কেটে গিয়েছে পাক্কা তিন দিন। অথচ ফরমান জারি করেও সর্ষের মধ্যে থাকা ভূতের নাগাল পাচ্ছে না শাসক দল। বরং শাসকের ঘরে আতঙ্ক বাড়িয়ে দানা বাঁধছে বিদ্রোহের ইঙ্গিত!
গত ৫ মে শেষ দফায় ভোট মিটেছে পূর্ব মেদিনীপুরে। সে দিন হলদিয়ায় তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের ঠিকাকর্মীরা তাঁদের ভোটটা তৃণমূলকেই দিয়েছেন কি না, তা যাচাই করতে রীতিমতো নোটিস ঝুলিয়ে আসরে নেমেছেন দলীয় নেতৃত্ব। সত্যিই ওই কর্মীরা বুথে গিয়ে জোড়াফুলের প্রতীকে বোতাম টিপেছেন কি না, বুথ স্তরের তৃণমূল নেতৃত্বের কাছ থেকে সেই ব্যাপারে সিলমোহর-সহ চিঠি আনতে বলা হয়েছে। ৬ মে ওই নোটিস ঝোলানোর পরে তিন দিন পেরিয়ে গেলেও সাড়া মেলেনি এক জনের কাছ থেকেও!
আদৌ সাড়া মিলবে কি না, মিললেও ক’জনের কাছ থেকে, এখন সেই প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। কারণ যে কারখানায় নোটিস ঝোলানো হয়েছে, সেই আইওসি (ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন)-র হলদিয়া রিফাইনারির একাধিক ঠিকাকর্মীই বলছেন, ‘‘আমি কোন দল করব, সেটা ইউনিয়ন ঠিক করে দেবে না কি?’’ চিঠি দেবেন না বলেও জানিয়েছেন তাঁদের কেউ কেউ। হলদিয়া বিধানসভারই ভোটার, নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক আইওসি-র এমন এক ঠিকাকর্মীর কথায়, ‘‘৩০ বছর ধরে এই কারখানায় কাজ করছি। এমন আজব নির্দেশ শুনিনি! শুধু আমি নই, অনেকেই চিঠি দেবে না।’’
ফল বেরোনোর আগে নিজেদের ইউনিয়নের কর্মীরা দলকে ভোট দিয়েছেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে এমন ফরমান জারির নজির রাজ্য রাজনীতিতে বিশেষ নেই। এ বারের ভোট নিয়ে শাসক শিবির যে আতঙ্কে রয়েছে, এই পদক্ষেপেই তা স্পষ্ট বলে মনে করছে বিরোধীরা। তাঁদের বক্তব্য, মানুষের ‘নিঃশব্দ ভোট’ তৃণমূলকে চিন্তায় রেখেছে। তৃণমূল নেতাদের সংশয়, ঘরের ভোট আদৌ ঘরে আছে তো! সেই তথ্য যাচাই করতে গিয়েই শ্রমিকদের একাংশের মনোভাবের জেরে এ বার আরও আতঙ্কের মুখে তৃণমূল নেতারা। কাজের জায়গায় টান পড়তে পারে বুঝেও বুথ স্তরের নেতাদের কাছ থেকে আনুগত্যের শংসাপত্র নিয়ে আসার গরজ দেখাচ্ছেন না ঠিকা শ্রমিকদের একাংশ। বিরোধীদের বক্তব্য, শুধু হলদিয়া নয়, শাসকের হুকুমের কাছে মাথা নত না করার সাহস এখন দেখা যাচ্ছে অন্যত্রও।
এই পরিস্থিতিতে চাপ বাড়ানোরই কৌশল নিচ্ছেন ‘হলদিয়া রিফাইনারি টাউনশিপ মেনটেনেন্স কন্ট্র্যাক্টর্স ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন’-এর নেতারা। রবিবার বিকেল পর্যন্ত একটাও চিঠি আসেনি স্বীকার করে নিয়ে আইএনটিটিইউসি অনুমোদিত ওই ইউনিয়নের কার্যকরী সভাপতি তথা হলদিয়া পুরসভার চেয়ারম্যান দেবপ্রসাদ মণ্ডল বলেন, ‘‘যদি কেউ চিঠি না দেন, তা হলে বুঝব যে, তাঁরা সংগঠনে নাম লেখালেও আমাদের সমর্থক নন। তাঁদের সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হবে।’’ আর সংগঠনের সম্পাদক দীপেন্দু বেরা বলছেন, ‘‘আমরা তো ১২ মে-র মধ্যে চিঠি দিতে বলেছি। দেখা যাক!’’
শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করার ছবি এ বারের ভোট-পর্বে বারবার দেখা গিয়েছে। কোথাও হুমকি উপেক্ষা করে, কোথাও মার খেয়েও বুথমুখো হয়েছেন ভোটার। হলদিয়ায় ঠিকাকর্মীদের শাসক দলের ফরমান উপেক্ষা করার মধ্যেও সেই প্রতিরোধের ছায়াই দেখছেন বিরোধীরা। কারণ, আইএনটিটিইউসি-র কথা না শোনা মানে কাজ হারানোর আশঙ্কা। তা জেনেও শাসক দলের বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন ঠিকাকর্মীরা। এক কর্মীর কথায়, ‘‘কারখানায় আইএনটিটিইউসি-র ইউনিট খোলার সময় বড় মুখ করে বলা হয়েছিল, সিটু মানেই সিপিএম এবং আইএনটিটিইউসি মানেই তৃণমূল নয়। তা হলে কেন ভোটের সময় তৃণমূলের হয়ে খাটতে বলা হল?’’
আইওসি হলদিয়া রিফাইনারির আবাসন রয়েছে হলদিয়া টাউনশিপে। সেখানেই ওই ইউনিয়নের কর্মীরা ঠিকা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। তৃণমূলের ওই শ্রমিক সংগঠনে প্রায় তিনশো কর্মী রয়েছেন। কারখানা সূত্রে খবর, ভোটের পরে ৬ মে যখন ওই নোটিস ঝোলানো হয়, তখনই বহু ঠিকাকর্মী আপত্তি করেছিলেন। প্রকাশ্যে ক্ষোভও জানিয়েছিলেন কেউ কেউ। সে সবে আমল দেননি তৃণমূলের শ্রমিক নেতারা। যার পরিণাম, অনেক ঠিকাকর্মীই এখন চিঠি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। আইওসি-র সিটু নেতা দেবেশ আদক বলেন, ‘‘আমরা শ্রমিকদের বলেছি, এই ফরমানের বিরোধিতা করতে। তাঁরা যেন কোনও মতেই এমন অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করেন।’’ নিজেদের ইউনিয়নের কর্মীদের নিয়ে তৃণমূলের অন্দরে সন্দেহের বাতাবরণ কেন, তার আরও কিছু কারণ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। হলদিয়ার ভোটার, আইওসি-র এক ঠিকাকর্মী যেমন এ দিন জানান, তৃণমূলের ইউনিয়নে নাম লেখালেও ভোটের আগে থেকেই গোপনে তাঁরা সিটুর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছেন। তাই তৃণমূলের হয়ে প্রচারে যেতে বলা হলেও অনেকেই কৌশলে বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছিলেন। ওই ঠিকাকর্মীর কথায়, ‘‘এর পরেই তৃণমূল নেতাদের সন্দেহ হয় যে, সব কিছু হয়তো তাঁদের অনুকূলে নেই! আর ৫ তারিখ অনেকেই সকাল সকাল ভোট দিয়ে পার্টি অফিসে না গিয়ে বাড়ি চলে যাওয়ায় সন্দেহটা বাড়ে। তার পরেই এই ফরমান।’’
যা শুনে সিপিএমের পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক নিরঞ্জন সিহির দাবি, ‘‘গত পাঁচ বছরে হলদিয়ার শ্রমিকদের উপরে কম নির্যাতন করেনি তৃণমূল। ভোটেই তৃণমূল এর জবাব পাবে।’’ হলদিয়ার এই ঘটনা সামনে আসার পর থেকেই মুখে কুলুপ তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর। বিদ্যাসাগর কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এ দিন মেদিনীপুরে এসে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি তিনি। তবে আইএনটিটিইউসি-র জেলা কার্যকরী সভাপতি শিবনাথ সরকারের ব্যাখ্যা, ‘‘প্রতিটি দলের কিছু নিয়ম থাকে। দলের শাখা সংগঠনে থাকলেও তা মেনে চলতে হয়। এতে হুমকি, গা-জোয়ারির কোনও প্রশ্ন নেই।’’
(তথ্য সহায়তা: আনন্দ মণ্ডল, আরিফ ইকবাল খান ও সামসুদ্দিন বিশ্বাস)