রাজা কোথায়? পোস্টার বিষ্ণুপুরে

সেই হোর্ডিংগুলো হঠাৎ উধাও! অথচ বিষ্ণুপুর শহরের ভাঙাচোরা গলি বা রাজপথের মোড়ের বাঁকে ক’দিন আগেও জ্বলজ্বল করছিল সেই হোর্ডিং। বিদায়ী মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় মুখে চওড়া হাসি নিয়ে বসে রয়েছেন এক রাজকীয় চেয়ারে।

Advertisement

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৬ ০৩:২১
Share:

এ রকম পোস্টার ছড়িয়ে রয়েছে শহর জুড়ে। ছবি: শুভ্র মিত্র

সেই হোর্ডিংগুলো হঠাৎ উধাও!

Advertisement

অথচ বিষ্ণুপুর শহরের ভাঙাচোরা গলি বা রাজপথের মোড়ের বাঁকে ক’দিন আগেও জ্বলজ্বল করছিল সেই হোর্ডিং। বিদায়ী মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় মুখে চওড়া হাসি নিয়ে বসে রয়েছেন এক রাজকীয় চেয়ারে। হোর্ডিং-এর গায়ে বড় বড় অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা ‘দ্য কিং ইন হিজ ওন কিংডম’। অর্থাৎ, ‘রাজা তাঁর নিজ রাজত্বে’!

১৯ তারিখ দুপুরের মধ্যেই অবশ্য স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, রাজা তাঁর বিধায়ক পদ খুইয়েছেন। বিষ্ণুপুর শহরই মুখ ফিরিয়েছে বিধায়ক শ্যামাপ্রসাদের থেকে! অথচ গত পুরভোটে ব্যাপক ক্ষমতা নিয়ে এই পুরশহরের মসনদে ফিরে আসার পরে শ্যামবাবুর অনুগামীরাই ওই হোর্ডিং লাগিয়েছিলেন শহরের বিভিন্ন জায়গায়। বিধানসভা ভোটের আগেও সেই সব হোর্ডিং থেকে গিয়েছিল। কিন্তু, বৃহস্পতিবার ভোটের ফল ঘোষণা হওয়ার পর থেকে সব থেকে সেই হোর্ডিংগুলির উপরেই নানা ‘উপদ্রব’ নেমে আসছে। উপরন্তু জুটেছে শহরবাসীর একাংশের টপ্পনী। রবিবার থেকে অবশ্য সব হোর্ডিং খুলে নেওয়া হয়েছে।

Advertisement

বরং শ্যামবাবু বিধায়ক পদ খোওয়াতেই শহরের বিভিন্ন জায়গায় পাল্টা হোর্ডিং দেওয়া শুরু হয়েছে। কোথাও জোটের হয়ে লড়া জয়ী কংগ্রেস বিধায়ক তুষারকান্তি ভট্টাচার্যের ছবি দিয়ে লেখা হয়েছে, ‘কোথায় গেল রাজা? কোথায় গেল রাজত্ব?’ নীচে লেখা, ‘মানুষই রাজা, মানুষেরই রাজত্ব’। কোথাও আবার বিষ্ণুপুরের উপ-পুরপ্রধান (যিনি তৃণমূলেরই) বুদ্ধদেব মুখোপাধ্যায়ের ছবির সঙ্গে বড় বড় করে লেখা, ‘দ্য কিং মেকার’! আবার কোনও কোনও এলাকায় ‘আমরাই নেতা বানাই’ লেখা দিয়ে পোস্টার পড়েছে।

কারা পোস্টার দিচ্ছে, কেউ জানে না। নীচে শুধু লেখা থাকছে, ‘সৌজন্যে চকবাজার’। শহরের বাসিন্দারা তাই মজা করে বলছেন, ভূতে এসে পোস্টার দিল নাকি! শ্যামবাবুর অনুগামীদের কিন্তু দাবি, অধুনা তাঁর বিরোধী হিসাবে পরিচিত বুদ্ধদেব-শিবিরেরই এই কাণ্ড। যে অভিযোগ আবার উড়িয়ে দিচ্ছে বুদ্ধ-শিবির। তুষারবাবুও দাবি করেছেন, বাম-কংগ্রেস জোটের পক্ষ থেকে এমন কোনও পোস্টার দেওয়া হচ্ছে না।

অথচ ঘটনা হল, পুর-শহর বাদ দিলে বিষ্ণুপুর বিধানসভা কেন্দ্রের গ্রামীণ অঞ্চল কিন্তু এবারও ঢেলে ভোট দিয়েছে শ্যামবাবুকে। প্রশ্নটা উঠেছে, আড়াই দশক মাথায় তুলে রেখে কী এমন ঘটল যে, ‘রাজা’কে হারিয়ে দিল তাঁরই খাসতালুক বিষ্ণুপুর শহর! সাধারণ মানুষ থেকে রাজনৈতিক মহল, সর্বস্তরেই এখন জোর চর্চা এ নিয়ে।

হারের প্রধান কারণ হিসাবে বাঁকুড়া জেলা তৃণমূলের একাংশেরই বক্তব্য, শ্যামবাবুর ‘অহংকার’ এক সময়ের তাঁর কাছের বৃত্তের বহু নেতা-কর্মীকেই আজ দূরে সরিয়ে দিয়েছে। এক সময় শ্যামবাবুর ডান হাত হিসেবে পরিচিত বুদ্ধদেব মুখোপাধ্যায়-সহ আরও কিছু তৃণমূল কাউন্সিলরকে এ বারর ভোটে শ্যামবাবুর হয়ে প্রচারে নামতেও দেখা যায়নি। এ দিকে শহরের রাস্তাঘাট থেকে বাসস্ট্যান্ড ও পরিকাঠামো, সব কিছু নিয়েই দীর্ঘদিন ধরে শ্যামবাবুর বিরুদ্ধে শহরের মানুষের মনে ক্ষোভ জমছিল। সেই ক্ষোভকে ভোটযন্ত্র পর্যন্ত টেনে আনায় বিক্ষুব্ধ নেতাদের হাত রয়েছে বলে মনে করছে তৃণমূলের একাংশ। বুদ্ধদেববাবুর নিজের অবশ্য দাবি, এ বার প্রচার থেকে শুরু করে গোটা ভোট প্রক্রিয়াতেই তাঁকে ও কিছু তৃণমূল কাউন্সিলরকে ব্রাত্য করে রাখা হয়েছিল। তাই তাঁরা পথে নামেননি।

শহরবাসীর বড় অংশও বিষ্ণুপুরের অনুন্নয়ন নিয়ে সরব হয়েছেন। এক প্রবীণ বাসিন্দার কথায়, “বিষ্ণুপুর জুড়ে ভাঙাচোরা রাস্তাগুলো ক্রমশ আরও ভেঙে পড়েছে। কিন্তু তার হাল ফেরাতে উদ্যোগী হননি পাঁচ বছরের মন্ত্রী এবং পুরপ্রধান শ্যামবাবু।’’ শহরের এক কলেজ পড়ুয়া যুবক আবার বলছেন, “বাঁকুড়া শহরে চোখে পড়ার মতো কাজ হয়েছে। আর আমাদের শহরে যেমন ত্রিফলা বাতি জ্বলে না, তেমনই সামান্য বৃষ্টিতে আঝও বাসস্ট্যান্ডে কাদার দাপটে পা রাখা দায়। রাস্তাঘাটের অবস্থা তো যত কম বলা যায়, ভাল।’’ শহরবাসীর একাংশের আরও অভিযোগ, গত পাঁচ বছরে মাটি ও জমি মাফিয়াদের দাপট দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন তাঁরা। ঐতিহাসিক বাঁধগুলির অনেকটা অংশই প্লট করে বেচে দিয়েছে মাফিয়ারা। কিন্তু, পুরসভা সব জেনেও উদাসীন ছিল।

তাই যদি হবে, তা হলে অনুন্নয়ন নিয়ে মানুষের ক্ষোভের প্রভাব পুরভোটে পড়েনি কেন? বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত বালুচরী শিল্পের এক তন্তুবায়ের জবাব, “শ্যামবাবুর যোগ্য বিকল্প এত দিন পাইনি। যা এবার জোটের মাধ্যমে পেয়েছি। তাই শহরের ভোটও উল্টো দিকে গিয়েছে।’’

বিষ্ণুপুর শহরের পরিকাঠামোর উন্নয়ন কেন হয়নি, তা নিয়ে এ বার মুখ খুলতে শুরু করেছেন তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিরাও। বিষ্ণুপুরের সাংসদ সৌমিত্র খাঁ জানিয়েছেন, শহরের বাসস্ট্যান্ড উন্নয়নের জন্য তিনি সাংসদ তহবিল থেকে প্রথম দফায় ৩০ লক্ষ টাকা এবং ২৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে শহরের জন্য একটি ভ্রাম্যমাণ শৌচাগার পুরসভাকে দিয়েছেন গত বছর। কাজ হয়েছে কিনা জানতে চাওয়ায় তিনি বলেন, “ওই শৌচাগার কিনেও ব্যবহার করা হচ্ছে না। বিষ্ণুপুর বাসস্ট্যান্ডের কাজ কতটা হল, সেটাও আমাকে কিছুই জানানো হয়নি।’’ জেলা তৃণমূলের সহ-সভাপতি তথা জেলা পরিষদের সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী বলেন, “শ্যামবাবু নিজে মন্ত্রী ছিলেন। তাই বিষ্ণুপুরের উন্নয়নের কাজ একা তিনিই দেখতেন। এর পরেও অনুন্নয়ন নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ কেন দানা বাঁধল, তা উনিই ভাল বলতে পারবেন।’’

শ্যামবাবু নিজে অবশ্য উন্নয়নের প্রশ্ন এড়িয়ে এই পরাজয়ের পিছনে দলের ‘অন্তর্ঘাত’ এবং বিজেপির বেশি ভোট টেনে নেওয়াকেই দায়ী করেছেন। তাঁর অনুগামীদের বক্তব্য, “অনুন্নয়নের অভিযোগ ডাহা মিথ্যা। শ্যামবাবুর আমলে অনেক কাজ হয়েছে। ঢেলে সাজা হয়েছে বিষ্ণুপুর হাসপাতালকে।’’

পালাবদল তো হল। প্রশ্ন উঠছে নতুন বিধায়ক শহরবাসীর অনুন্নয়নের ক্ষোভ মেটাতে পারবেন তো। তুষারকান্তিবাবুর আশ্বাস, “রাজা মহারাজাদের ব্যাপার-স্যাপার আলাদা। আমি সাধারণ মানুষ হয়েই থাকতে চাই। শহরের পরিকাঠামোর উন্নয়নই আমার প্রথম লক্ষ্য।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন