খোল্টাইকো পার্কে এই ভাবে বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে টয় ট্রেন।
ঘড়িতে তখন সকাল ১০টা। চড়া গরমে রোদের তেজ অবশ্য একেবারে ভরদুপুরের। মোটরবাইকে আমার সঙ্গী চিত্রসাংবাদিক সহকর্মী হিমাংশুরঞ্জন দেব। কোচবিহার শহর থেকে রওনা হলাম। খাগরাবাড়ি চৌপথি পেরিয়ে মোটরবাইক যত এগোচ্ছে রোদের তেজও তত বাড়ছে। তার উপর ওই রাস্তা চওড়া করার কাজও হচ্ছে। পিচের আস্তরণের দু’দিকে মাটি-বালি-পাথর পড়েছে। মাঝেমধ্যে হাওয়ার জেরে উড়ে আসছে ধুলো। খোল্টা পৌঁছনর আগেই বার দু’য়েক বাইক দাঁড় করাতে হল। পরে নিতে হল রোদচশমা, নাক-কান ঢাকতে কাপড়ের মুখোশ। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই খোল্টা পৌঁছলাম। কোচবিহার জেলার শেষ সীমানা। কাছেই আলিপুরদুয়ার জেলা।
এলাকায় অন্য বারের মতো ভোটের তাপের আঁচ কই ! পতাকা, ব্যানার, দেওয়াল লিখনের সেই ছয়লাপ অবস্থা নেই। গোটা রাস্তা জুড়ে না তৃণমূল, না বাম কিংবা বিজেপি— কোনও দলের তেমন প্রচারসামগ্রী চোখে পড়েনি। তাই বলে খোল্টাও এমন নিস্তরঙ্গ হবে ? নিজেকেই প্রশ্ন করছিলাম। আরও অবাক করল এমন ভরা ভোটের আবহেও খোল্টা তৃণমূল অঞ্চল কার্যালয়ে তালা ঝুলতে দেখে। সে কি! এমনটাও সম্ভব! কোচবিহারে ৫ মে নির্বাচন। হাতে গোনা কিছু দিন বাকি। এই সময় শাসকদলের অঞ্চল কার্যালয় এত বেলাতেও খোলা হবে না? কিছুটা এগোতেই রেললাইন। ওই পারে খোল্টা ইকো পার্ক।
এই প্রসঙ্গে জানিয়ে দিতে হয়, সিপিএম নেতা তথা প্রাক্তন বনমন্ত্রী অনন্ত রায়ের বাড়ি হল খোলটায়। তৃণমূল জমানার বনমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মন সম্পর্কে অনন্তবাবুর কাকা হন। সেই অনন্তবাবু মন্ত্রী হওয়ার পরে কোচবিহার শহর লাগোয়া খাগরাবাড়িতে বাড়ি করেছেন। সেখানেই এখন থাকেন। তবে গ্রামে যাতায়াত, যোগাযোগ সবই আছে। তো সেই অনন্তবাবু বনমন্ত্রী থাকাকালীন এলাকার পর্যটন প্রসারের ভাবনায় ওই পার্ক করেছিলেন। সেখানে টয়ট্রেন, হরিণ উদ্যান, পাখিরালয়, ঝুলন্ত সেতু, বোটিং, কটেজ অনেক কিছু হয়েছিল। তারজালি ঘেরাটোপে সেগুন বাগানের ভেতরে তৈরি উদ্যানে হরিণ রেখে চার দিকে টয়ট্রেনের লাইন বসান হয়। এখনও তা রয়েছে।
পরিবেশপ্রেমীদের তোলা শব্দদূষণে বন্যপ্রাণীর সমস্যার অভিযোগ এখন নেই। নেই পর্যটকের ভিড়ও। কেন? প্রশ্ন করতেই প্রায় তেড়েফুঁড়ে এলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বনকর্মী। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললেন, দেখছেন না কি হাল! দুই বছরের ওপর টয়ট্রেন বন্ধ। শিলিগুড়ির সাফারি পার্কের জন্য এখান থেকে গোটা ১২ হরিণ তুলে নেওয়া হল। এক বার মদ্যপ অবস্থায় পার্কে ঢুকতে আপত্তি করায় আমার সহকর্মীর উপর হামলা হয়। পুলিশ কিসসু করেনি। একে এমন বেহাল দশা, নিরাপত্তা নেই। কে আসবে ?
তার মধ্যেও কিছু লোক যে আসছেন না তা নয়। আলিপুরদুয়ারের বাসিন্দা লক্ষ্মীনারায়ণ শাহ বাইক স্ট্যান্ড করিয়ে ছেলে দেবাকে নিয়ে টিকিট কাটছিলেন। এগিয়ে এসে বলেই দিলেন, আলিপুরদুয়ারেও এত দিনে ভাল একটা পার্ক হয়নি। ছুটি থাকলে ছোটদের নিয়ে যাওয়ার ভাল জায়গা নেই। বাধ্য হয়েই খোল্টায় আসি। পার্কে ঢোকার মুখে মজে যাওয়া আলাইকুমারি নদীর খাতের ওপর তৈরি পাকা ছোট্ট সেতু পেরিয়ে পর পর আরও দুটি বাইক ঢুকল। একটিতে দুই তরুণ-তরুণী। পাশে থাকা শেডঘরের কর্মী বাইক স্ট্যান্ড করার টিকিট কাটবার জন্য ডাকাডাকি করলেও ওই তরুণ আমল দিলেন না। অহেতুক ঝামেলা এড়াতে ঝুঁকি নিলেন না বনসুরক্ষা কমিটির সদস্য, টিকিট কাটবার দায়িত্বে থাকা বৃদ্ধ অনিল সরকার। অস্ফুটে বলেন, ফেরার সময় টিকিটটা করাব। ভোট নিয়ে কী ভাবছেন? এ বার কারা জিতবে? বিরক্তির সুরে সত্তরোর্ধ্ব অনিলবাবু বললেন, “পার্কের জন্য মাত্র ১২ হাজার টাকায় চার বিঘা জমি দিয়েছি। পরে আরও টাকা, পরিবারের এক জনের চাকরির আশ্বাস ছিল। কিছুই পাইনি। একটা বাধর্ক্যভাতা পর্যন্ত হয়নি। তার ওপর টিকিট বিক্রি কমেছে। সংসার চালাতেই হিমসিম অবস্থা। ভোট নিয়ে ভাবব কখন?”
গ্রামের রাস্তায় দেখা ছোট্ট নাতনিকে নিয়ে বাড়িমুখো গৌরাঙ্গ দাসের সঙ্গে। ধুতি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরনে বৃদ্ধ বলছিলেন, পুরো দেড়শোডা টাকা লাগল। কি দাম জিনিসের। রোদের চাওয়াও বেশি ছ্যাকা লাগে!’’ ভোট দেবেন না? জানতে চাইতেই মুহূর্তে যেন গম্ভীর হয়ে গেলেন তিনি। বললেন, “ পার্ক হওয়ায় দুই পয়সা বেশি কামাইয়ের (রোজগার) স্বপ্ন ছিল। এখন পার্কটাই তো প্রায় শেষ। আমার বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য দুই বছর আগে টাকা জমা দিয়াও কাম হয় নাই। আমাগো দেওয়া কথা কেউ রাখে নাই। ভোটের দেরি আছে, পরে ভাবুমনি না হয়।”
ফেরার সময় বাণেশ্বরে দাঁড়ালাম। পর্যটক আকর্ষণ বাড়ানোর সু্যোগ নিয়ে আলোচনা করছিলেন মন্দিরের সামনে দাঁড়ানো কয়েক জন। বলাবলি করছিলেন, এলাকার পর্যটন প্রসারে বামেরা কাজের কাজ কিছু করেনি। অপরিকল্পিত ভাবে খোল্টায় প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা খরচ করে টয়ট্রেন বসান হয়। পরে যার খরচ তোলা যাচ্ছিল না। এখানকার প্রাচীন শিবমন্দিরে পর্যটকদের আনাগোনা রয়েছে। লাগোয়া দিঘিতে বিরল প্রজাতির কাছিম আছে। কিন্তু সে ভাবে না ৩৪ বছরে কিছু হয়েছে, না গত ৫ বছরে। অথচ বাম আমলে পরপর কাছিম মৃত্যু নিয়ে এলাকায় বনধ পর্যন্ত হয়েছিল মোহন রক্ষা কমিটির (কাছিমকে বাসিন্দারা ওই নামে ডাকেন) ব্যানারে।
এ বার খোল্টা, রসমতি পর্যটনকেন্দ্র, বাণেশ্বর যে বিধানসভার আওতাধীন সেই কোচবিহার উত্তরের তৃণমূল প্রার্থী পরিমল বর্মন ওই কমিটির সম্পাদক ছিলেন। অন্য দিকে, বাম ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক জোটের প্রার্থী বিদায়ী বিধায়ক ফরওয়ার্ড ব্লকের নগেন্দ্রনাথ রায়। বিজেপির সুকুমার রায় জেলবন্দি অবস্থাতেও ওই কেন্দ্রে লড়ছেন। সুকুমারবাবুর হয়ে কাছিমদের খাইয়ে প্রচারে নেমেছেন তাঁর স্ত্রী মায়া রায়।
খোল্টা ইকো পার্কের সেতুর বেহাল অবস্থা।
ব্যাটন বদলের যুদ্ধে পর্যটন ইসু তাই বড় হাতিয়ার। ডোডেয়ারহাটের কাছে জমিতে কাজ করছিলেন বিমল বর্মন। তিনি বললেন, ‘‘মনটা মোটেই ভাল নেই। একটা পরিবর্তনের ঝাপটা সামলা দিতে না দিতেই আর একটা আসছে বলে হইচই হচ্ছে। সবই শুনি, বুঝিও। আমরা যেখানে ছাপ দেওয়ার দেব। তাতে গাঁয়ের চেহারার ভাঙাচোরা ছাপটা কি মুছবে!’’
পাল্টা প্রশ্নের জবাব যাঁদের দেওয়ার কথা, তাঁদের কেউ তখন ধারেকাছে ছিলেন না।
ছবি: হিমাংশুরঞ্জন দেব।