রাজনীতির প্যাঁচে পড়ে তাঁকে পুরপ্রধানের নিশ্চিত কুর্সি খোয়াতে হয়েছিল। ২৬ বছর আগের সেই ঘটনার পিছনে যিনি ছিলেন, এ বার বিধানসভা ভোটে তাঁকেই পর্যুদস্ত করলেন এতদিন রাজনীতি থেকে গুটিয়ে থাকা কংগ্রেস প্রার্থী তুষারকান্তি ভট্টাচার্য। আড়াই দশকের বিষ্ণুপুরের পুরপ্রধান শ্যাম মুখোপাধ্যায়কে তাঁর নিজের শহরের ভোটেই পর্যুদস্ত করে বাজিমাত করলেন তুষারবাবু। দলের কর্মীদের মতে, তুষারবাবু এ দিন ২৬ বছর আগের সেই বিশ্বাসঘাতকতার ‘মধুর প্রতিশোধ’ নিলেন।
এই কেন্দ্রে যে এ বার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে, তা দু’দলের মিছিল কিংবা সভায় ভিড়ের বহরেই টের বাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু ফল যে এমন হবে তা পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদরাও অনেকে আঁচ করতে পারেননি। শ্যামবাবুও নয়। এ দিন সকালে বিষ্ণুপুরের কে জি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের গণনা কেন্দ্রে প্রথম রাউন্ডে ১,৭৫৪ ভোটে এগিয়ে যান শ্যামবাবু। এরপরে দ্বিতীয় রাউন্ডে যখন জানা গেল তিনি ৩, ১৫৯ ভোটে এগিয়ে রয়েছেন, তখনই তৃণমূল শিবিরে শুরু হয়ে গেল সবুজ আবিরের উড়োউড়ি, ফাটল দেদার পটকা।
খবর পেয়ে গণনাকেন্দ্রে চলে এলেন বিদায়ী মন্ত্রী শ্যামবাবু। গায়ে সবুজ জামা। হাসিমুখে মিডিয়া সেন্টারের সামনে চলে আসেন। খচাখচ শব্দে ঝলসে ওঠে সাংবাদিকদের ক্যামেরা। জয় প্রত্যাশিত বলে ধরে নিয়ে দু’কথা শুনিয়েও দিলেন। মাথা উঁচু করে গটগট করে গণনাকেন্দ্রে তিনি ঢুকে গেলেন। তারপর থেকেই ছন্দপতন। কখনও তিনি এগিয়ে যান, কখনও বা জোট প্রার্থী তুষারবাবু তাঁকে টেক্কা মারেন ভোটের গণনায়। কিন্তু সপ্তম রাউন্ডে ব্যবধান চওড়া হতেই ফিকে হয়ে আসে তৃণমূল কর্মীদের উচ্ছ্বাস। ততক্ষণ পর্যন্ত অবশ্য শ্যামবাবু আর গণনাকেন্দ্রে বসে থাকেননি। পিছিয়ে যাওয়ার খবর শুনেই তিনি বেরিয়ে আসেন। মাথা নিচু করে। সংবাদমাধ্যম ফের তাঁকে ছেঁকে ধরে— ‘‘দাদা এ কি হল?’’ শ্যামবাবু শান্তস্বরে শুধু বলেন, ‘‘দলীয় অন্তর্ঘাত, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। বিজেপি কিছু ভোট টেনে নেওয়াতেই আমি হারছি।’’
তাঁর বিশ্লেষণ যে মিথ্যা নয়, তা বিষ্ণুপুর শহর তৃণমূলের হাঁড়ির খবর যাঁরা রাখেন, তা মেনে নিয়েছেন। দল সূত্রেই জানা যাচ্ছে, বিষ্ণুপুর শহরের ১৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে অধিকাংশ জায়গাতেই তিনি হেরে গিয়েছেন। এর কারণ হিসেবে তাঁরই সঙ্গে ১৯৯০ সাল থেকে উপপুরপ্রধান হিসেবে থাকা বুদ্ধদেব মুখোপাধ্যায় ও তাঁর ঘনিষ্ঠ কিছু কাউন্সিলরের মনোমালিন্যের কথা সামনে আসছে। ইদানীং শ্যামবাবুর বিরুদ্ধেই শহর তৃণমূলের একাংশকে আড়ালে-আবড়ালে কথা বলতে শোনা যাচ্ছিল। এমনকী কংগ্রেস প্রার্থীর হয়ে প্রচারে নামতেও কোনও কোনও কাউন্সিলরকে দেখা গিয়েছে। যদিও এ দিন ফল বেরোনোর পরে বুদ্ধদেববাবুরা দ্বন্দ্ব বা অন্তর্ঘাতের অভিযোগ মানতে চাননি।
বিষ্ণুপুর শহরের সঙ্গে শ্যাম মুখোপাধ্যায়ের নাম যেন সমার্থক হয়ে গিয়েছিল। বিষ্ণুপুর বিধানসভা কেন্দ্র দীর্ঘদিন বামেদের দখলে থাকলেও অত্যাশ্চর্য ভাবে পুরসভা কিন্তু বরাবর শ্যামবাবুর দখলেই রয়ে যেত। কিন্তু এ বার কী মিরাক্যাল হল?
বিষ্ণুপুরের ভাবী বিধায়ক তুষারবাবুর মন্তব্য, ‘‘শ্যামবাবু জগদ্দল পাথরের মতো বিষ্ণুপুরে ছিলেন। মানুষই তাঁকে ক্ষমতায় এনেছিল। কিন্তু উন্নয়ন তিনি করেননি, শুধু আখের গুছিয়েছেন। মানুষই তাই তাঁকে সরিয়ে দিল।’’ গত ২৬ বছরের নানা অপমানের বদলা কি নিলেন? তাঁর সংযত মন্তব্য, ‘‘ সে সব অপমানের কথা আমি ভুলিনি।’’
এ দিন ফলের গতি প্রকৃতি টের পেয়েই অভিযোগ ওঠে শ্যামবাবুর অনুগামীরা সকালে চকবাজার এলাকায় বিরোধী দলের কর্মীদের মারধর করেন। তবে শ্যামবাবুরা তা মানতে চাননি।