গুলি-বোমায় উত্তপ্ত ডোমকল, ভোটের বলি এক সিপিএম কর্মী

শ’য়ে-শ’য়ে কোম্পানি আধাসেনা মোতায়েন হয়েছে। অথচ ভোটের দিনেই রক্ত ঝরল বাংলায়। এ বারের ভোটে এই প্রথম। ঝরল সেই মুর্শিদাবাদে যেখানে মাটি দখল করতে মরিয়া তৃণমূল। বৃহস্পতিবার সকালে, রাজ্যের ঘুম ভাল করে ভাঙারও আগে ডোমকলে লাশ পড়ে গেল এক সিপিএম কর্মীর।

Advertisement

সুজাউদ্দিন

ডোমকল শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৩৯
Share:

নিহত সিপিএম কর্মী তহিদুল মণ্ডল। বৃহস্পতিবার ডোমকলে সাকিউল্লা ইসলামের তোলা ছবি।

শ’য়ে-শ’য়ে কোম্পানি আধাসেনা মোতায়েন হয়েছে। অথচ ভোটের দিনেই রক্ত ঝরল বাংলায়।

Advertisement

এ বারের ভোটে এই প্রথম।

ঝরল সেই মুর্শিদাবাদে যেখানে মাটি দখল করতে মরিয়া তৃণমূল। বৃহস্পতিবার সকালে, রাজ্যের ঘুম ভাল করে ভাঙারও আগে ডোমকলে লাশ পড়ে গেল এক সিপিএম কর্মীর।

Advertisement

নিহতের নাম তহিদুল মণ্ডল (৪২)। সকাল সাড়ে ৭টা নাগাদ হরিদোবা গ্রামে বুথের কাছেই বোমা ছুড়ে, হাঁসুয়ার কোপ মেরে তাঁকে খুন করা হয়। অভিযোগের তির তৃণমূলের দিকে। যদিও তারা তা মানতে নারাজ।

সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমের মতে, ‘‘এই খুনের দায় মুখ্যমন্ত্রীকেই নিতে হবে। তিনি ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বুঝে নেওয়ার কথা বলছেন। দলীয় কর্মীদের উস্কানি দিচ্ছেন। এ সব তারই ফল।’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর কটাক্ষ, ‘‘ভূতের রাজত্বে বাস করছি আমরা। ভোট করাতে ভাড়াটে খুনিদের আনা হয়েছে। এ সবই তো ঘটবে!’’

সিপিএম ইতিমধ্যেই ডোমকলের ১৫টি বুথে পুনর্নির্বাচন দাবি করেছে। এ বার এই প্রথম তারা কোথাও ফের ভোট নেওয়ার দাবি তুলল। কংগ্রেসও ১০টি বুথে ফের ভোট নেওয়ার দাবি জানিয়েছে। যদিও রাত পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন সূত্রে কিছু জানানো হয়নি।

ভোটকে কেন্দ্র করে খুনোখুনি ডোমকলে নতুন কিছু নয়। বরং খুনের বদলা খুন দেখতেই অভ্যস্ত সীমান্ত ঘেঁষা এই এলাকা। এ বারও সেখানে সন্ত্রাস হতে পারে বলে আশঙ্কা ছিল সব মহলেই। তার অন্যতম কারণ, যুব তৃণমূলের জেলা সভাপতি সৌমিক হোসেনকে জিতিয়ে ওই এলাকায় কামড় বসাতে এ বার মরিয়া তৃণমূল।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সকাল ৬টার আগেই তহিদুল ভোটকেন্দ্রে যান সিপিএমের এজেন্ট হবেন বলে। পরে তাঁর স্ত্রী ভোট দিতে আসেন। স্ত্রীকে বাড়ি পৌঁছে দিতেই বুথ থেকে বেরোন তহিদুল। সেটাই কাল হয়। পাশের বাঁশবাগান থেকে বোমা উড়ে আসে। বোমার ঘায়ে বুথের সামনেই লুটিয়ে পড়েন তহিদুল। পর পর বোমা পড়তে থাকে। আততায়ীরা ছুটে এসে হাঁসুয়া দিয়ে কোপায় তাঁকে, রড দিয়ে মেরে পা ভেঙে পালিয়ে যায়। আত্মীয়-বন্ধুরা কোনও রকমে তাঁকে উদ্ধার করে টেনে-হিঁচড়ে ৭০০ মিটার দূরে রাস্তার ধারে নিয়ে যান। সেখানেই মৃত্যু হয় তাঁর। তহিদুল ছাড়াও জখম হয়েছেন দু’জন। পরে পাল্টা মারে কুচিয়ামোড়া দক্ষিণনগর ও ভগীরথপুরে তৃণমূলের লোকজনও জখম হন।

দিল্লিতে উপ-নির্বাচন কমিশনার সন্দীপ সাক্সেনা অবশ্য বলেন, ‘‘পোলিং বুথ থেকে প্রায় ৪০০-৫০০ গজ দূরে ওই হত্যাকাণ্ড হয়েছে। জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ওই ব্যক্তি পোলিং এজেন্ট ছিলেন না। তাঁর শরীরে গভীর ক্ষতচিহ্ন মিলেছে। বোমা মারারও অভিযোগ উঠেছে।’’ রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের কার্যালয় সূত্রে অবশ্য দাবি করা হয়েছে, তহিদুলের দেহে বোমা বা গুলির কোনও চিহ্ন ছিল না। সাক্সেনা বলেন, ‘‘ঠিক কী কারণে মৃত্যু হয়েছে তা ময়নাতদন্তের পরেই জানা যাবে।’’

এ দিন বুথের সামনে পৌঁছে দেখা যায়, বোমায় ঝলসানো মাটি। আর, চাপ চাপ রক্তের দাগ। রক্তে ভেজা জামাকাপড়। সিপিএমের ডোমকল জোনাল কমিটির সম্পাদক মুস্তাফিজুর রহমানের অভিযোগ, ‘‘সবার সামনে একটা লোককে খুন করাল তৃণমূলের নেতারা। এর জবাব মানুষ দেবে।’’ কংগ্রেস প্রার্থী আব্দুর রহমানের কথায়, ‘‘খুনের রাজনীতি করে তৃণমূল ক্ষমতায় আসতে চাইছে। কিন্তু সেটা করতে দেবে না মানুষ।’’

রাজ্যের বেশির ভাগ জায়গার মতো ডোমকলে বাম-কংগ্রেস জোট হয়নি। দু’পক্ষই প্রার্থী দিয়েছে। তবে এলাকায় তৃণমূলের উত্থান আটকানো বেশি জরুরি বলে মনে করছে দু’পক্ষ। সে কারণে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও বুথের বাইরে দু’পক্ষই এককাট্টা ছিল। মূল লক্ষ্য ছিল, সৌমিক-বাহিনীকে রিগিং করতে না দেওয়া। বুথের বাইরেই প্রতিরোধ গড়ে তোলা। গত তিন দফা ভোটের অভিজ্ঞতা বলছে, যেখানে প্রতিরোধ হয়েছে, সেখানেই মারমুখী হয়ে উঠেছে তৃণমূল। ডোমকলও তার ব্যতিক্রম নয়।

জেলা তৃণমূল সভাপতি মান্নান হোসেনের ছেলে সৌমিক দাবি করেন, ‘‘মৃতের পরিবারকে সমবেদনা জানিয়েও বলতে বাধ্য হচ্ছি, ঘটনাটি ঘটেছে কংগ্রেস-সিপিএমের নিজেদের লড়াইয়ে। শুনেছি, জোট না হওয়ায় দু’পক্ষের বচসা চলছিল।’’ মান্নানও বলেন, ‘‘আমাদের নামে মিথ্যা দোষ চাপানো হচ্ছে। নিজেদের গণ্ডগোলের জেরেই ওই খুন।’’ তবে এ ভাবে জোটকে আটকানো যাবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সিপিএমের আর এক পলিটব্যুরো সদস্য তথা রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। তিনি বলেন, ‘‘তহিদুলদের খুন করে তৃণমূল কিন্তু মানুষকে আটকাতে পারবে না। ওদের উৎখাতের জন্য শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়াই হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন