বাংলা ভাষার মার্ধুযের খোঁজে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতীকী চিত্র।
ভাষা বহতা নদীর মতো। সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন আসে, এক ভাষায় গৃহীত হয় অন্য ভাষার শব্দ। পলিমাটির মতো সেই সব শব্দ সমৃদ্ধ করে যে কোনও ভাষাকে। এই বহমানতা না থাকলে ভাষার মৃত্যু ঘটে। এমনই মনে করা হয় তাত্ত্বিক ভাবে।
কিন্তু বিজাতীয় শব্দের ভারেও অনেক সময় ভাষার নাভিশ্বাস উঠতে পারে। গত কয়েক বছরে বাংলার অবস্থাও তেমনই হচ্ছে বলে অভিযোগ। বাঙালি শিশুর কাছে ক্রমশ গুরুত্ব হারাচ্ছে তার মাতৃভাষা। তরুণ প্রজন্মও স্বচ্ছন্দ বোধ করছেন কেতাদুরস্ত কিছু শব্দের নিত্য ব্যবহারে। যার সঙ্গে ধ্রুপদী বাংলার সাদৃশ্য খুঁজতে যাওয়া বিড়ম্বনার তো বটেই! তার উপর রয়েছে সমাজমাধ্যম। সেখানে বাংলা ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষার বিষয়ে আদৌ কেউ আগ্রহী বলে মনেই হয় না। বিজ্ঞাপনের ভাষাতেও এসেছে বেদনাদায়ক পরিবর্তন। ধারাবাহিক এমনকি সংবাদ পরিবেশনও উপযুক্ত শব্দ চয়নের অভাব লক্ষ করা যায় হামেশাই।
কিন্তু এই সব অভাব অভিযোগ করে কী লাভ, কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে বাংলা ভাষা? তা নিয়েই চর্চায় কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষার কর্মশালায় উপস্থিত বিশেষজ্ঞরা। নিজস্ব চিত্র।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সুখেন বিশ্বাস জানিয়েছেন, ধ্রুপদী তকমা পাওয়ার পরও বাংলা ভাষার শব্দ বিকৃতি কমেনি। কী ভাবে এই ভাষা প্রভাবিত হয়ে চলেছে, তা নিয়েই পাঁচ দিনের একটি কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। তবে শুধু আলোচনাতেই বিষয়টি সীমাবদ্ধ থাকছে না।
কর্মশালার প্রথম দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কল্লোল পাল বলেন, পেশা, অঞ্চল, বৈচিত্র্যের ভিত্তিতে ‘আ-মরি বাংলা ভাষা’র পরিবর্তন হয়েছে। তবে, তার সৌন্দর্যের বিষয়টির সন্ধানই এই চর্চার সার্থকতা। ৪ জুলাই পর্যন্ত এই কর্মশালাতে বাংলা ভাষার মাধুর্য এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে তার বিস্তার, সংবাদমাধ্যমে প্রথাগত ভাষা চর্চার পদ্ধতি, প্রযুক্তির হাত বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি এবং দৈনিক কথোপকথনের ক্ষেত্রে ভাষার সচেতন প্রয়োগ নিয়ে চর্চা করবেন বিশেষজ্ঞরা।
শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার জানিয়েছেন, গতানুগতিক কাজের বাইরে সাংবাদিকতা, বিজ্ঞাপন, এমনকি কম্পিউটার নির্ভর চাকরির ক্ষেত্রেও বাংলা ভাষা প্রয়োগের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। প্রয়োগের ক্ষেত্রে সেই ভাষার শব্দচয়ন সুন্দর হওয়া প্রয়োজন এবং প্রাসঙ্গিক।
কর্মশালায় সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের প্রাক্তন অধ্যাপক পলাশ বরন পাল, ‘ইনস্টিটিউট অফ ল্যাঙ্গুয়েজ স্টাডিজ় অ্যান্ড রিসার্চ’-এর অধিকর্তা স্বাতী গুহ, আইএসআই কলকাতার লিঙ্গুইস্টিক রিসার্চ ইউনিটের বিভাগীয় প্রধান নীলাদ্রী শেখর দাস, সাহিত্যিক সিজ়ার বাগচি-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের ভাষা বিশেষজ্ঞরা আলোচনায় যোগ দেবেন। আগ্রহীরা কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই কর্মশালার আলোচনায় যুক্ত হতে পারবেন।
অতুলপ্রসাদ সেনের ‘মোদের গরব মোদের আশা গান’ গেয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন ছাত্রছাত্রী এবং গবেষকরা। নিজস্ব চিত্র।
২০২৪-এর অগস্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তরফে ধ্রুপদি বাংলা ভাষার প্রয়োগ পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছিল। তাতে লোকমুখে প্রচলিত বেশ কিছু শব্দ এবং শব্দবন্ধের তালিকা প্রকাশ্য আসে। তার মধ্যে ‘বাওয়াল’ ছাড়াও রয়েছে ‘ফান্ডা’, ‘বিন্দাস’, ‘রকেট’, ‘চম্পা’, ‘চুলবুলি’, ‘লুল্লুরি’, ‘পিরিত’ বা ‘ইন্টুমিন্টু’, ‘জোশ’, ‘খাপ বসানো’-র মতো একাধিক শব্দ।
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি যে সমস্ত ভাষায় কথা বলা হয়, তার তালিকায় বাংলার স্থান হল পঞ্চমে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পৃথিবীতে প্রায় পঁচিশ কোটি মানুষ বাংলা ভাষা জানেন। কিন্তু ধ্রুপদি ভাষার চর্চায় বদল এসেছে অনেক। বিশ্বমানের গৌরবের পর কি সেই রদবদলের ছবিটা বদলাবে, উত্তর খুঁজতে আগামী দিনে প্রচলিত শব্দ এবং শব্দবন্ধ নিয়ে বিশেষ শব্দকোষ তৈরির পরিকল্পনা করছে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।