Lok Sabha Election 2024

ভোট-উত্তপ্ত মুর্শিদাবাদের হাসপাতালগুলিতে সাজ সাজ রব, আগাম প্রস্তুতিতেও চিন্তা ব্লাড ব্যাঙ্ক নিয়ে

গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে মুর্শিদাবাদ জেলায় নির্বাচনী হিংসায় গুরুতর জখম হয়েছিলেন ৫০ জনেরও বেশি। ১৪ জন গুলিবিদ্ধ হন। ১৭ জন বোমার আঘাতে গুরুতর জখম হয়েছিলেন।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

বহরমপুর শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০২৪ ১৩:৪২
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

তিনটি পিক-আপ ভ্যান থেকে নামানো হল গাঢ় নীল রঙের ফোমের কভার লাগানো মোটা গদি। কয়েক মিনিট পর প্রায় ৩০টি গদি নামিয়ে রেখে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সামনের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে গেল গাড়িগুলি। কিছু ক্ষণের মধ্যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সামনে এল ইঞ্জিন ভ্যান। সেটায় এল অক্সিজেন সিলিন্ডার। গাড়ি থেকে সেগুলো নামাতে না নামাতেই চলে এল গদি ভর্তি আরও দু’টি পিক আপ ভ্যান। এ ভাবেই প্রায় ঘণ্টা দুয়েক জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন-সহ চিকিৎসার সরঞ্জামের আপৎকালীন মজুতের কাজ চলছে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। পরিমাণে কম হলেও চিত্রটা প্রায় একই ডোমকল সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল, রানিনগর ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, জলঙ্গি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র-সহ মুর্শিদাবাদ লোকসভার একাধিক সরকারি হাসপাতালে। হাসপাতালগুলির কয়েকটি বিভাগে অতিরিক্ত চিকিৎসক এবং চিকিৎসাকর্মীর বন্দোবস্ত করে ন্যূনতম প্রাথমিক চিকিৎসা-সহ আপৎকালীন জরুরি অস্ত্রোপচারের জন্য বন্দোবস্ত তৈরি। এত প্রস্তুতি আসলে আগামী ৭ মার্চ মুর্শিদাবাদ, জঙ্গিপুর এবং বহরমপুর আসনে লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ভোটে হিংসার অতীত পরিসংখ্যান রয়েছে। তাই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সরকারি হাসপাতালগুলিতে প্রস্তুতি চলছে। সব কিছুই প্রায় ঠিকঠাক। কিন্তু বিভিন্ন ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্তশূন্যতাই চিন্তা বাড়াচ্ছে চিকিৎসকদের। সাহায্য চাওয়া হয়েছে জেলার একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাছে। প্রয়োজনে প্রস্তুত রাখা হচ্ছে ‘ইনহাউস ডোনার’দের।

Advertisement

ডোমকল সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল এবং মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজে ভোটের ঠিক দু’দিন আগে অর্থাৎ, রবিবার সার্জিক্যাল ওয়ার্ডের করিডোরে গদির স্তূপ দেখা গিয়েছে। হাসপাতালের প্রশাসনিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত এক কর্মীর দাবি, ‘‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী গদিগুলো দোকান থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। গত পঞ্চায়েত এবং বিধানসভা নির্বাচনের সকাল থেকে যে ভাবে মারামারিতে জখম হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য লোকজন ভর্তি হতে এসেছেন, তাঁদের পরিষেবা দিতে গিয়ে আমাদের হিমশিম খেতে হয়েছে। এ বার আহতদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা এবং আপৎকালীন অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থার জন্য অস্থায়ী সজ্জা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রী মজুত করা হচ্ছে।’’ এই প্রস্তুতি নিয়ে মুর্শিদাবাদের জলঙ্গির এক গ্রামীণ চিকিৎসক আনসার বারির দাবি, ‘‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বোমা কিংবা গুলির আঘাতে আহত ব্যক্তিরা সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে যেতে চান না। আইনি জটিলতা এড়াতে সঙ্কটজনক রোগীদেরও আমাদের কাছে নিয়ে আসা হয়। আমাদের পরিকাঠামো না থাকলেও প্রাণের ভয়ে চিকিৎসা করতে বাধ্য হই। ‘গান পয়েন্টে’ রেখে আমাদের দিয়ে অস্ত্রোপচার করানো হয়।’’ তাঁর সংযোজন, “আমরা সবাই হিংসামুক্ত নির্বাচনের প্রত্যাশা করি। কিন্তু ভোটের সময় যা হয়...!’’ অন্য দিকে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি হাসপাতালের এক চিকিৎসক বললেন, ‘‘গত বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনে ডোমকল, রানিনগর, জলঙ্গি, হরিহরপাড়া, নওদায় যে ভাবে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে, সেই কারণে বাধ্য হয়েই সরকারি তরফে বাড়তি ব্যবস্থা করা হয়েছে।’’ মুর্শিদাবাদ জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অবশ্য ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর দাবি, “প্রচণ্ড গরমের কারণে ভোটার এবং ভোটকর্মীরা অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। তাই সব মেডিক্যাল ইউনিটকেই সতর্ক করা হয়েছে। জেলা কিংবা রাজ্যে এ রকমের কোনও বড় ‘ইভেন্ট’ হলে স্বাস্থ্য বিভাগকে সতর্ক করা হয়।’’

মুর্শিদাবাদ জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, হাসপাতাল ছাড়াও জেলায় কুইক রেসপন্স টিম গঠন করা হয়েছে। সেই সব দলে থাকছেন তিন জন করে চিকিৎসক, চার জন করে নার্স, দু’জন টেকনিশিয়ান এবং দশ জন করে চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। জরুরি ভিত্তিতে তৈরি রাখা হচ্ছে পাঁচটি অ্যাম্বুল্যান্স। অতি সঙ্কটজনক রোগীদের স্থানান্তর করার ক্ষেত্রে কাজে আসবে।

Advertisement

গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে মুর্শিদাবাদ জেলায় নির্বাচনী হিংসায় গুরুতর জখম হয়েছিলেন ৫০ জনেরও বেশি। ১৪ জন গুলিবিদ্ধ হন। ১৭ জন বোমার আঘাতে গুরুতর জখম হয়েছিলেন। এ বার লোকসভা ভোটের আগে এ রকম ঘটনার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা হয়েছে। সার্জারি, অর্থোপেডিক, চোখ, কান ও গলার মতো বিভাগের চিকিৎসক এবং চিকিৎসাকর্মীর সমন্বয়ে প্রতিটি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে আলাদা দল তৈরি করা হয়েছে। রোগী হাসপাতালে পৌঁছনোর পরে দ্রুত যাতে তাঁর প্রাথমিক চিকিত্সা হয়, তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালকে। প্রয়োজনীয় পরীক্ষানিরীক্ষা— এক্স-রে এবং সিটি স্ক্যানের মতো সুবিধাগুলি ২৪ ঘণ্টা কাজ করবে। জরুরি বিভাগে বাড়তি আইসিইউ এবং সিসিইউ শয্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এত সব ব্যবস্থার পরেও মুর্শিদাবাদের প্রায় সমস্ত ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্তের সঙ্কট চিন্তায় রাখছে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগকে। তাই বিশেষ এবং জরুরি প্রয়োজনে রক্তের জন্য ‘ইনহাউস রক্তদাতা’দের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলিকে।

স্বাস্থ্য বিভাগে এত সব প্রস্তুতি চললেও ভোট অবাধ এবং শান্তিপূর্ণ হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী শাসকদল থেকে বিরোধীরা। মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী আবু তাহের খান বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্যে ভোট সব সময় শান্তিপূর্ণ হয়। বিজেপি এবং বাম-কংগ্রেস উস্কানি দেওয়ার চেষ্টা করলেও আমি দলীয় কর্মীদের সংযত থাকার পরামর্শ দেব।’’ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক তথা মুর্শিদাবাদের কংগ্রেস সমর্থিত বাম প্রার্থী মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘লোকসভা কেন্দ্রের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যে ভাবে অবৈধ অস্ত্র এবং বোমা উদ্ধার হচ্ছে, তাতে পরিষ্কার যে ওগুলো ভোটেই ব্যবহারের উদ্দেশ্য ছিল।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ এবং অবাধ ভোটের ব্যবস্থা না করলে সাধারণ মানুষই প্রতিরোধ তৈরি করবে।’’ এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী গৌরীশঙ্কর ঘোষের মন্তব্য, ‘‘তৃণমূল মানেই গুন্ডা আর সন্ত্রাসবাদীদের আখড়া। তারা যে অশান্তি করবে এটাই স্বাভাবিক। তাই আগে থেকে হাসপাতাল প্রস্তুত রাখছে। নির্বাচন কমিশনের কাছে অনুরোধ করব, কেন্দ্রীয় বাহিনী যাতে ঠিক ভাবে কাজ করতে পারে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন