উপকূলে উদাসীন বাংলা। উদাসীন উপকূলের জনজীবন ও পরিবেশ নিয়ে। উপকূলের ভোট নিয়ে অবশ্য শাসক শিবিরে উদাসীনতা নেই। তাই উপকূল পর্যটন নিয়ে ঢালাও প্রতিশ্রুতি তাদের নির্বাচনী ইস্তাহারে।
যেমন:
• দিঘা-মন্দারমণির প্রভূত উন্নয়ন হবে।
• ‘বন্যপ্রাণ উদ্যান’ হচ্ছে সুন্দরবনের ঝড়খালিতে।
• সাগরদ্বীপে সৈকত-পর্যটনকে টেনে তোলা হবে বিশ্ব-মানে। ইত্যাদি...।
প্রতিশ্রুতির ঢক্কানিনাদের মধ্যে প্রশ্ন উঠছে, উপকূল এলাকা ও জনজীবন বাঁচাতে এ রাজ্যের সরকারের আদৌ কোনও সদিচ্ছা আছে কি? বিরোধী শিবির নয়, এই প্রশ্ন তুলেছে কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রক। আরও স্পষ্ট করে বললে ওই মন্ত্রকের একটি হলফনামা।
কলকাতায় ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল বা জাতীয় পরিবেশ আদালতের পূর্বাঞ্চলীয় বেঞ্চ সুন্দরবনের পরিবেশ দূষণের মামলায় পরিবেশ মন্ত্রকের কাছে জানতে চেয়েছিল, বঙ্গ উপকূলের পরিবেশ রক্ষায় কী ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে?
কোনও পরিকল্পনাই যে নেই, তার দায়ভার সরাসরি রাজ্যের ঘাড়েই চাপিয়ে দিয়েছে কেন্দ্র। পরিবেশ মন্ত্রকের আইনজীবী গোরাচাঁদ রায়চৌধুরীর দাখিল করা হলফনামায় বলা হয়েছে, ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে উপকূলের পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে একটি পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে বলা হয়েছিল। সময় দেওয়া হয় ২৪ মাস। সেই মেয়াদের পরেও সময়সীমা বাড়িয়ে করা হয়েছিল চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি। কিন্তু পাঁচ বছর পরেও রাজ্য সরকার সেই পরিকল্পনা জমা দিয়ে উঠতে পারেনি।
রাজ্য শুধু উদাসীন নয়, এই ব্যাপারে তাদের অনুভূতি যে কার্যত অসাড়, কেন্দ্রের হলফনামায় সেটা পরিষ্কার। পরিবেশ মন্ত্রক সূত্রের খবর, এ বিষয়ে তাগাদা দিতে ডিসেম্বরে এবং গত ফেব্রুয়ারিতে রাজ্যকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। তার কোনও উত্তর মেলেনি। ২ মার্চ একটি ই-মেলও পাঠানো হয়েছিল। উত্তর মেলেনি তারও। সেই সব চিঠি এবং ই-মেলের প্রতিলিপিও হলফনামার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
রাষ্ট্রপুঞ্জের সংস্থা আইপিসিসি এবং অন্যান্য পরিবেশ গবেষণা সংস্থার রিপোর্ট বলছে, বিশ্ব উষ্ণায়ন আর জলবায়ু বদলের ফলে উপকূল এলাকা বিপন্ন হয়ে পড়ছে। এক দিকে সাগরের জলতল বাড়ছে, তেমনই বাড়ছে ঘনঘন ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ার আশঙ্কা। পরিবেশবিদেরা বলছেন, এই পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা না-থাকলে উপকূল এলাকার জনজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সমস্যায় পড়বেন উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূলবর্তী এলাকার বাসিন্দারা। সম্ভাব্য বিপর্যয়ের মোকাবিলায় ‘কোস্টাল জোন ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান’ বা উপকূল রক্ষায় বিশেষ পরিকল্পনা প্রয়োজন। ‘‘তা না-করে পর্যটনে ঝাঁপালে বিপদ হতে পারে,’’ মন্তব্য রাজ্যের পরিবেশ দফতরের প্রাক্তন বিজ্ঞানী সোমনাথ ভট্টাচার্যের।
পাঁচ বছরেও ওই পরিকল্পনার কাজ শেষ করা গেল না কেন? জবাব এড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বলটা ঠেলে দিচ্ছে চেন্নাইয়ের একটি সংস্থার কোর্টে। রাজ্যের পরিবেশ-সচিব চন্দন সিংহের বক্তব্য, চেন্নাইয়ের ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর সাসটেনেবল কোস্টাল জোন ম্যানেজমেন্ট’ সংস্থাকে গোটা দেশের ‘হাইটাইড লাইন’ (জোয়ারের জল যত দূর পর্যন্ত যায়) চিহ্নিত করার দায়িত্ব দিয়েছিল কেন্দ্র। সেই তথ্য না-পাওয়ায় উপকূল এলাকার জন্য নির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করা যায়নি।
যদিও পরিবেশ দফতরের একাংশ বলছে, ২০১১ সালে এ ব্যাপারে যে-নির্দেশিকা জারি করা হয়েছিল, তাতে রাজ্যের কাজ ঠিকঠাক হয়েছে কি না, সেটা দেখার দায়িত্বে ছিল চেন্নাইয়ের ওই সংস্থা। তাদের তথ্য দেওয়া না-দেওয়ার প্রশ্নটি এ ক্ষেত্রে অবান্তর।
উপকূল রক্ষায় যথাযথ পরিকল্পনা তৈরি করা যায়নি কেন, সেই ব্যাপারে আরও কিছু কারণ শোনা গিয়েছে পরিবেশ দফতরের অন্দরে। একটি সূত্রের খবর, ওই পরিকল্পনা তৈরি নিয়ে গোড়া থেকেই এই ধরনের কাজে অভিজ্ঞ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আমলাদের বিরোধ শুরু হয়। প্রয়োজনীয় নথিপত্র পাওয়া যায়নি বলে বহু বার অভিযোগ জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। পরিবেশ দফতরের এক কর্তা জানান, এই দ্বন্দ্বে জুড়ে দেওয়া হয় তিন জনের একটি বিশেষজ্ঞ দলকেও। প্রশাসনিক কাজের দায়িত্বে থাকা এক অফিসারও বিজ্ঞানীদের কাজে নাক গলাতেন। অভিজ্ঞ ও পেশাদার বিজ্ঞানী দলের অনেকে তাই কাজ ছেড়ে দেন বলেও অভিযোগ।
পরিবেশ দফতরের অনেকেই বলছেন, উপকূল এলাকার উন্নয়নে রাজ্যের মনোভাব কী, বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্টেও তা ফুটে উঠেছে। ‘ইন্টিগ্রেটেড কোস্টাল জোন ম্যানেজমেন্ট’ প্রকল্প রূপায়ণে রাজ্যের ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বিশ্বব্যাঙ্কের কর্তারা। কারণ, পাঁচ বছরে এক গুচ্ছ কাজ করার কথা থাকলেও একটি ছাড়া অন্যগুলো শেষ করে উঠতে পারেনি রাজ্য।
‘‘এ বার উপকূলের পরিবেশ রক্ষার পরিকল্পনাতেও রাজ্যের সেই গা-ছাড়া মনোভাবটাই ফুটে উঠেছে’’, মন্তব্য এক পরিবেশকর্মীর।
আর্সেনিক নিয়ে কমিটি
রাজ্যে আর্সেনিক-সমস্যার মোকাবিলা কী ভাবে করা উচিত, সেই বিষয়ে পরামর্শের জন্য একটি বিশেষ কমিটি গড়ল জাতীয় পরিবেশ আদালত। সোমবার কলকাতায় আদালতের চেয়ারপার্সন, বিচারপতি স্বতন্ত্র কুমারের নেতৃত্বাধীন বিশেষ বেঞ্চ নির্দেশ দিয়েছে, কমিটিতে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের সচিব, খড়্গপুর আইআইটি-র এক অধ্যাপক, রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অফিসার, কেন্দ্রীয় ভূ-জল পর্ষদের প্রতিনিধি এবং এসএসকেএম হাসপাতালের এক জন চিকিৎসককে রাখতে হবে। মামলার আবেদনকারী পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত জানান, প্রয়োজনে আরও এক জন বিশেষজ্ঞকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। ওই কমিটি আর্সেনিক-কবলিত এলাকা পরিদর্শন করে জলের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করবে। ‘সিল’ করে দেবে আর্সেনিক-দূষিত নলকূপ। সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যও পরীক্ষা করা হবে। আর্সেনিক-কবলিত এলাকায় ট্যাঙ্কারে পানীয় জল পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জেলাশাসকদের।