বউ বাজার স্ট্রিটে আতঙ্কে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছেন মানুষজন। ছবি: পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়।
কাঁপল কলকাতা। সেই সঙ্গে গোটা রাজ্যও।
এমনিতেই পুরভোটের উত্তেজনায় সকাল থেকেই কাঁপছিল গোটা রাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। কিন্তু, সেই কাঁপুনির সঙ্গে শনিবার দুপুরে জুড়ে গেল ভূমিকম্প। দু’য়ে মিলে বঙ্গ-জীবন রীতিমতো থরহরি কম্প।
ভূমিকম্পের উত্সস্থল নেপাল। রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে প্রায় ৭৭ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমের লামজুং এই ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র। রিখটার স্কেলে সেই কম্পনের মাত্রা ছিল ৭.৮। সেই কাঁপুনিতে কলকাতায় বেশ কয়েকটি বাড়িতে ফাটল এবং কিছু বাড়ি হেলে পড়া ছাড়া খুব বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির খবর এ দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত মেলেনি। চল্লিশ মিনিটের ব্যবধানে পর পর দু’বার কেঁপে ওঠে কলকাতা।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভূমিকম্প হওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই টুইট করেন। ওই বার্তায় তিনি জানান, রাজ্যের পরিস্থিতির উপর নজর রাখা হয়েছে। বিশেষ করে দার্জিলিং এবং শিলিগুড়িতে। বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর-সহ অন্য আধিকারিকদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছে বলে জানান তিনি। সকলকে শান্ত এবং নিরাপদে থাকার বার্তাও দেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও দেশে এবং নেপালে ক্ষয়ক্ষতির খবর নেওয়ার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলে টুইট বার্তায় জানিয়েছেন।
এ দিন সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী এভারেস্টের পর্বতারোহীদের সম্পর্কে তাঁর উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন ফেসবুক-এ। এর পাশাপাশি, ভূমিকম্পে রাজ্যের বহু ঘরবাড়ি, সেতু, রাস্তা, উড়ালপুল এবং অন্যান্য পরিকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। তিন জনের মৃত্যু এবং ৫২ জন আহত হওয়ার খবরও দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। নবান্নে এ দিন সঙ্কট মোকাবিলায় একটি বৈঠক হয়। সব জেলাশাসক, পুলিশ সুপার এবং কলকাতা পুরসভা কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করা হয়েছে। খোলা হয়েছে ২৪ ঘণ্টার কন্ট্রোল রুম। সেখানকার নম্বর ১০৭০ এবং ২২১৪৩৫৬২। রবিবার মুখ্যমন্ত্রী উত্তরবঙ্গ যাবেন বলেও জানিয়েছেন ওই বার্তায়।
দুপুর তখন পৌনে ১২টা। হঠাত্ই কেঁপে উঠেছিল অফিসের খোলা কাবার্ডের পাল্লাটি। কিছু বুঝতে পারার আগেই চেয়ার-সহ গোটা মেঝেটাই কাঁপতে দেখেন একটি বহুজাতিক সংস্থার ওই কর্মী। ভূমিকম্প হচ্ছে বুঝতে পেরে অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে তড়িঘড়ি চার তলা থেকে নেমে আসেন নীচের রাস্তায়। মধ্য কলকাতার অফিস পাড়ার সেই রাস্তায় তখন জনারণ্য। সকলের চোখেমুখেই আতঙ্কের স্পষ্ট ছাপ। নীচে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই ফের কেঁপে উঠল পায়ের তলা। তত ক্ষণে হোয়াট্সঅ্যাপে আসতে শুরু করেছে, নানা বার্তা— মেট্রো বন্ধ। কাঠমান্ডুর পোখরা উপত্যকায় এই ভূমিকম্পের উত্সস্থল। এমনকী, গোটা রাস্তা জুড়ে ফাটল দেখা দিয়েছে নেপালের রাস্তায়, আসছে সেই ছবিও।
ভূমিকম্পের পর কাঠমান্ডু। ছবি: এএফপি।
ভূমিকম্পের জেরে বহুতল আবাসনগুলিতেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। নিউটাউনের একটি আবাসনের এক বাসিন্দা জানালেন, তাঁদের ফ্ল্যাট ১০ তলায়। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন বোধহয় মাথা ঘুরছে। কিন্তু, মেঝের কম্পন অনুভব করে তিনি বুঝতে পারেন, ভূমিকম্প হচ্ছে। দুই সন্তানকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে শুরু করেন। তত ক্ষণে অন্য ফ্ল্যাটের আবাসিকরাও নামতে শুরু করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘আতঙ্কের মুহূর্তে রীতিমতো ধ্বস্তাধ্বস্তি করে নীচে নেমেছি। একটা সময় তো মনে হচ্ছিল, দমটা বোধহয় বন্ধই হয়ে যাবে।’’
ভূমিকম্পের আতঙ্কে ঘণ্টাখানেকের জন্য মেট্রো চলাচল বন্ধ করে দেন কর্তৃপক্ষ। উপরেও কিছু সময়ের জন্য যান চলাচল কার্যত স্তব্ধ হয়ে যায়। কলকাতা পুলিশ সূত্রে খবর, বেশ কয়েকটি জায়গায় বাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছে। এমনকী, বেশ কয়েকটি বাড়ি হেলেও পড়েছে ভূমিকম্পের জেরে। পোস্তা থানার বটতলা স্ট্রিট, কলাকার স্ট্রিট, তিলজলার চৌবাঘা রোড, উল্টোডাঙা মেন রোড— এ সব জায়গা থেকে বাড়ি ভেঙে পড়ার খবর পাওয়া গিয়েছে।
দার্জিলিঙে তেমন কোনও ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া না গেলেও শিলিগুড়ি এবং জলপাইগুড়িতে দেওয়াল চাপা পড়ে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। গোটা উত্তরবঙ্গে শ’তিনেক ঘরবাড়ি ভেঙে পড়েছে। আহতের সংখ্যা ৫০-এর উপরে। মালদহের সুজাপুরের নয়মৌজা হাইস্কুলে ভূমিকম্পের জেরে ভেঙে পড়ে সিঁড়ির রেলিং। এই ঘটনায় পাঁচ জন ছাত্রছাত্রী আহত হয়েছে। ওই জেলারই জালালপুরে ভূমিকম্পের সময়ে স্কুলের দোতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছিল ছাত্রছাত্রীরা। হুড়োহুড়ির সময় সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে জখম হয় দুই ছাত্র। ভূমিকম্পের জেরে শিলিগুড়ির প্রায় সব ক’টি বুথে মিনিট পনেরোর জন্য ভোটগ্রহণ বন্ধ রাখা হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতেই ফের শুরু হয় ভোটগ্রহণ। কম্পনের তীব্রতার কারণে হাওড়ার বেশ কয়েকটি জায়গায় পুকুরের জল রাস্তায় উঠে আসতে দেখা যায়।