(বাঁ দিক থেকে) রাহুল গান্ধী, সনিয়া গান্ধী এবং প্রিয়ঙ্কা গান্ধী। —ফাইল ছবি।
“রাহুল গান্ধী হয়তো জিতে যাবেন। কিন্তু কেন রায়বরেলীর মানুষ গান্ধী পরিবারকে বছরের পর বছর ভোট দেন, সেই মনস্তাত্ত্বিক কারণ বুঝতেও পারবেন না।”
রায়বরেলীর জেলা আদালতের গায়েই মাঝবয়সি অলোক শর্মার ফটোকপির দোকান। উকিল, মামলাকারী, পুলিশের উর্দিধারীদের ভিড় লেগেই রয়েছে। খদ্দেরদের সামলাতে সামলাতে অলোক বললেন, “বাপ-ঠাকুরদার আমল থেকে রায়বরেলী যেমন ছিল, তেমনই রয়েছে। কোনও উন্নতি নেই। শহরটা আড়ে-বহরে বাড়েনি। তা-ও গান্ধী পরিবারকে রায়বরেলী জিতিয়ে চলেছে। এ এক অদ্ভুত মনস্তত্ত্ব!”
অলোক শর্মার দোকানের ঠিক উল্টো দিকে ফটকের গায়ে রাহুল গান্ধীর হাসি মুখের ছবিওয়ালা পোস্টার। তাতে লেখা, ‘রায়বরেলী কে রাহুল’। আর ফটকের মাথায় মলিন হয়ে যাওয়া বোর্ডে লেখা—‘জনসম্পর্ক কার্যালয়, মাননীয় সাংসদ, রায়বরেলী’। গত কুড়ি বছর ধরে এটাই রায়বরেলীর সাংসদ সনিয়া গান্ধীর সংসদীয় দফতর।
ভিতরে ঢুকলে অবশ্য বোঝার উপায় নেই, এটা সনিয়া গান্ধীর সংসদীয় অফিস! যে কোনও শহরের পুরসভার কাউন্সিলের দফতরও এর থেকে চকচকে হয়। নির্বাচনের মরসুমে সামিয়ানা খাটানো হয়েছে। উঠোনে কার্পেট পাতা হয়েছে। তবু মলিন ভাব কাটেনি। এই দফতর থেকেই এত দিন সনিয়ার সংসদীয় প্রতিনিধি কিশোরীলাল শর্মা কাজ করতেন। তিনি এ বার অমেঠীতে কংগ্রেস প্রার্থী। তাই দফতরে তালা। উঠোনের অন্য পাশে কংগ্রেসের রায়বরেলী জেলা কমিটির দফতর— তিলক ভবন। গুজরাত, দিল্লি, তেলঙ্গানা থেকে আসা ছোট-বড় কংগ্রেস নেতারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে। কেউ রাহুল গান্ধীর সঙ্গে কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত ভারত জোড়ো যাত্রায় হেঁটেছেন। কেউ মণিপুর থেকে মুম্বই পর্যন্ত ন্যায় যাত্রায় রাহুলের সঙ্গে থেকেছেন। নিজেদের উদ্যোগেই রায়বরেলীতে চলে এসেছেন। কারণ রায়বরেলীতে এ বার কংগ্রেস প্রার্থী খোদ রাহুল গান্ধী।
‘জনসম্পর্ক কার্যালয়’-এর মতোই মলিন ছবি গোটা রায়বরেলীর। নরেন্দ্র মোদীর সুরে প্রশ্ন তুলছে, ‘গত সত্তর বছরে কী কাজ হয়েছে?’ গোটা রায়বরেলী যেন অনুন্নয়ন, অযত্ন, অবহেলার মূর্ত প্রতীক। বলে না দিলে বোঝার উপায় নেই, সনিয়া গান্ধী বিশ বছর এই লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ থেকেছেন। যে সনিয়ার নেতৃত্বাধীন ইউপিএ দশ বছর কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিল।
উত্তরপ্রদেশের কংগ্রেসের মুখপাত্র অংশু অবস্থী বলছেন, “আসলে রায়বরেলী ষড়যন্ত্রের শিকার। উত্তরপ্রদেশে বছরের পর বছর কংগ্রেসের বদলে অন্য দলের সরকার থেকেছে। সেই সরকার ইচ্ছে করে গান্ধী পরিবারের গড় রায়বরেলীর কোনও উন্নতি করেনি। এখন যেমন কেন্দ্রের মোদী সরকার, উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকার রায়বরেলীর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করছে। তাই রায়বরেলীতে সনিয়া গান্ধীর স্বপ্নের রেল কোচ কারখানা তৈরি হতে দেরি হয়েছে। সনিয়াজি-র উদ্যোগে রায়বরেলী-তে এমস হয়েছে। কিন্তু তার বেড সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। যোগী আদিত্যনাথ রায়বরেলীতে প্রস্তাবিত মেডিক্যাল কলেজ তাঁর নিজের গোরক্ষপুরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। তবে মানুষ বোঝে, রায়বরেলী গান্ধী পরিবারের কতখানি প্রিয়।”
রায়বরেলীর সঙ্গে গান্ধী পরিবারের পুরনো টান বোঝাতে কংগ্রেস সনিয়া-রাহুলের একটি পারিবারিক আড্ডার ভিডিয়ো প্রকাশ করেছে। রাহুল পুরনো অ্যালবাম ঘাঁটতে ঘাঁটতে বলছেন, রায়বরেলীর অড়হর ডাল তাঁর সবথেকে প্রিয়। সনিয়ার আগে তাঁর শ্বশুর, শাশুড়ি ফিরোজ গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী রায়বরেলীর সাংসদ হয়েছেন। তা বোঝা যায় ফিরোজ বা ইন্দিরার নামে রায়বরেলীর কলেজ থেকে নানা প্রতিষ্ঠানের নামকরণে। রায়বরেলী থেকে অমেঠীতে ঢুকলে চোখে পড়বে ইন্দিরা গান্ধী উড়ান অ্যাকাডেমি, রাজীব গান্ধী ইনস্টিটিউট অব পেট্রোলিয়াম টেকনোলজির মতো প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তাতে লাভ কী হয়েছে? রায়বরেলীর অলিগলিতে ঘুরলে প্রশ্ন শোনা যায়, এই সব প্রতিষ্ঠানে রায়বরেলীর কত জন পড়তে যায়? রেল কোচ কারখানার জন্য যারা জমি দিয়েছিলেন, তাঁদের ছেলেমেয়েরাই ওখানে চাকরি পায়নি। রায়বরেলীর এমস-এ পেসমেকার বসাতে গেলেও এক মাস অপেক্ষা করতে হয়।
তা সত্ত্বেও কংগ্রেস রায়বরেলীতে জিতে এসেছে। স্বাধীন ভারতে ১৯৭৭, ১৯৯৬ ও ১৯৯৮-এর লোকসভা নির্বাচন ছাড়া কংগ্রেস আর কখনও রায়বরেলীতে হারেনি। সনিয়া ২০০৪ থেকে রায়বরেলীর সাংসদ। যদিও প্রথম দিকে তাঁর জয়ের ব্যবধান তিন থেকে সাড়ে তিন লক্ষ থাকত। গত লোকসভা নির্বাচনে সেটা দেড় লক্ষের কোঠায় নেমে এসেছিল। গত লোকসভা ভোটে অমেঠীতে হারের পরে ফের স্মৃতি ইরানির মুখোমুখি হওয়ার বদলে রাহুল এ বার মায়ের লোকসভা কেন্দ্র থেকে লড়ছেন। রাহুল এ বার রায়বরেলী থেকেও হেরে যাবেন না তো? ইন্দিরা গান্ধী যেমন ১৯৭৭-এ জনতা পার্টির রাজ নারায়ণের কাছে হেরে গিয়েছিলেন!
তিলক ভবনে জমায়েত কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরা হাঁ হাঁ করে উঠবেন। ‘‘প্রশ্নই নেই। গান্ধী পরিবারের সঙ্গে রায়বরেলীর মনের বন্ধন। রায়বরেলী তার রাহুলকেই জেতাবে।’’ শুনে উল্টো দিকের দোকানে বসে থাকা অলোক বলেন, “ওই যে বললাম, কোথায় যে মনের টান, তা বোঝা কঠিন। চল্লিশ বছর ধরে সনিয়া গান্ধীর দফতরের উল্টো দিকে দোকান চালাচ্ছি। কোনও দিন তাঁকে এই দফতরে দেখলাম না। পাঁচ বছর আগে মনোনয়ন জমা দিতে এসেছিলেন। তার পরে আর আসেননি।”
গোটা বিজেপি এই প্রশ্নেই গান্ধী পরিবারকে তির হানছে। বিজেপি প্রার্থী করেছে ভূমিপুত্র দীনেশ প্রতাপ সিংহকে। তিনি যোগী সরকারের প্রতিমন্ত্রী। কিন্তু বিজেপির অন্দরমহলের মতো রায়বরেলীই দীনেশ প্রতাপকে নিয়ে খুশি নয়। দীনেশের জমির পরিমাণ নাকি গত পাঁচ-সাত বছরে ৫০০ বিঘা থেকে বেড়ে ২০০০ বিঘা হয়েছে! এই ঠাকুর নেতার সঙ্গে রায়বরেলী সদরের বিজেপি বিধায়ক অদিতি সিংহের ঘোর বিরোধ। তিনিও ঠাকুর সম্প্রদায়ের নেত্রী। কংগ্রেস থেকে বিজেপিতে আসা অদিতি একদা প্রিয়ঙ্কার ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এলাকার মানুষের ধারণা ছিল, রায়বরেলী সদরের সাত বারের বিধায়ক অখিলেশ সিংহের কন্যা অদিতির সঙ্গে রাহুলের বিয়ে হবে! অদিতি বিজেপির বিধায়ক হলেও দীনেশ প্রতাপের হয়ে প্রচারই করছেন না। সমাজবাদী পার্টি থেকে বিজেপিতে আসা বিধায়ক, ব্রাহ্মণ নেতা মনোজ পান্ডেও রায়বরেলী থেকে টিকিট চাইছিলেন। না মেলায় তিনিও ক্ষুব্ধ। অমিত শাহকে রায়বরেলীতে এসে সেই ক্ষোভ সামলাতে হয়েছে। কিন্তু ব্রাহ্মণ, ঠাকুর ভোট না পেলে বিজেপি লড়বে কী ভাবে?
বিজেপি প্রচারে বলছে, রাহুল গান্ধীকে ভোট দিয়ে লাভ কী হবে? তিনি তো কেরলের ওয়েনাড়ের সাংসদ থাকবেন। রায়বরেলীতে জিতলেও ইস্তফা দেবেন। রায়বরেলীর কোনও কংগ্রেস নেতার কাছেই এ প্রশ্নেরউত্তর নেই। তাঁরা শুধু বলছেন, রাহুল কোন কেন্দ্রের সাংসদ থাকবেন, সে পরে ঠিক হবে। সনিয়া-রাহুল-প্রিয়ঙ্কা গান্ধীদের সঙ্গে রায়বরেলীর মনের টান থাকবেই।