জয় একার নয়, ১১ আমলাকেও কৃতিত্বের ভাগ দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী

ভোটের প্রচারে গিয়ে বলেছিলেন, ২৯৪টি আসনে তিনিই প্রার্থী। তার পর ২১১টি আসন জিতে নেওয়ার কৃতিত্বও তাঁর একারই প্রাপ্য বলে মানেন তৃণমূলের নিচু থেকে উপর তলা। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং মনে করেন, এই জয়ের একমাত্র ‘অধিকারী’ তিনি নন।

Advertisement

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৬ ০৩:৩৬
Share:

ভোটের প্রচারে গিয়ে বলেছিলেন, ২৯৪টি আসনে তিনিই প্রার্থী। তার পর ২১১টি আসন জিতে নেওয়ার কৃতিত্বও তাঁর একারই প্রাপ্য বলে মানেন তৃণমূলের নিচু থেকে উপর তলা। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং মনে করেন, এই জয়ের একমাত্র ‘অধিকারী’ তিনি নন। দলের সতীর্থরা তো আছেনই, পাশাপাশি অন্তত ১১ জন আইএএস অফিসার এই জয়ের নেপথ্য নায়ক— ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছেন মমতা। তাঁর নতুন সরকারে এই অফিসারদেরই নেতৃত্ব করতে দেখা যাবে বলে নবান্ন সূত্রের খবর।

Advertisement

মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এক সূত্রের কথায়, ‘‘বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা সফল ভাবে রূপায়ণের জন্য ওই অফিসারদের কৃতিত্ব অনেক। তাঁরাই সরকারি সুবিধাগুলি দলমত নির্বিশেষে নিচুতলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।’’ আর এই সব সরকারি প্রকল্পের দৌলতে যে বিশাল সংখ্যক উপভোক্তা শ্রেণি তৈরি হয়েছে, তাঁরাই কৃতজ্ঞতাবশত তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন বলে মমতার ঘনিষ্ঠ এক সহযোগীর দাবি। তিনি বলেন, ‘‘অনেক পণ্ডিত মনে করেছিলেন তৃণমূলের ভোট কমে যাবে। কিন্তু সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে ভোট প্রাপ্তির হার ৬% বেড়েছে।’’

আড্ডার মেজাজে। কালীঘাটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে (বাঁ দিক থেকে) শোভন চট্টোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম, অরূপ বিশ্বাস এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার। ছবি: সুদীপ আচার্য

Advertisement

কেন বাড়ল ভোট?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন, সিপিএমের সঙ্গে কংগ্রেসের জোট নিচুতলার মানুষ গ্রহণ করেননি। ৩৪ বছরের বাম শাসনের কথা মনে রেখে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষ সিপিএম-কে ভোট দেননি। সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্কও অটুট থেকেছে মমতার। পাশাপাশি দু’টাকার চাল, স্কুল পড়ুয়াদের সাইকেল ও জুতো বিলি, কন্যাশ্রীর মতো প্রকল্পের ফলে গ্রাম-শহরে যে উপভোক্তা শ্রেণি তৈরি হয়েছে তাঁদের সিংহভাগ ভোট তৃণমূলের বাক্সে জমা পড়েছে। সিন্ডিকেট রাজ, দুর্নীতি, নেতাদের দাপাদাপির নেতিবাচক প্রভাবকে ছাপিয়ে গিয়েছে সুবিধা বিলির প্রকল্পগুলির প্রতি আমজনতার আস্থা।

আর এখানেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে মুখ্যমন্ত্রীর পছন্দের ১১ অফিসারের ভূমিকা। ঘনিষ্ঠ মহলে মুখ্যমন্ত্রী গোড়াতেই যে ছয় অফিসারের কৃতিত্বের কথা বলেছেন তাঁরা হলেন, সস্তার চাল বিলির জন্য খাদ্যসচিব অনিল বর্মা, সাইকেল বিলির ব্যবস্থা করা এবং এসসি-এসটি শংসাপত্র বিলির জন্য অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ উন্নয়ন সচিব সঞ্জয় থাড়ে, কন্যাশ্রী প্রকল্পের জন্য সমাজকল্যাণ সচিব রোশনি সেন, সংখ্যালঘু উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য দফতরের দুই প্রাক্তন সচিব খলিল আহমেদ ও পারভেজ বি সেলিম এবং রাস্তাঘাটের হাল ফেরানোর জন্য পূর্তসচিব ইন্দিবর পাণ্ডে। এ ছাড়াও তাঁর জয়ে শিক্ষাসচিব বিবেক কুমার, পর্যটনসচিব অজিত বর্ধন, ক্ষুদ্রশিল্প সচিব রাজীব সিংহ এবং কৃষি দফতরের হাল ফেরানোর জন্য বর্তমান স্বাস্থ্যসচিব আরএস শুক্লের বিশেষ অবদান রয়েছে বলে মুখ্যমন্ত্রী মনে করেন। তাঁর মতে এই দফতরগুলির মাধ্যমে যে কাজ হয়েছে মানুষ তা উপলব্ধি করেছে এবং ভোটে তার প্রতিফলন মিলেছে। একই সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মহলে মমতা বলেছেন, ‘‘উন্নয়ন প্রকল্পগুলি সফল ভাবে পরিচালনার জন্য অর্থের প্রয়োজন ছিল। সেই কাজে অর্থসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীর বিশেষ কৃতিত্ব রয়েছে।’’ প্রবল চাপ এবং কষ্টের মধ্যেও দ্বিবেদী টাকা জোগাড় করেছেন বলে মুখ্যমন্ত্রী মনে করেন। আর সবার উপরে মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং স্বরাষ্ট্রসচিব মলয় দে তো রয়েইছেন। বিশেষ করে স্বাস্থ্যসচিব থাকাকালীন মলয়বাবুর অবদান স্বীকার করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।

সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন

তবে প্রশাসনিক মহলের অনেকের মতে, তৃণমূলের এই জয়ে প্রাক্তন মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রেরও একটা ভূমিকা রয়েছে। কারণ, কন্যা‌শ্রী এবং সাইকেল বিলির মতো জনপ্রিয় দু’টি প্রকল্পের প্রস্তাব মুখ্যমন্ত্রীর কাছে প্রথম তুলে ধরেছিলেন তিনিই। বাম জমানায় স্বাস্থ্যসচিব থাকাকালীনও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে একই প্রস্তাব তিনি রেখেছিলেন। কিন্তু সিপিএম তা গ্রহণ করেনি। অথচ মমতা প্রকল্প দু’টি লুফে নিয়ে প্রায় ১ কোটি উপভোক্তা তৈরি করেন। নবান্নের অন্দরের খবর, সঞ্জয়বাবুকে এই প্রকল্পের খুঁটিনাটি তৈরিতে সাহায্য করেছিলেন বর্তমান মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়।

মমতা অবশ্য প্রাক্তন মুখ্যসচিবের কোনও কৃতিত্বের কথা মানতে চাননি। তাঁর এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী জানান, মুখ্যমন্ত্রী মনে করেন প্রাক্তন মুখ্যসচিব বরং তাঁর সমস্ত কাজে বাগড়া দিতে চাইতেন। দানধ্যানের প্রকল্পগুলি সবই মমতারই মস্তিষ্কপ্রসূত। সংশ্লিষ্ট দফতরের সচিবরা তা নিষ্ঠার সঙ্গে রূপায়ণ করেছেন। সমাজের একেবারে নিচুতলার মানুষদের কাছে প্রকল্পগুলির সুবিধা পৌঁছে দিয়েছেন এবং তা নিয়ে কোনও রকম দলবাজি করতে দেননি।

মমতার এক ঘনিষ্ঠের মতে, মুখ্যমন্ত্রী জানেন কে কাজের, আর কে কাজের নন। সংখ্যালঘুসচিব হিসাবে অনেকেই কাজ করেছেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মনে করেন খলিল আহমেদ এবং পি বি সেলিম থাকাকালীনই সবচেয়ে ভাল কাজ হয়েছে। তার লাভ এ বারের নির্বাচনে পাওয়া গিয়েছে। একই ভাবে এখনকার স্বাস্থ্যসচিব শুক্লকে তাঁর কৃষি দফতরের কাজের জন্য এবং স্বরাষ্ট্রসচিব মলয় দে-কে স্বাস্থ্য দফতরে থাকাকালীন তাঁর কাজের জন্য বাহবা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। যদিও নির্বাচন কমিশনকে ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করতে না-পারা এবং ভোটের সময় পুলিশের অতিসক্রিয়তার ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্রসচিবের ভূমিকা নিয়ে কিঞ্চিৎ অভিমানও রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর।

রাজ্যে মোট দফতর ৫৮। তার মধ্যে থেকে ১১ জন সচিবকে ভাল কাজের নিরিখে বেছেছেন মমতা। যা শুনে বাছাই একাদশে ঠাঁই পাওয়া এক সচিবের প্রতিক্রিয়া, ‘‘ভালই লাগছে। কিন্তু এটা পুরস্কার, না তিরস্কার, বুঝতে পারছি না। সতীর্থরা কি এ সব জেনে খুশি হবেন? বেশির ভাগ অফিসারই তো তালিকার বাইরে।’’

নায়ক তো হাতেগোনাই হবে। তা-ও আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়ের ভাগীদার! এ কি চাট্টিখানি কথা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন