মুখে যতই বৈরিতা থাকুক, দায় রয়েছে সমঝোতার! দু’পক্ষেরই। তাই ভোটের ফল প্রকাশের পরেই ভবিষ্যতে বিজেপির দিকে সাহায্যের হাত বাড়ানোর সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিলেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্য দিকে তৃণমূল নেত্রীকে তো সরাসরি এনডিএ-তে আমন্ত্রণই জানিয়ে ফেললেন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ। ভোট-প্রচারে রাজ্যে এসে খোদ নরেন্দ্র মোদী কটাক্ষ করে বলেছিলেন, ‘দিদি আপনি বদলে গেছেন।’ ভোটের ফল বেরোতে বরং বদলে গিয়েছে সেই মোদীর সুর। ফোন করে তিনি অভিনন্দন জানিয়েছেন মমতাকে।
প্রধানমন্ত্রীর কটাক্ষ সত্ত্বেও মোদী-দিদি সখ্য নিয়ে জল্পনা আগাগোড়া তুঙ্গে ছিল ভোট ময়দানে। এমনকী, বৃহস্পতিবার ফলপ্রকাশের পরেও সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, ‘‘১০-১২টি আসনে বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলের সমঝোতা হয়েছে।’’ একই অভিযোগ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর। ‘‘আমরা বারবার বলছি দিদি-মোদী একই। ভোটের ফলেই তা আবার প্রমাণিত।
যেখানে বিজেপির ভোট কমেছে, সেখানে তৃণমূলের ভোট বেড়েছে। দিদিভাই খাল কেটে বাংলায় সাম্প্রদায়িকতার কুমির এনেছেন!’’ মন্তব্য অধীরের।
তাঁদের এই অভিযোগের সারবত্তা এ দিন মমতা এবং অমিত শাহ নিজেরাই প্রমাণ করে দিয়েছেন বলে দাবি করছেন বিরোধীরা। রাজ্যসভায় বিভিন্ন বিল পাশে বিজেপি সরকারকে তৃণমূলের সমর্থন নিয়ে প্রশ্নের জবাবে এ দিন মমতা বলেন, ‘‘বিজেপির সঙ্গে আমাদের মতাদর্শের ফারাক আছে। আমরা বিজেপির সঙ্গে যেতে পারব না। তবে কিছু কিছু বিষয় আছে, যেমন আমাদের ইস্তাহারেই জিএসটি বিলে সমর্থন করার কথা আছে, এ রকম সমর্থন আমরা দেব।’’ এখানেই শেষ নয়। আরও এক ধাপ এগিয়ে তৃণমূল নেত্রীর সোজাসাপ্টা কথা, ‘‘কিছু কিছু বিষয় আছে, যদি তা জনস্বার্থে হয়, তখন সেটা আমরা ভেবে দেখব।’’
মমতা যখন কালীঘাটে এই কথা বলছেন, তখন দেশের উন্নয়নের স্বার্থে তিনি এনডিএ-তে আসতে চাইলে তাঁকে স্বাগত জানিয়েছেন বিজেপি সভাপতি। সকাল থেকে দিল্লিতে বসে মোদী-অমিতেরা পাঁচ রাজ্যের ফলাফলের উপরে নজর রাখছিলেন। ছবি স্পষ্ট হতেই মমতাকে ফোন করে অভিনন্দন জানান মোদী, অরুণ জেটলিরা। তার কিছু ক্ষণ পরে সাংবাদিক সম্মেলনে সনিয়া গাঁধীর প্রতি মমতার তিক্ততা আর তুলনামূলক ভাবে বিজেপির প্রতি নরম মনোভাব নজর এড়ায়নি অমিতদের। বিকেলে দলের সভাপতিকে প্রশ্ন করা হয়, তা হলে কি ভবিষ্যতে মমতাকে এনডিএ-তে স্বাগত জানাবে বিজেপি? জবাবে অমিত বলেন, ‘‘আমি ইতিমধ্যেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অভিনন্দন জানিয়েছি। দেশের উন্নয়নের জন্য যাঁরা সঙ্গে আসতে চান, তাঁদের সকলকে স্বাগত।’’
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, দিদি ও মোদী, দু’পক্ষেরই এখন দু’জনকে প্রয়োজন। সারদা-নারদা নিয়ে কেন্দ্রের বিভিন্ন সংস্থার তদন্তের কারণে তৃণমূলের মোদী-নির্ভরতা রয়েছে। তা ছাড়া মমতা জানেন, এই বিপুল জয়ের পর রাজ্যে সুশাসন কায়েম করা এবং উন্নয়নের কর্মসূচি রূপায়ণের বড় দায়ও রয়েছে তাঁর। কেন্দ্রের সরকারের সঙ্গে সমঝোতা ও সমন্বয় করে চলা ছাড়া একা তা করে দেখানো সম্ভব নয়।
অন্য দিকে, কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে মমতার দূরত্বের সুযোগ নিতে চাইছেন অমিতরা। কারণ, তৃণমূলকে পাশে পেলে রাজ্যসভায় তাঁদের সুবিধা হবে। তা ছাড়া, কংগ্রেস দুর্বল হয়ে যেতেই নীতীশ কুমারের মতো নেতারা মোদী-বিরোধী জোটের মুখ হতে চাইছেন। মমতা বা জয়ললিতা যাতে সেই জোটে সামিল হয়ে না যান, তার জন্য আগেভাগেই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে রাখতে চাইছে বিজেপি।
বিজেপি-কে স্বস্তি দিয়ে এ দিন বাম-কংগ্রেস জোটকে তীব্র কটাক্ষ করেছেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে রাজ্য রাজনীতিতে সব চেয়ে বড় ভুল করেছে সিপিএম! আর জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতে কংগ্রেস ভুল করেছে।’’ দু’টো দলই তাদের ‘চরিত্র ও আদর্শ’ বিসর্জন দিয়েছে বলে দাবি করে মমতার মন্তব্য, ‘‘প্রকাশ কারাটজিকে প্রশ্ন করুন, কেন কেরলে কুস্তি আর বাংলায় দোস্তি করলেন?’’ তা হলে এর পরে ২০১৯ সালে কী করবেন? মমতার কৌশলী জবাব, ‘‘ভবিষ্যতের রাজনীতি দেশের মানুষ ঠিক করবে। ধারাবাহিকতা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন কোনও শক্তি তৈরি হতে পারে। চিরকাল কেউ তো একলা চলে না! তার জন্যে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে!’’