বোমা-বাঁশ-ছাপ্পায় ভূতের কেত্তন

কত বড় ফোর্স তুই, বাইরে চ’ দেখে নিচ্ছি

এমন কিছু যে ঘটতে পারে, তা আঁচ পাওয়া গিয়েছিল গত কয়েক দিন ধরে চলা ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানায়। কখনও হরিণঘাটা, চাকদহ তো কখনও গয়েশপুর— দিনেদুপুরে মোটরবাইকে চেপে ঘুরে বেড়িয়েছে তারা।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

কল্যাণী শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:০৪
Share:

সোমা অধিকারী গয়েশপুর

এমন কিছু যে ঘটতে পারে, তা আঁচ পাওয়া গিয়েছিল গত কয়েক দিন ধরে চলা ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানায়। কখনও হরিণঘাটা, চাকদহ তো কখনও গয়েশপুর— দিনেদুপুরে মোটরবাইকে চেপে ঘুরে বেড়িয়েছে তারা। শাসিয়েছে, বোমা মেরেছে বিরোধী প্রার্থীর বাড়িতে। তবু অশরীরীদের ধরতে পারেনি কেউ। তাই ভোটের দিন যে তারা দাঁত-নখ বার করবে, তা আর আশ্চর্যের কী!

Advertisement

বৃহস্পতিবার সত্যি হল সেই আশঙ্কাই। কোথাও জিন্স-টি শার্ট পরে, চোখে রোদচশমা এঁটে দাদাগিরি করতে দেখা গেল তাদের। কোথাও আবার সরাসরি হামলা চালাল তারা। ভোটের লাইন থেকে টেনে বার করল বিরোধী দলের কর্মীকে।

কিন্তু কেন এমন মরণ কামড়? গয়েশপুর, চাকদহের মতো কেন্দ্র তো বরাবরই শাসকদলের শক্ত ঘাঁটি। সেখানে কীসের ভয়? তবে কি তৃণমূলের পায়ের তলা থেকে মাটি সরছে? প্রশ্নটা সারাদিনই ঘুরে বেড়ালো হাওয়ায় হাওয়ায়।

Advertisement

ঘড়িতে তখন সকাল ৮টা ২০। গায়ে আকাশি টি-শার্ট, গাঢ় নীল জিন্স, চোখে রোদ চশমা এঁটে বুথ চত্বরের মধ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছিল সে। সাংবাদিকদের দেখে এগিয়ে এল মাঝবয়সি জিন্সবাবু। হুমকি মেশানো পরামর্শের গলায় বলল, ‘‘আরে কী করছেন দাদা, তখন থেকে বুথের মধ্যে? এখানে কোনও গ্যাঞ্জাম নেই। আমাদের গয়েশপুরে সবই শান্তিপূর্ণ।’’ —আপনি কী করছেন? প্রশ্ন করতেই ধেয়ে এল উত্তর, ‘‘আমরা এখানেই থাকব।’’ তাকে এমন অকাতরে পরামর্শ বিলোতে দেখে এগিয়ে এলেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর এক জওয়ান। ‘দাদা’ জানালেন, তিনি তৃণমূল প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট। নাম সাধন বিশ্বাস। কিন্তু তাঁর কাগজপত্র কোথায়? নাহ্‌, সে সব নাকি লাগে না। জওয়ান তাঁর কথায় কান না দিয়ে ঘাড় ধরে বের করে দিলেন বুথের বাইরে। যদিও গয়েশপুর আদর্শ শিক্ষায়তনে সারাদিন ধরেই চলতে থাকল ভূতেদের জারিজুরি। কখনও ‘সোজা’ ভূত তো কখনও ‘বাঁকা’ ভূত। যদিও তৃণমূলের দাদারা
বলে গেলেন, কোথাও কোনও গণ্ডগোল নেই।

২৬৭ নম্বর বুথে দেখা গেল, এক বৃদ্ধার ভোট দিচ্ছেন এক ব্যাক্তি। প্রিসাইডিং অফিসার সন্দীপকুমার ঘোষ মাথা চুলকে বললেন, ‘‘আমি ঠিক খেয়াল করিনি। আসলে উনি নিজেই হেঁটে গেলেন। আর আমার কাছ থেকে উনি সাহায্য চেয়ে কোনও আবেদনও করেননি। আর এ রকম ভুল হবে না।’’ একই দৃশ্য হরিণঘাটাতেও। বড়জাগুলী গোপাল অ্যাকাডেমিতে সিপিএমের পার্টি সদস্যকে ভোটের লাইন থেকে বের করে মারধর করার অভিযোগ উঠল তৃণমূলের বিরুদ্ধে।

কল্যাণীর সগুনায় আবার অভিযোগ ওঠে, সিপিএমের ভোটাররা ভোট দিতে পারছেন না। এক সময় রাস্তায় বসে পড়েন সিপিএম ও কংগ্রেসের লোকেরা। সাংবাদিকদের সামনেই মূহুর্তের মধ্যে সেখানে রে রে করে তেড়ে আসে তৃণমূলের জনা পঞ্চাশেক যুবক। এসেই শাসানি— ‘‘উঠে পড় রাস্তা থেকে। তা না হলে...।’’ কথা শেষ হল না মারধর শুরু। অবরোধকারীদের দিকে তেড়ে গেল তারা। পাল্টা তাড়া করল বিরোধীরাও। শুরু হয় দু’পক্ষের হাতাহাতি। বেরিয়ে এল ছোট ছোট লাঠি। সংঘর্ষে তৃণমূলের দু’জন, সিপিএমের তিন জন জখম হন। এত ক্ষণ ভূত তাড়ানোর ওঝাদের দেখা মেলেনি। এ বার খবর পেয়ে পুলিশ এল ঘটনাস্থলে। ধাক্কাধাক্কি শুরু হয় তাদের সঙ্গেও। এরই মধ্যে এল কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরাট
দল। কোনও কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুরু হয় লাঠি চার্জ। মূহুর্তের মধ্যে এলাকা ফাঁকা।

এ দিন তৃণমূল প্রার্থী রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাস আবার অভিযোগ করলেন, কেন্দ্রীয় বাহিনী সাধারণ ভোটারদের ভোট দিতে দিচ্ছে না। অথচ টানা দু’ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও কোনও ভোটারকে ফিরে যেতে দেখা যায়নি। এক সময় পরিস্থিতি সামাল দিতে আরপিএফের অ্যাসিট্যান্ট কমান্ডান্ট অজয় অধিকারী এগিয়ে এসে রমেন্দ্রনাথবাবুকে বলেন, ‘‘আপনি একজন দায়িত্বশীল ব্যাক্তি, এই ধরনের অভিযোগ করবেন না। বাহিনী নিরপেক্ষ ডিউটি করছে।’’ প্রার্থীর অভিযোগে অজয়বাবু বললেন, ‘‘আপনার ভোটারদের পাঠান। কিন্তু তাঁরা যেন আসল ভোটার হয়।’’ থতমত খেয়ে রমেন্দ্রনাথবাবু পার্টির ছেলেদের নির্দেশ দিলেন, ভোটারদের পাঠাতে। কিন্তু পুলিশ সূত্রে খবর, প্রার্থীর নির্দেশে কোনও ভোটারই আসেনি।

দিনভর দেখা গেল এই একই দৃশ্য। আর মুহুর্মুহু ভুতুড়ে সব কাণ্ডকারখানার অভিযোগ। গয়েশপুরের একটি বুথে জওয়ানরা জানালেন, দুই যুবক ভোট দিয়ে গিয়ে অন্য ভোটার স্লিপ নিয়ে ফের ভোট দিতে এসেছিল। তাদের নাম মাণিক বারুই এবং নির্মল মধু। তাদেরকে গাড়িতে তোলার সময় এগিয়ে আসেন এক মহিলা। নিজের পরিচয় দেন ১২ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর বলে। পুলিশকে বলেন, এরা আমার লোক, ছেড়ে দিন। কেন্দ্রীয় বাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার জানিয়ে দেন, সরে যান। না হলে আপনাকেও পুরে দেওয়া হবে।

একই কায়দায় পরে ফের ভোট দিতে আসেন বেশ কিছু যুবক। জওয়ানরা আটকালে উল্টে গলা চড়ায় তারা, ‘‘একবার বাইরে চল। দেখছি তুই কতবড় ফোর্স।’’ আঙুলে সদ্য লাগানো ভোটের কালি নিয়ে আর এক ভূতের আবার দাবি, তিনি ফের ভোট দেবেন। কিন্তু, কার ভোট? উত্তর এল, ‘‘কত লোক তো মরে হেজে গিয়েছে। তাদেরই কারও এক জনের নামে দিলেই হল।’’

কল্যাণীর সিপিএম প্রার্থী অলকেশ দাসের কথায়, ‘‘মানুষকে ওরা ভরসা করতে পারল না। তাই এই ভোট-লুট।'' তৃণমূল প্রার্থী রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাস অবশ্য সবটাই স্বীকার করে নিয়েছেন। কিন্তু এ-ও জানিয়েছেন, এ সবের সূত্রপাত ৩৪ বছরের বাম আমলে। তিনি
বলেন, ‘‘গয়েশপুরে অনেকের মধ্যে আগের রোগ থেকে গিয়েছে। তারা আমাদের দলে এসেছে বটে। কিন্তু দলের তরফ থেকে এমন কোনও নির্দেশ দেওয়া হয়নি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন