প্রবেশ নিষেধ, বাড়িতেই ভোট-কন্ট্রোলে জ্যোতিপ্রিয়

রাখঢাক না রেখেই সাতসকালে স্পষ্ট বললেন, ‘‘গোটা জেলার ভোটটা আমি কন্ট্রোল করব। গোপন নির্দেশ দিতে কখনও আমাকে বলতে হবে, ভোটটা কর। ওখানে যা, এটা কর, ওটা কর।’’

Advertisement

দেবারতি সিংহ চৌধুরী

হাবরা শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৪৯
Share:

রাখঢাক না রেখেই সাতসকালে স্পষ্ট বললেন, ‘‘গোটা জেলার ভোটটা আমি কন্ট্রোল করব। গোপন নির্দেশ দিতে কখনও আমাকে বলতে হবে, ভোটটা কর। ওখানে যা, এটা কর, ওটা কর।’’

Advertisement

ওই নির্দেশের গন্তব্য কোথায় আর কাদেরই বা নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, সে কথা যে ‘গোপন’ই রবে, তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনার পর্যবেক্ষক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক নির্দ্বিধায় জানালেন সে কথাই। সে জন্যই সোমবার ভোট শুরুর পরেই আনন্দবাজারের সাংবাদিক তাঁর হারবার বাড়িতে ঢুকতে গেলে ফোনেই জানালেন, ‘‘আমি কী ভাবে ভোটটা কন্ট্রোল করব, কাকে কী বলব, তা আনন্দবাজারের সাংবাদিকের সামনে করব নাকি! আমার কন্ট্রোল রুমের ত্রিসীমানায় কোনও সাংবাদিককে থাকতে দেব না। এটাই দলের নির্দেশ।’’

২০১৪-র লোকসভা ভোটের দিন মধ্যমগ্রামের পার্টি অফিসে বসে ‘ভোট কন্ট্রোল’ করেছিলেন জ্যোতিপ্রিয়বাবুই। কিন্তু সে দিন অবশ্য তাঁর ধারেকাছে সাংবাদিকদের যাওয়া নিয়ে এমন নিষেধাজ্ঞা ছিল না!

Advertisement

রবিবার সন্ধ্যায় জ্যোতিপ্রিয়বাবুই বলেছিলেন, সোমবার দিনভর তিনি হাবরা স্টেশন সংলগ্ন মগরা রোডের বাড়িতেই থাকবেন। সে জন্য ওই বাড়িতেই যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রাত পোহাতেই উত্তর ২৪ পরগনার ৩৩টি বিধানসভা কেন্দ্রের ‘ম্যানেজার’ জ্যোতিপ্রিয়বাবুর এমন মন্তব্য এই গুরুত্বপূর্ণ জেলা নিয়ে শাসক দলের উদ্বেগই স্পষ্ট করে দিল!

হাবরা বা সংলগ্ন অশোকনগর, আমডাঙায় গত লোকসভা, পুরভোটের মতো এ দিন তেমন কোনও গোলমাল হয়নি ঠিকই। কিন্তু জ্যোতিপ্রিয়বাবুর ‘ভোট করানোর’ নমুনা বেলা গড়াতেই প্রকাশ্যে এল। জ্যোতিপ্রিয়বাবুর বাড়ি ছাড়িয়ে মিনিট কয়েক দূরেই বাণীপুর মহিলা আইটিআই ক্যাম্পাসে দলে দলে ভোটাররা এলেন তৃণমূল কর্মীদের টোটো, অটো, মিনি ম্যাটাডোরে চেপে। ভোট দিয়ে ফের ফিরতি পথে বাড়িও গেলেন সেই যানবাহী হয়েই।

দিন দশেক আগে থেকেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে তৃণমূল কর্মীরা তাঁদের গাড়ি করে নিয়ে আসার ‘টোপ’ দিয়েছিল বলে অকপটেই জানালেন মধ্যহাড়িয়া পদ্মাপল্লির বাসিন্দারা। গাড়ি করে আনার সুবাদে ভোটও কি তৃণমূলকেই দিলেন? আলটপকা প্রশ্নের জবাবে এক মহিলা ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলেও ফেললেন। পাশে দাঁড়ানো অন্য এক মহিলা অবশ্য সতর্ক, ‘‘গাড়ি করে এনেছে বলে ভোটটা ওদেরই দেব নাকি!’’ বাণীপুরের ওই বুথচত্বরে দিনভরই নজরে পড়ল তৃণমূল কর্মীদের জটলা। বুথের দোরগোড়ায় বাইকবাহিনীর টহল আর কর্মীদের জমায়েত দেখেও তাদের ছত্রভঙ্গ করতে দেখা গেল না কেন্দ্রীয় বাহিনীকে। একই চিত্র ওই বুথ পেরিয়ে আসরাবাদ শিশু বিদ্যামন্দিরের সামনেও। স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর নিজে বুথের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে সেখানে ভোট করিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠল।

ভোট করাতে শুধু বাড়ি থেকে লোক নিয়ে আসাই নয়। রবিবার সন্ধ্যা থেকেই হাবরা শহরের অল্পবিত্ত ভোটারদের বাড়ি বাড়ি তৃণমূল মাংস-ভাত, বিরিয়ানি ভোজ পৌঁছে দিয়েছে বলে অভিযোগ তুলল স্থানীয় সিপিএম। বাণীপুর লাগোয়া বিদ্যুৎ সঙ্ঘের মাঠ, নবজাগরণ পল্লী, কইপুকুরের মিলন সঙ্ঘের সামনে রীতিমতো পিকনিকের মেজাজে খাওয়া-দাওয়া হয়েছে বলে জানালেন এলাকার লোকেরাই। কোথাও কোথাও আবার দেদার জোড়াফুল আঁকা গেঞ্জি, ছাতাও বিলি হয়েছে।

হাবরা পুরসভার ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম কাউন্সিলর প্রসেনজিৎ দত্ত বললেন, ‘‘তৃণমূল ভোটারদের লোভ আর ভয় দেখিয়ে বুথে নিয়ে গিয়েছে।’’ তাঁরা যে প্রতিরোধ করতে পারেননি, তা স্বীকারও করেন প্রসেজিৎবাবু। একই ঘটনা ঘটেছে হাবরার ইছাপুরের গ্রামেও। শহুরে মধ্যবিত্ত ভোটারদের কাছে অবশ্য তেমন ভাবে কোনও ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ শোনা যায়নি।

সারা দিন বুথে বুথে ঘুরে সিপিএম প্রার্থী আশিসকণ্ঠ মুখোপাধ্যায় দিনের শেষে অভিযোগ করলেন, ‘‘কয়েকটা বুথে তৃণমূলের কর্মীরা জড়ো হয়েছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীকে দেখলেই পালিয়ে যাচ্ছে। আবার বাহিনী সরতেই পুনর্মূষিক ভব!’’

ঝলসানো দুপুর পেরিয়ে পড়ন্ত বিকেলেও হাবরার বুথে বুথে দীর্ঘ লাইন। কিন্তু মগরা রোডের সেই বাড়িটার দরজা তখনও বন্ধ। বাইরেটাও সুনসান। ভিতরে ঢোকার অনুরোধ নিয়ে বিকেল চারটে নাগাদ জ্যোতিপ্রিয়বাবুকে ফোন করলে মিনিট পনেরো পরে সেখানে যেতে বললেন। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় পরে বাড়ির সামনে পৌঁছে ফোন করলে বাড়ির দরজা খোলার জন্য সাড়া দিলেন না জ্যোতিপ্রিয়বাবু। ফোনই আর ধরলেন না! দিনভর বাড়িবন্দি থেকে ‘ভোট কন্ট্রোল’ করেও উত্তর ২৪ পরগনা নিয়ে তৃণমূলের আতঙ্ক কাটল না বলেই কি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন