Congress

Bengal Polls: কংগ্রেসের ভাঙনেই কি লাভ হবে তৃণমূলের

হলে কি গাজলের এই অনুযোগ তৃণমূলকে ছোঁবে না? দু’বছর আগে লোকসভা ভোটে আদিবাসী প্রধান এই বিধানসভা কেন্দ্রে এগিয়ে ছিল বিজেপি।

Advertisement

দেবাশিস চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২১ ০৬:৩৮
Share:

প্রতীকী ছবি।

আদিনা মসজিদের বাইরে বসেছিলেন ওঁরা চার জন।

Advertisement

সরু সিমেন্ট বাঁধানো রাস্তা। এক ধারে পরপর ঘর। প্রত্যেকের সামনে বিড়িপাতা ও তামাক। কথা বলতে বলতে বিড়ি বাঁধা কিন্তু থামেনি এক মুহূর্তের জন্যও। ভোট নিয়ে কিছু বলবেন না ওঁরা। পাশে বসে অশীতিপর বৃদ্ধা। চোখে ভাল দেখতে পান না। মাঝেমধ্যেই বলে উঠছেন, ‘‘আমি তো বিধবা-ভাতা এখনও পেলাম না।’’ তাঁর পুত্রবধূও ছিলেন বিড়ি বাঁধার দলে। ছিলেন ওই পুত্রবধূর মেয়ে, বৌমা, এক জা-ও। বৃদ্ধাকে থামিয়ে পুত্রবধূ বললেন, ‘‘যাওয়া হয়নি তো ‘দুয়ারে সরকারে’। তাই পাননি। এর পরে এলে যাব।’’

একটু আগে মসজিদের ভিতরে কর্মীরা বলছিলেন, ‘‘এত দিন ঠিকে কর্মী ছিলাম। এই তো চুক্তিভিত্তিক করে দিল প্রত্নতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগ।’’ রাজ্যকে নিয়ে তাঁদের অনুযোগের অভাব নেই। এক জন বললেন, ‘‘দুয়ারে সরকারে গিয়ে কী হবে? সব জমা দিলাম, কিন্তু স্বাস্থ্যসাথীর কার্ডই তো পেলাম না।’’ রাগ কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরীর উপরে। বলছিলেন, ‘‘এই যে এত টাকা খরচ করে জোর করে আলো বসিয়ে গেল, তাতে লাভ কী হল? এই আলো তো আর জ্বালানোই হল না।’’

Advertisement

গাজল বিধানসভা কেন্দ্রের আদিনা মসজিদ এলাকা অবশ্য কৃষ্ণেন্দুর বিচরণক্ষেত্র নয়। তিনি তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন জেলা সদর ইংরেজবাজারে।

তা হলে কি গাজলের এই অনুযোগ তৃণমূলকে ছোঁবে না? দু’বছর আগে লোকসভা ভোটে আদিবাসী প্রধান এই বিধানসভা কেন্দ্রে এগিয়ে ছিল বিজেপি। সে সময়ে আরএসএসের আদিবাসী গণবিবাহের অনুষ্ঠানে গোলমাল হয়েছে। আঙুল উঠেছে তৃণমূলের দিকে। কিন্তু ২০১৯-এর মে মাসের পরে অনেক জল গড়িয়েছে মহানন্দায়। কিছু দিন আগে আদিবাসীদের দুই গোষ্ঠীর জমায়েতে ভাল ভিড় হয়েছে। তাদের প্রচারের মূল উপজীব্য ছিল: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই আদিবাসীদের সারনা ধর্মের হয়ে সওয়াল করছেন, বিজেপি নয়।

মুদ্রার এক পিঠে যদি গাজলের সভা, তো অন্য পিঠে আছে হবিবপুরের গ্রামোত্থান কেন্দ্র।

সঙ্ঘ প্রভাবিত এমন কেন্দ্র গোটা উত্তরবঙ্গে আর নেই। হবিবপুরের কাছে গ্রামের অন্দরে সেই কেন্দ্রটিতে কী নেই! এলাকার আদিবাসী ছেলেমেয়েদের দূরশিক্ষার জন্য ট্যাবের ব্যবস্থা, ভ্রাম্যমান কম্পিউটার শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে একটি ছোট বাস (যার প্রতি আসনের সঙ্গে রয়েছে একটি করে ল্যাপটপ, দু’টি একল বিদ্যালয় মিলিয়ে একটি স্কুল, নিজস্ব চাষবাস থেকে শুরু করে সার তৈরির ব্যবস্থা এবং একটি রামমন্দির। গ্রামের মোরামের পথও পাকা হচ্ছে। গ্রামোত্থান কেন্দ্রের আধিকারিক কৃষ্ণেন্দু দত্ত বলেন, ‘‘খগেন মুর্মুকে (মালদহ-উত্তরের বিজেপি সাংসদ) বলে এত দিনে রাস্তা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।’’ কেন্দ্রটিতে এক জন সঙ্ঘের প্রতিনিধি সব সময়ের জন্য রয়েছেন। পড়াশোনা ছাড়া বাচ্চাদের আর কী শেখান? ‘‘শেখাই আমাদের দেশের সংস্কৃতি, জাতীয়তাবাদ, সব কিছু।’’

এই ভাবেই আদিবাসীদের ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে সঙ্ঘ। তবে এই অবাধ গতি কি সর্বত্র সম্ভব? বিশেষ করে জেলার সংখ্যালঘু প্রধান এলাকায়? গ্রামোত্থান কেন্দ্রের কৃষ্ণেন্দু বলছিলেন, ‘‘আমাদের এই শিক্ষাকেন্দ্রে কিন্তু হিন্দু, মুসলমান সকলের জন্যই দরজা খোলা।’’

তবু সেই হাওয়া এখনও জেলার সব জায়গায় পৌঁছয়নি। বরং হরিশ্চন্দ্রপুরের ভবানীপুর সেতুর কাছে চায়ের আড্ডায় বসে আব্দুস সালাম স্বপন বলে ওঠেন, ‘‘বিজেপির ভোট নেই এখানে।’’ তা হলে কি কংগ্রেস? মালদহে তো এখনও আবু বরকত আতাউর গনিখান চৌধুরীর ‘সুবাস’ বাতাসে ওড়ে। আব্দুস সালাম প্রশ্ন উড়িয়ে বলেন, ‘‘কংগ্রেস লড়াইয়ের বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেকেই ভাবছেন, কংগ্রেস-সিপিএমকে কেন ভোট দেব?’’

আর বামের ভোট? আর একটু এগিয়ে থানাপাড়া। সেখানে ছোট দোকান আছে সৌরভ সরকারের। তিনি বলছিলেন, ‘‘আগে ফরওয়ার্ড ব্লক করতাম। এখন বিজেপির সমর্থক।’’ কেন? ‘‘তৃণমূলের দাদাগিরি বেড়েছে। বামফ্রন্ট দুর্বল হয়ে পড়েছে,’’ জবাব সৌরভের। কাছেই সাইকেলের দোকান কামনাশিস রায়ের। তিনি সৌরভের মতোই খাপ্পা কংগ্রেসি বিধায়ক মোস্তাক আলমের উপরে। কামনাশিসের মতে, হিন্দু ভোটের ৯০ ভাগ পাবেন বিজেপি প্রার্থী মতিবুর। তাঁর সঙ্গী সম্রাট মিত্র বা সুব্রত দাস আবার বলেন, ‘‘মতিবুর যদি সংখ্যালঘু ভোট কিছুটা নিজের দিকে টানতে পারেন, তবে তৃণমূল প্রার্থী তজমুলের কপালে দুঃখ আছে।

আর চাঁচল? এ বারে পুরসভা হবে কি? বাসস্ট্যান্ডে স্টার্টারের ঘরে বসে প্রদীপকুমার চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘‘সেই ২০০১ সালের পয়লা এপ্রিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এসে ঘোষণা করেন, চাঁচল মহকুমা হবে। তখন সবাই বলেছিল, এপ্রিল ফুল করে গেলেন। এ বারে ফিরহাদ হাকিম শুনিয়ে গেলেন পুরসভা হওয়ার কথা। দেখি, শিকে ছেড়ে কি না।’’

হিন্দু, মুসলমান, রাজবংশী, আদিবাসী— বহু ধরনের মানুষ থাকেন এই জেলায়। কিন্তু সম্প্রদায়গত গোলমালের বিশেষ খবর নেই। বয়স্করা মনে করিয়ে দেন, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের কথা। বলেন, ‘‘ইংরেজবাজারে বাবরি ধ্বংসের কোনও আঁচই লাগেনি।’’ হরিশ্চন্দ্রপুরে যেমন আব্দুস সালামরা বলেন, তেমনই রতুয়া বিধানসভার পুকুরিয়া মোড়ে আড্ডাধারী মুকুল চৌধুরী, মহম্মদ আইনুল হক, আব্দুল হক, বিপ্লব ঝা বা গোবর্ধন দাসেদেরও এক কথা— ‘‘এখানে আমরা মিলে মিশে আছি। কেউ বলতে পারবেন না, কোনও দিন কোনও গোলমাল হয়েছে।’’ লোকসভা ভোটেও এই কেন্দ্রে এগিয়ে ছিল ঘাসফুল। এ বারে ত্রিমুখী লড়াইয়ের কঠিন প্যাঁচে পড়েছে তারা।

কোতুয়ালির গা ঘেঁষা পথ ধরে সোজা চলে এলে পীরগঞ্জ মোড়। এই মালতীপুর বিধানসভাও এক সময়ে ছিল গনির গড়। কিন্তু রাজ্যে পালাবদলের পরে কংগ্রেসের নিচুতলার নেতারা বেশির ভাগই এখন তৃণমূলে। ‘‘বিধানসভা ভোটের আগে ঘর অনেকটাই গোছানো হয়ে গিয়েছে,’’—চায়ে সশব্দ চুমুক দিয়ে বলছিলেন সফিউর আলম। জেলা তৃণমূলের সহ-সভাপতি। সঙ্গে আনিসুর রহমান, আব্দুল মান্নানরা রয়েছেন। একটু পরে এসে যোগ দিলেন মীরা কর্মকার।

দোকানে বসেই চলছে আলোচনা। একটু পরে পরে স্বপন এগিয়ে দিচ্ছেন কাগজের কাপ, ‘‘চা।’’ দুধটা কীসের বলুন তো? মোষের? স্বপনের মুখে হাল্কা হাসি, ‘‘গরু আর মোষের দুধ মিলিয়ে।’’ পিছন থেকে এক জন ফুট কাটলেন, ‘‘বুঝলেন না? এখানেও জোট!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন