শেষ হয়েও হইল না শেষ...

হেঁটে আসা পথ দু’দণ্ড থমকে দাঁড়ায়। মুচকি হেসে হয়তো সে ভাবে, শেষ থেকে শুরু করলেও বা ক্ষতি কী!

Advertisement

মধুমন্তী পৈত চৌধুরী

কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:২৭
Share:

ফিল্মের একটি দৃশ্য।

পথের শুরু দেখায় না সে পথের শেষ কোথায়! চলার পথে সে আশা জাগায়, স্বপ্ন দেখায় আর আলতো করে কানে কানে বলে ‘আরও একটু পথ বাকি’। গন্তব্য আসে। হেঁটে আসা পথ দু’দণ্ড থমকে দাঁড়ায়। মুচকি হেসে হয়তো সে ভাবে, শেষ থেকে শুরু করলেও বা ক্ষতি কী!

Advertisement

কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘নগরকীর্তন’ ছবির শেষ দৃশ্যটি হতে পারত ছবির প্রথম দৃশ্য। সে ক্ষেত্রে বদলে যেত ছবির গতিপথ। তা সত্ত্বেও ঠিক পৌঁছনো যেত ছবির ভরকেন্দ্রে। ফ্ল্যাশ-ব্যাক ও ফ্ল্যাশ-ফরওয়ার্ডের মাধ্যমে গল্পের এই বৃত্তাকার চলন পরিচালকের সিগনেচার স্টাইল। তবে এই ছবির উত্তরণে তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। শেষ দৃশ্যটি ছবির প্রতিকৃতি। আর বাকি সব দৃশ্যই তার প্রতিবিম্ব।

নবদ্বীপে বাপ-দাদার ভিটে ও কীর্তনের পেশা ছেড়ে কলকাতা শহরে বাসা নেয় মধু (ঋত্বিক চক্রবর্তী)। পেট চালায় ডেলিভারি বয়ের কাজ করে। বায়না এলে শহরের কাছেপিঠের কীর্তনে সে বাঁশিও বাজায়। তবে বৃহন্নলারা যখন তাকে বাঁশি বাজানোর অনুরোধ করে, নবদ্বীপের শ্যামের বাঁশিতে বেজে ওঠে বাজারচলতি ফুরফুরে প্রেমের গানের কলি। সেই বাঁশিতেই বাধা পড়ে প্রেমে প্রত্যাখ্যাত, রূপান্তরকামী পুটি-পরি-পরিমল (ঋদ্ধি সেন)। অবশ্য মধুর চোখে পুটি নারী, শুধু তার শরীর বানাতে ‘ঠাকুরের ভুল হয়ে গিয়েছে’।

Advertisement

মধু-পুটির জার্নি পরিচালক কৌশিকের আরও একটি প্রেমের গল্প। যে প্রেম আর পাঁচটা নারী-পুরুষের সম্পর্কের মতোই সহজ, সাবলীল। আবার খানিক জটিলও বটে। নকল চুল পরা পুটিকে তার স্বাভাবিক চুলে দেখতে চায় না মধু। অথচ মধুর সোহাগে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না পুটির পুরুষ-শরীর।

এই ছবি ঋতুপর্ণ ঘোষের উদ্দেশে পরিচালকের ট্রিবিউট। মধু-পুটি ও রুদ্র-পার্থের (‘চিত্রাঙ্গদা’ ছবির মূল চরিত্র) আকাশ একটাই। তবু তাদের মধ্যে দূরত্ব শত শত মাইলের। ‘চিত্রাঙ্গদা’ যদি ‘সংগ্‌স অব এক্সপিরিয়েন্স’, ‘নগরকীতর্ন’ তবে ‘সংগ্‌স অব ইনোসেন্স’! মধু যখন বলে, পুটির জেন্ডার রিঅ্যাসাইনমেন্টের অপারেশন সে ইনস্টলমেন্টে ধাপে ধাপে করাতে চায়, সেই সারল্যও কি এক ধরনের অভিজ্ঞতা নয়?

রাম রজ্জাকের মেকআপ ও গোবিন্দ মণ্ডলের পোশাকে ঋদ্ধিকে বড্ড সুন্দর দেখতে লেগেছে। নারী ও পুরুষের চালচলনের মাঝে যে পলকা সরু সুতোর মতো সেতু, এত অনায়াসে তা কী করে তিনি রপ্ত করেছেন, ভাবলেও অবাক লাগে! পর্দায় ঋত্বিককে দেখে আর নতুন করে বিস্ময় জাগে না। তিনি আর কত ভাবে, কত রকম করে নিজেকে ভাঙবেন, তার অপেক্ষায় দিন গুনবেন দর্শক। গুরুমায়ের চরিত্রে শঙ্করী, অন্য বৃহন্নলারা এবং বাস্তব চরিত্রে মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় ছবির সম্পদ। প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গীতও যোগ্য সঙ্গত দিয়েছে।

তবে এ ছবি যতটা শিল্পীদের, ততটাই পরিচালক-চিত্রনাট্যকার-লেখক কৌশিকের। বলা যায়, হয়তো একটু বেশিই তাঁর। ‘ছোটদের ছবি’, ‘শব্দ’-এর পৃথিবীর মতো এই ছবিতেও পরিচালকের পাখির চোখ একটাই। যাঁদের কথা সাধারণ মানুষ জানেন না, জানলেও ভাবেন না, তাঁদের সামনে নিয়ে আসা, এক কদম হলেও তাঁদের এগিয়ে দেওয়া। কিন্তু সেই গল্প বলায় মাথা ভারী করা কচকচানি নেই। আছে আলতো চাহনি, কাঁপা ঠোঁট আর অগোছালো শাড়ির অভিসার। শেষ দৃশ্যে পরিচালকের মাস্টারস্ট্রোক! জীর্ণ-জরার শিকল ভাঙুক লিঙ্গ-প্রেম-যৌনতার ডিসকোর্স।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন