পাব না, তা তখনই বুঝতে পারি।

প্রশ্ন: তা হলে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে কী ভাবে এগোলেন?

ঈশান: আমার মা এগিয়ে নিয়ে গেলেন আমায়। গল্পের মতো করে সব পড়ে পড়ে শোনাতেন। আমি শুনে মনে রাখতাম। তা-ই লিখতাম পরীক্ষায়। আগে যখন অল্প দেখতে পেতাম, সে সময় আতস কাচের সাহায্যে অক্ষরগুলি বুঝতাম। সে সময় জানলার পাশে বসে পরীক্ষা দিতাম যাতে বেশি আলো পাই। স্কুলে ব্ল্যাক বোর্ড সামনের বেঞ্চে বসেও দেখতে পেতাম না, একেবারে বোর্ডের সামনে দাঁড়াতে হত।

প্রশ্ন: স্নাতকোত্তর, পিএইচডি, নেট বা সেট-এর মতো বিষয়ে কখনও বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে?

ঈশান: হ্যাঁ সমস্যা তো হয়েছেই। দৃষ্টিহীনতার থেকেও বেশি সমস্যা হয়েছে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে। অনেক সময়ই ভেঙে পড়েছি। কিন্তু ফের ঘুরে দাঁড়িয়েছি। আসলে পড়াশোনার করার ইচ্ছে ছিল বরাবর। তাই হয়তো প্রতিটি স্তরই পেরোতে পেরেছি। দশম-দ্বাদশের সময় খানিকটা দৃষ্টিশক্তি ছিল। ওই পরীক্ষাগুলি দিয়েছি নিজে লিখেই। পরবর্তীকালে ‘রাইটার’ নিতে হয়েছে।

প্রশ্ন: ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়েছেন কখনও?

ঈশান: না আমি সেই অর্থে ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়াশোনা করিনি। তবে পড়তে জানি। আমি মূলত অডিয়ো শুনে শুনেই পড়াশোনা করেছি। এখন অবশ্য, কম্পিউটারের কি-বোর্ডের লেআউট আমার মুখস্থ।

প্রশ্ন: সে কারণেই কি কণ্ঠস্বরের প্রতি আলাদা দুর্বলতা?

ঈশান: হ্যাঁ, অধ্যাপনার আগে তো আমার স্বপ্ন ছিল বেতার উপস্থাপক হওয়ার। আকাশবাণী বা অন্য অনেক বেসরকারি চ্যানেলে আমি অডিশনও দিয়েছিলাম। পরীক্ষায় পাশ করলেও শেষ পর্যন্ত সে সব চাকরি পাইনি। কারণ কলকাতার রেডিয়ো চ্যানেলগুলি এত উন্নত নয়, যেখানে একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ‘আরজে’ কাজ করতে পারেন। তাই আমার সে স্বপ্ন অধরাই থেকে গিয়েছে।

প্রশ্ন: তার পরই মন দিলেন অধ্যাপনা বিষয়ে?

ঈশান: পড়ানোটা আমারা দ্বিতীয় পছন্দ ছিল। তাই এ পথে আমাকে এগোতেই হত। আর আমার মতো মানুষের জন্য এটা খানিক সহজও ছিল। তবে এখানেও কণ্ঠের প্রয়োজন। আমার ছাত্র-ছাত্রীরাও তো আমার গলা শুনেই পড়া বোঝেন। সমস্ত শিক্ষকের ক্ষেত্রেই এটা সত্য।

প্রশ্ন: কিন্তু স্মার্ট ক্লাসের ক্ষেত্রে কী ভাবে সবটা ব্যবস্থা করেন?

ঈশান: ওই যে অডিয়ো বর্ণনা। আমি যাঁদের ক্লাস নিই তাঁরা তো দৃষ্টিহীন নয়, তাই আমি অডিয়ো বর্ণনা দিই। তা ছাড়াও বিভিন্ন রকমের প্রকল্পের কাজ দিই। এ সবের মধ্য দিয়ে ওদের মধ্যেও দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষ সম্পর্কে একটা সচেতনতা তৈরি হয়। না হলে পৃথিবী শুধু সহানুভূতি দেখায়— ‘ইস’, ‘আহা রে’।

প্রশ্ন: পড়াশোনায় মা সাহায্য করেছেন, আর বন্ধুবান্ধব?

ঈশান: বড় হয়েছি মা এবং বাবার সান্নিধ্যে। কিন্তু আর পাঁচটি পরিবারে যেমন হয়, বাবা ততটা সময় দিতে পারতেন না। তাঁর কাজ থাকত। তাই মা-ই আমার সবচেয়ে নিকট বন্ধু। সিনেমা দেখতে যাওয়া, ঘুরতে যাওয়া সবেতেই মা। আমাকে সব সিনেমা বুঝিয়ে দিতেন, এমনকি ঘনিষ্ঠ দৃশ্যও। স্কুলে আমার কোনও বন্ধু ছিল না। তবে বড় হওয়ার পর আমার অনেক বন্ধু হয়েছে। এমন বন্ধু যাঁরা আমায় করুণার চোখে দেখেন না!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement