পুলিশের পাল্টা বাণে বিদ্ধ মদন-বাহিনীই

থরথর করে কাঁপছিলেন শুভরূপ মিত্র। রাগে না ভয়ে? উত্তেজনায় গলা বসে যাচ্ছিল মদন মিত্রের ছোট ছেলের। ফোনে কাউকে বলছিলেন, ‘‘পুলিশ কোনও কথা শুনছে না। ওরা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায় ও শান্তনু ঘোষ

কামারহাটি শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৩৮
Share:

হতাশ। কামারহাটির দলীয় কার্যালয়ে শুভরূপ মিত্র। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়

থরথর করে কাঁপছিলেন শুভরূপ মিত্র।

Advertisement

রাগে না ভয়ে? উত্তেজনায় গলা বসে যাচ্ছিল মদন মিত্রের ছোট ছেলের। ফোনে কাউকে বলছিলেন, ‘‘পুলিশ কোনও কথা শুনছে না। ওরা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে। থানার আইসি আমাদের ছেলেগুলোকে ধরে মারছে। আইসি-কে বুঝিয়ে দাও, যদি সময় আসে আমরাও কিন্তু এর হিসেব বুঝে নেব।’’

কথা শেষ করে কপালে হাত দিয়ে কয়েক মুহূর্ত বসতে না বসতেই ফের ফোন। মোবাইল কানে কাউকে নির্দেশ দিলেন তিনি, ‘‘ভয় পাচ্ছিস কেন? ওদের ছেলেগুলোকে রাস্তায় ফেলে পেটা। যা হবে দেখা যাবে। পুলিশকে ভয় পেয়ে সব শেষ করে দিস না।’’

Advertisement

শুধু নির্বাচন কমিশন বা কেন্দ্রীয় বাহিনী নয়। শাসক দলের কর্মী-সমর্থকদের চোখে এ বার ‘ভিলেন’-এর তালিকায় জ্বলজ্বল করেছে পুলিশের নাম। আক্ষরিক অর্থে দিনভর কামারহাটি জুড়ে এমন উলট-পুরাণের গল্প। ‘শাসক দলের ধামা ধরা’ বলে পুলিশের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত যে অভিযোগ উঠছে, এ বার তারই সম্পূর্ণ বিপরীত চেহারা এই বিধানসভা কেন্দ্রে। এখানে শাসক দলের প্রার্থী মদন মিত্রের পরিবার এবং অনুগামীরা সকাল থেকেই পুলিশের বিরুদ্ধে চক্রান্তের জাল বিছানোর অভিযোগ এনেছেন।

সোমবার সকাল থেকেই দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কাছে তৃণমূলের কেন্দ্রীয় অফিসে রীতিমতো তোলপাড় চলছিল। পুলিশ, নির্বাচন কমিশন এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর ত্রিমুখী ফলায় যে তাঁরা বিদ্ধ হচ্ছেন, সে কথা সরাসরিই স্বীকার করছিলেন দলের নেতা-কর্মীরা। মদন মিত্রের বড় ছেলে স্বরূপের স্ত্রী স্বাতী দুপুরে অভিযোগ করেন, পুলিশ তাঁদের নানা ভাবে হয়রান করছে। তাঁর কথায়, ‘‘বাবা রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার হয়ে জেলে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। আমরা বাবার হয়ে নির্বাচনের কাজ করেছি। কিন্তু পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় বাহিনী যে ভাবে আমাদের হয়রান করছে, তা কল্পনাও করতে পারিনি।’’

প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, তা হলে কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশও শাসক দলের আঙুল তোলাকে তোয়াক্কা করছে না? কামারহাটি কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী মানস মুখোপাধ্যায়ের উত্তর, ‘‘আবহাওয়ায় পরিবর্তনের আঁচটা সব চেয়ে আগে পায় পুলিশই। ওরাও হয়তো টের পেয়েছে পরিবর্তন আসছে।’’

এ দিন সকাল থেকে পরপর ঘটনায় শাসক দল পুলিশকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। দুপুরে ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বিশ্বজিৎ গণ জানান, পুলিশ তাঁকেও মেরেছে। তাঁর অভিযোগ, যতীন দাস স্পোর্টিং ক্লাবে ২১২ নম্বর বুথের সামনে বোমা পড়ে। আতঙ্কিত ভোটারদের সামলাতে যান তিনি। কিন্তু পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনী কিছু না শুনেই তাঁকে পেটাতে শুরু করে।

সংবাদমাধ্যমের সামনে বিশ্বজিৎবাবু যখন এই অভিযোগ করছেন, তখনও ভোটের ডিউটিতে শিলিগুড়ি থেকে আসা এক এএসআই এসে তাঁকে সতর্ক করে যান, ‘এখানে ভিড় করবেন না। রাস্তা ফাঁকা করুন।’ তাঁকে সামনে পেয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েন স্থানীয় তৃণমূল কর্মীরা। কিন্তু সেই ক্ষোভে বিশেষ আমল না দিয়েই সেখান থেকে চলে যান তিনি। এমন ছবিও পাঁচ বছরে সাধারণ মানুষ দেখেছেন বলে মনে করতে পারছেন না।

এই আমল না দেওয়ারই টুকরো ছবি চোখে পড়েছে কামারহাটির সর্বত্র। ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে মিলনতীর্থ স্পোর্টিং ক্লাবের সামনে ভোটারদের জন্য গ্লুকোজ-জল খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছিলেন স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর তথা চেয়ারম্যান পারিষদ বিমল সাহা। তাঁর সঙ্গেই ভোটারদের হাতে জলের গ্লাস তুলে দিচ্ছিলেন বীরভূমের তৃণমূল নেতা আশিস দে। বহিরাগত আশিস ওখানে কী করছেন? বীরভূম থেকে অনুব্রতর গুড়-জলের ফর্মুলা ধার করেই কি গ্লুকোজ-জল? বিরোধীদের এমন নানা টিপ্পনির মাঝেই হাজির হয় পুলিশের টহলদারি ভ্যান। ভ্যান থেকে নেমেই জলের কাউন্টার ঝটপট তুলে দেন পুলিশকর্মীরা। হুঁশিয়ারি দিয়ে যান, কথা না শুনলে গ্রেফতার করা হবে। এক কর্মী রসিকতা করে পুলিশকর্মীকে বলেছিলেন, ‘‘আপনিও এক গ্লাস খাবেন নাকি স্যর?’’ পুলিশকর্মী ভ্যান থেকে নেমে তাঁর কাঁধে হাত রেখে বলেন, ‘সময় নষ্ট না করে যা বলছি, সেটুকুই করুন।’ হুঁশিয়ারি শুনে চটপট এলাকা ফাঁকা করেন তৃণমূল কর্মীরা।

সব দেখে এক স্থানীয় বাসিন্দার মন্তব্য, ‘‘যে রাজ্যে তৃণমূল কর্মীদের ভয়ে পুলিশকে থানার ভিতরেও টেবিলের তলায় লুকোতে দেখা যায়, সেখানে পুলিশকর্মীর এমন কড়া চাহনি, সেটাও শেষ কবে দেখেছি বা আদৌ দেখেছি কি না মনে করতে পারছি না।’’

সিউড়ির নেতা আশিসবাবু বলেন, ‘‘সীতারাম ইয়েচুরি, সিদ্ধার্থনাথ সিংহ যদি পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা না হয়ে দিল্লি থেকে এসে এ রাজ্যে ভোট করতে পারেন, তা হলে আমি এ রাজ্যের বাসিন্দা হয়ে আসতে পারব না কেন? তবে আমি দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিতে এসেছিলাম। বিমলদা গরমে ভোটারদের একটু স্বস্তি দিতেই গ্লুকোজের জলের ব্যবস্থা করেছিলেন সেই কাজে একটু সাহায্য করছি মাত্র।’’ বিমলবাবুও বলেন, ‘‘এ বার তো দেখছি পুলিশ সবেতেই বাধা দিচ্ছে। আমাদের বিশ্বস্ত ভোটারদেরও নানা জায়গায় আটকে দিচ্ছে। আমরা যা করছি, তাতেই ওদের আপত্তি। এটা তো চক্রান্ত।’’

শুধু পুলিশ নয়, রুখে দাঁড়িয়েছেন সাধারণ মানুষও। দুপুরে পশ্চিমপল্লির একটি বুথে ভোট দিয়ে বেরিয়ে তপন চক্রবর্তী নামে এক বৃদ্ধ দেখেন দুই যুবককে ফেলে মারছে তৃণমূল সমর্থকেরা। তিনি বাধা দিতে গেলে উল্টে তাঁকেও মারতে শুরু করে। বৃদ্ধের মাথা ফেটে যায়। তবু প্রতিবাদের পথ থেকে সরেননি তিনি। তাঁর পাশে ছিলেন স্থানীয় আরও অনেকে।

নানা জায়গা থেকে এমন ঘা খেয়ে মাঝেমধ্যেই মরিয়া হয়ে উঠেছেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। বিকেলে ২১ নম্বর ওয়ার্ডে আনন্দম প্রাথমিক স্কুলের তিনটি বুথের সামনে প্রায় শ’দেড়েক সমর্থককে নিয়ে হাজির হন স্থানীয় তৃণমূল নেতা সুশান্ত রায়। পুলিশ তাঁদের হটাতে চেষ্টা করলে পুলিশকে লক্ষ করে ইট-পাটকেল উড়ে আসে। সেই সময়ে সংখ্যায় কম থাকায় সরে যান পুলিশকর্মীরা। এর পরে সিপিএমের ক্যাম্প অফিসে ভাঙচুর চালান তৃণমূল সমর্থকেরা। ততক্ষণে বিশাল কেন্দ্রীয় বাহিনী ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে গিয়েছে। লাঠি চালিয়ে তৃণমূল সমর্থকদের বুথের সামনে থেকে সরিয়ে দেয় তারা।

সরে যাওয়া আর সরিয়ে দেওয়ার টুকরো টুকরো নানা ছবিই এ দিন কামারহাটির ভোটের চরিত্রটা স্পষ্ট করে দিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন