স্কুলশিক্ষকদের গৃহশিক্ষকতায় আপত্তি নেই বহু অভিভাবকদেরই। — ফাইল চিত্র।
স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশোনার সঙ্গে গৃহশিক্ষকতাও করেন অলিভিয়া সাহা। সদ্য শেষ হয়েছে সপ্তম শ্রেণির পড়ুয়াদের পরীক্ষা। ফলাফল জানতে গিয়ে হঠাৎ তিনি জানতে পারলেন, কাল থেকে তাঁকে আর পড়াতে আসতে হবে না। কারণ কাল থেকে স্কুলের স্যারের কাছে তাঁর ছাত্রী পড়তে যাবে। যুক্তি, স্কুলের স্যারের প্রাইভেটে পড়লে বেশি নম্বর পাওয়া যায়।
অথচ, সরকারি নিয়ম এবং ‘রাইট অব চিল্ড্রেন টু ফ্রি অ্যান্ড কম্পালসারি এডুকেশন অ্যাক্ট’, ২০০৯ অনুযায়ী, সরকার অধীনস্থ স্কুলগুলিতে কর্মরত কোনও শিক্ষক গৃহশিক্ষকতা বা কোনও রকম কোচিং সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবেন না। এমনকি বিনা পারিশ্রমিকে কোথাও ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ানোর কাজ থেকেও তাঁদের বিরত থাকতে হবে।
এ জন্য রাজ্যের স্কুল শিক্ষা দফতরের তরফে সরকার-নিয়ন্ত্রিত স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের থেকে মুচলেকাও আদায় হয়েছে, কোনও ভাবেই তাঁদের স্কুলের শিক্ষকেরা প্রাইভেট টিউশন করেন না। ২০২৩ এবং ২০২৪-এ বেশ কিছু স্কুলের শিক্ষকদের নামের তালিকাও প্রকাশ করা হয়েছিল এবং তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নিয়েছিল মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। কিন্তু তাতে কি স্কুলশিক্ষকদের গৃহশিক্ষকতা বন্ধ হয়েছে?
অভিযোগ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নাম গোপন করেই গৃহশিক্ষকতা করছেন বহু সরকারি স্কুলের শিক্ষক। — ফাইল চিত্র।
বাস্তব ছবিটা একেবারেই উল্টো। অভিযোগ, শহর এবং শহরতলির বড় বড় সরকারি এবং সরকারপোষিত স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা রমরমিয়ে গৃহশিক্ষকতার ‘দরবার’ চালাচ্ছেন। কারণ স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাই প্রশ্ন তৈরি করছেন। নম্বর দেওয়াটাও তাঁদেরই হাতে। যার সুবাদে স্কুলের উল্টোদিকেই স্কুলের স্যারের কোচিং সেন্টারের কৌশলী বিজ্ঞাপন পড়ছে। যাঁরা বিজ্ঞাপন সাঁটাচ্ছেন, তাঁদের জিজ্ঞেস করতেই উত্তর আসে, স্যার-ই বলেছেন ‘স্কুলের সামনে বেশি করে পোস্টার সাঁটাবি, অভিভাবকদের চোখে পড়বে।’ কিন্তু বিজ্ঞাপনে স্কুলের নাম বা স্যারের নাম লেখা নেই। সবটাই ধাঁধার মত।
অভিভাবকদের একাংশের অভিযোগ, স্কুলের একাংশ ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবক মহলের সমর্থনের জেরেই ওই দরবারে হাজিরা স্কুলের থেকেও বেশি। যাঁরা ওই কোচিং-এ হাজিরা দিতে পারে না, সেই সমস্ত পড়ুয়ারা পরীক্ষায় কম নম্বর তো পাচ্ছেই, উপরন্তু কটূক্তিও শুনতে হচ্ছে।
অভিভাবকরা এ নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন স্কুলের প্রধানশিক্ষকদেরও। কিন্তু তাঁরা বলছেন অন্য কথা। যাদবপুর বিদ্যাপীঠের প্রধানশিক্ষক পার্থপ্রতিম বৈদ্য জানিয়েছেন, স্কুলের হাত-পা বাঁধা। তাঁর কথায়, “কে কী ভাবে নিয়ম ভাঙছেন, তা নিয়ে কানাঘুষো শুনলেও প্রমাণের অভাবে পদক্ষেপ করা সম্ভব নয়।” যোধপুর পার্ক বয়েজ়ের প্রধানশিক্ষক অমিত সেন মজুমদারের আরও দাবি, “মধ্যশিক্ষা পর্ষদ, স্কুল শিক্ষা দফতরের নির্দেশিকা অমান্য করার অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা আগেও নেওয়া হয়েছিল। এতেও পরিস্থিতি বদলায়নি। এতে সামাজিক স্তরে শিক্ষকতার ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।”
অবশ্য এই বিষয়ে যে সমস্ত অভিভাবকরা ‘সমর্থন’ জানাচ্ছেন, তাঁদের দাবি, বাড়ির কাছেই স্কুলের স্যার ম্যাডামরা থাকেন। তাঁরা ক্লাসের পর আলাদা করে সবই নোট করে দেন, এতে বাচ্চাদেরও সুবিধা হয়। আলাদা করে প্রাইভেট টিউশনির খরচ টানার থেকে এই ব্যবস্থাই ভাল।
মধ্যশিক্ষা পর্ষদ কি এই অভিযোগ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল? পর্ষদের তরফে অবশ্য জানানো হয়েছে, এখনও পর্যন্ত প্রতিটি শিক্ষাবর্ষে স্কুলশিক্ষকদের গৃহশিক্ষকতা সংক্রান্ত সমস্ত অভিযোগ খতিয়ে তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সমস্ত জেলার স্কুল পরিদর্শক (ডিআই)-রা তদন্ত করে যে রিপোর্ট জমা দিয়েছেন, তার ভিত্তিতেই সমস্ত বিষয়টি খতিয়ে দেখা হয়। উল্লেখ্য, এই ধরনের অভিযোগের ক্ষেত্রে অপরাধের ভিত্তিতে লিখিত ভাবে ভর্ৎসনা থেকে শুরু ‘ইনক্রিমেন্ট’ বন্ধ করা (প্রতি বছর নির্দিষ্ট অঙ্কে বেতনবৃদ্ধি)-র মতো একাধিক শাস্তি আরোপের বিধি রয়েছে।
স্কুলের পড়াশোনার উপর একেবারেই আস্থা নেই, সেই তত্ত্বও নাকচ করেছেন সরকারি স্কুল শিক্ষকদের একাংশ। — ফাইল চিত্র।
কিন্তু সব খতিয়ে দেখার পরও এই পরিস্থিতি কেন? যেখানে রাজ্যের বেকার যুবক-যুবতীদের একাংশ গৃহ শিক্ষকতার উপর নির্ভরশীল, সেখানে স্কুলশিক্ষকদের গৃহশিক্ষকতার জেরে তাঁদের আয়ের পথ সংকীর্ণ হয়ে উঠছে বলেই বারবার অভিযোগ করা হচ্ছে। এতে মেধার উৎকর্ষ তলানিতে গিয়ে ঠেকছে, এমনটাই মনে করছেন আসানসোলের হীরাপুর মানিকচাঁদ ঠাকুর ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষিকা নিবেদিতা আচার্য। তাঁর কথায়, “গৃহশিক্ষকতার লোভে স্কুলের পঠনপাঠন ব্যাহত করছেন অনেক স্কুলশিক্ষকই। পড়াশোনা এখন নোট আর সাজেশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে। কড়া আইন জারি করে নিয়মিত নজরদারি করতে পারলে সমস্যার সমাধান সম্ভব। শাস্তি না পেতে পেতে স্কুলশিক্ষকরা কোচিং চালানোর দিকে এত ঝুঁকে পড়েছেন, যে বৃহত্তর সমাজের অবক্ষয় তাঁদের চোখে পড়ছে না।”
যদিও শিক্ষামহলের একাংশের এও দাবি, এখন স্কুলশিক্ষকদের নিজস্ব কোচিং সেন্টারের রমরমা আগের মত আর নেই। স্কুলের পড়াশোনার উপর একেবারেই যে অভিভাবকরা আস্থা হারিয়েছেন, তা সমর্থন করছেন না অনেকেই।
পাণ্ডবেশ্বরের রাখালচন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা কবিতা ভাণ্ডারী জানিয়েছেন, স্কলারশিপ বা মিড-ডে-মিলের জন্য সরকারি স্কুলে পড়ার ঝোঁক আগের তুলনায় অনেকটাই বেড়েছে। স্কুলছুটের সংখ্যাও কমেছে। স্কুলের শিক্ষিকরা যতটা পারেন পড়ানোর পাশাপাশি এই বিষয়গুলি নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করেন।
চেতলা বয়েজ় হাই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শুভ্র চক্রবর্তী জানিয়েছেন, সরকারের তরফে বারবার কড়া নির্দেশ জারি করে পরিস্থিতি বদলানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, “আমাদের স্কুলে এই সমস্যা আমরা বন্ধ করতে পেরেছি। ভবিষ্যতে অন্য স্কুলের ক্ষেত্রেও তা হোক, এটাই কাম্য।”