প্রচারে বেরিয়ে একজন বলছেন, ‘‘পরিস্রুত পানীয় জলের জন্য সাড়ে তিনশো আর্সেনিকমুক্ত গভীর নলকূপ বসিয়েছি।’’
অন্যজনের দাবি, আর্সেনিক সমস্যা সমাধানের জন্য কোনও উদ্যোগই করেননি বিদায়ী বিধায়ক।
পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে বিদায়ী বিধায়ক দাবি করছেন, ‘‘এ বছরের মধ্যেই নৈহাটি থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে গঙ্গার পরিস্রুত পানীয় জল সরবরাহের কাজ শুরু হয়ে যাবে।’’
যা শুনে এক প্রবীণ ভোটাররের খেদ, ‘‘গ্রামে যে গভীর নলকূপ বসেছে, তা থেকে ভাল জলই ওঠে না। এখন আর এ সব কথা আর আর ভাল লাগে না।’’
উন্নয়নের দাবি বনাম অনুন্নয়নের অভিযোগ— মূলত একে ঘিরেই ভোটের বাজার সরগরম বনগাঁ দক্ষিণ কেন্দ্রে। গাইঘাটা ও বনগাঁর ৬টি করে পঞ্চায়েত নিয়ে ২০১১ সালের আগে তৈরি হয়েছে কেন্দ্রটি। যার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরলে কানে আসে, আর্সেনিকের দূষণ নিয়ে ক্ষোভের কথা। ইছামতী, যমুনা, চৈতা নদী সংস্কার হবে কবে, উঠছে এই প্রসঙ্গও। নদী সংস্কার না হওয়ায় ফি বছর প্লাবিত হয় ধানি জমি। ঘর ছাড়া হন বহু মানুষ। আর কৃষিপ্রধান এলাকায় একটা হিমঘরও কী হতে পারত না এই ক’বছরে— প্রশ্ন তুলছেন জোট প্রার্থী সিপিএমের রমেন আঢ্য।
সাধ্য মতো উত্তর দিচ্ছেন তৃণমূলের বিদায়ী বিধায়ক তথা এ বারের প্রার্থী সুরজিৎ বিশ্বাস। বলছেন, তুলে ধরছেন পাঁচ বছরের উন্নয়নের ফিরিস্তি। জানাচ্ছেন, এলাকায় ১৮৫ কিলোমিটার নতুন পিচের রাস্তা করেছেন। চাঁদপাড়া ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ঘোজা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও পাল্লা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিকাঠামো উন্নতি করেছেন। স্কুল-কলেজের উন্নতিতে দিয়েছেন ৬৯ লক্ষ টাকা।
ইছামতী ও যমুনা নদীর সংস্কারের বিষয়ে তৃণমূল প্রার্থীর দাবি, কালাঞ্চি থেকে টিপি পর্যন্ত ১২ কিলোমটার নদী পথে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে পলি তোলা হয়েছে। টিপিতে যমুনা ও ইছামতীর সংযোগস্থলেও সংস্কারের কাজ চলছে।
কিন্তু বিরোধী শিবিরের প্রশ্ন যতই কড়া কড়া হোক না কেন, শরীরী ভাষায় দিব্যি আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে সুরজিৎবাবুকে। হবেন না-ই বা কেন! গত কয়েকটি ভোটের পরিসংখ্যান বলছে, তৃণমূল এখানে বরাবরই ফার্স্ট বয়। ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটে ওই কেন্দ্র থেকে তৃণমূল প্রার্থী কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর এগিয়েছিলেন ১৮ হাজার ৪০৬ ভোটের ব্যবধানে। কপিলবাবুর মৃত্যুর পরে ২০১৫ সালে উপনির্বাচনে সেই ব্যবধান বেড়ে হয় ২৮,৭২৮। ১২টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ৯টি তৃণমূলের দখলে। গত বিধানসভা ভোটে সুরজিৎবাবু জিতেছিলেন ২১ হাজার ৮৮৯ ভোটের ব্যবধানে।
তবে জোট প্রার্থী সিপিএমের রমেন আঢ্য দীর্ঘদিনের পার্টি সদস্য। দক্ষ সংগঠক বলে পরিচিত। পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সভাপতি হওয়ার কারণে এলাকাটা চেনেন হাতের তালুর মতো। তবে বামেদের জোটসঙ্গী কংগ্রেসের শক্তি এখানে তেমন জোরদার নয়। ২০১৫ সালে লোকসভার উপনির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থী পেয়েছিলেন মাত্র ২,৩৮১টি ভোট।
জোটের ফসল ঘরে তুলতে পারবেন কি?
প্রশ্ন সামনে পড়তে না পড়তেই সোজা ব্যাটে উ়ড়িয়ে দিলেন রমেনবাবু। বললেন, ‘‘আমরা মিটিং-মিছিল যা করছি, গতবারের থেকে মানুষের সাড়া বেশি পাচ্ছি। মানুষ যদি নিজের ভোট নিজে দিতে পারেন, সাফল্য না পাওয়ার কোনও কারণ নেই।’’তবে সিপিএমের আশঙ্কা, এর আগে পঞ্চায়েতের উপনির্বাচনে সন্ত্রাস হয়েছিল। আবার সেই দিন ফিরবে না তো?
এলাকার অনুন্নয়নের অভিযোগকে হাতিয়ার করেই কড়া টক্কর দিতে পারবেন, সেই বিশ্বাস আছে তাঁর। আর ভোটের আগে আগে নারদ-কাণ্ড হাতের সামনে পেয়ে তা নিয়েও বিস্তর গলা ফাটাচ্ছেন রমেনবাবু। শাসকদলকে বেকায়দায় ফেলা যাবে এতে, মনে করেন তিনি। রমেনবাবুর কথায়, ‘‘একে তো অনুন্নয়নের তালিকা দীর্ঘ। সব কথাই তুলে ধরছি প্রচারে।’’
গাইঘাটার ঠাকুরনগরে মতুয়া ধর্মের অন্যতম প্রাণ পুরুষ প্রমথরঞ্জন ঠাকুরের নামে তৃণমূল সরকার একটি কলেজ তৈরি করেছে। পঠন পাঠনও চালু হয়েছে। কিন্তু রমেনবাবুর প্রশ্ন, ‘‘কলেজ তো হওয়ার কথা ছিল চাঁদপাড়ায়। কিন্তু সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল কেন? আমরা ওই কলেজটি ফের চাঁদপাড়ায় ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ করব।’’ সিপিএম প্রচারে আরও বলছে, জিয়ালা বিলে অতীতে মৎস্যজাবীরা মাছ ধরতেন। সেটা নাকি তৃণমূল বন্ধ করে দিয়েছে। যদিও বনগাঁ পঞ্চায়েত সমিতির পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, সম্পূর্ণ মিথ্যে অভিযোগ। কিছু দিন আগেও ওই বিলে দুই কুইন্ট্যাল চারাপোনা ছাড়া হয়েছে। মৎস্যজীবীরা সেখান মাছ চাষও করছেন।
সিপিএম প্রার্থী বিরুদ্ধে তৃণমূলের পক্ষ থেকে সমবায়ে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হচ্ছে। যা শুনে রমেনবাবু বলেন, ‘‘ওদের সরকার তো তদন্ত করেছে। কিছুই প্রমাণ করতে পারেনি।’’
এই সব নানা দাবি, পাল্টা দাবি আছে। আছে উন্নয়নের প্রশ্নে চাপানউতোর। তবে স্থানীয় মানুষ স্বীকার করছেন, এলাকায় শান্তি ফিরেছে। গরু পাচার মোটামুটি বন্ধ।
মতুয়া ভোটের গুরুত্ব উড়িয়ে দিতে পারছে না কোনও পক্ষই। সুরজিৎবাবু, রমেনবাবু এবং বিজেপি প্রার্থী স্বপন মজুমদার ঠাকুরনগরে মতুয়া ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘের প্রধান উপদেষ্টা বীণাপানি ঠাকুরের আশীর্বাদ নিয়ে এসেছেন। মতুয়া ভোট পেতে স্বপনবাবু সম্প্রতি বনগাঁর সাংসদ বা সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি মমতাবালা ঠাকুরে মন্তব্যকে হাতিয়ার করেছেন। বিজেপি প্রার্থী প্রচারে বলছেন, ‘‘এ বার মতুয়া ধর্ম মহামেলায় সরকারি পরিষেবা যেমন জল, বিদ্যুৎ বা পুলিশ— কিছুই পাওয়া যায়নি। ফলে মতুয়ারা ক্ষিপ্ত হয়ে আছেন।’’
তিন প্রার্থীর মধ্যে বয়সে সব থেকে নবীন স্বপনবাবু। মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে এ বারই প্রথম ভোটের ময়দানে হাতেখড়ি। তবে লোকসভা বা বনগাঁ লোকসভার উপনির্বাচনে এলাকায় বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে যে উৎসাহ ছিল, তা এ বার তেমন ভাবে চোখে পড়ছে না। ২০১৪ সালে বিজেপি বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রে পেয়েছিল ২১.৫১ শতাংশ ভোট। উপনির্বাচনে কিছুটা বাড়ে। কিন্তু অন্য দলগুলির বক্তব্য, সেই দু’বারই মোদী দেশ জুড়ে কাজ করেছিল মোদী-হাওয়া। যা এখন অনেকটাই ফিকে।
যদিও বিজেপি প্রার্থীর কথায়, ‘‘শিল্প, কর্মসংস্থান সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বেড়েছে শুধু ধর্ষণ। বাম সরকারের ৩৪ বছরকেও তৃণমূল পাঁচ বছরে ছাপিয়ে গিয়েছে।’’ আরও বলছেন, ‘‘কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের দু’বছর হয়ে গেল, কোনও মন্ত্রী দুর্নীতিতে জড়িত নেই। আর এখানে সারদা-নারদায় সকলে ডুবে গিয়েছে।’’ সবই ‘চক্রান্ত’ মূলত এই বলেই প্রচারে বেরিয়ে এ সব অভিযোগের উত্তর দিচ্ছেন সুরজিৎবাবু।
এলাকায় সুরজিৎবাবুর ‘দৃশ্যমানতা’ নিয়ে প্রশ্ন আছে। যে কারণে স্বপনবাবুর কটাক্ষ, ‘‘এখানে তো দু’জন বিধায়ক ছিলেন। এক সুরজিৎবাবু, দ্বিতীয় ওঁর ছেলে অভিজিৎ। যাঁকে লোকে এ ক’বছরে বিধায়কের থেকেও বেশি দেখেছে।’’ অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছেন সুরজিৎ। এলাকায় নিয়মিত যাতায়াত তাঁর, দাবি করছেন। আরও বলছেন, ‘‘ছেলে সক্রিয় পার্টি কর্মী, জেলা যুব তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক। ওকে তো সাধারণ মানুষের পাশে দেখা যাবেই!’’