ফেলুদা রূপে পুজোয় টোটা রায়চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত।
কখনও পরনে কালো টি-শার্ট, বুকে বড় হরফে সিরিজ়ের নাম। কখনও পাজামা-পাঞ্জাবিতে ‘বাবু কালচার’! আড্ডা টাইমস ওয়েব প্ল্যাটফর্মের সিরিজ় ‘যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে’-র প্রচারে এভাবেই ছন্দবদ্ধ টোটা রায়চৌধুরী, অনির্বাণ চক্রবর্তী, কল্পন মিত্র। পর্দায় তাঁরাই ‘ফেলুদা’, ‘জটায়ু’, ‘তোপসে’। কেবল দলছুট পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়! কী কারণে তিনি রাগ করে গোসাঘরে?
প্রশ্ন: পুজোয় ‘ফেলুদা’ ছুটি পেলেন না? তোপসে, জটায়ু-ও কাঠমান্ডুতে!
টোটা: আমরা শীতে ‘ফেলুদা’কে পেয়ে অভ্যস্ত। সন্দীপ রায় এরকমই যেন অলিখিত নিয়ম করেছিলেন। উনি সত্যজিৎ রায়-সৃষ্ট ‘গোয়েন্দা’কে বরাবর বড়দিনে আনতে পছন্দ করেন। অবশ্য সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’ বা ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ কবে মুক্তি পেয়েছিল জানি না। হ্যাঁ, এ বছর নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটছে।
অনির্বাণ: আমার এ বছর পুরোটা উল্টে গিয়েছে। প্রত্যেক বছর পুজোয় আমি বেড়াতে যাই। এ বছর কেন যেন সেই প্ল্যান করা হয়নি। ফলে, এ বছর আমি কলকাতায়। কিন্তু ‘জটায়ু’ নেপালের কাঠমান্ডুতে থাকবে (হাসি)।
কল্পন: ফেলুদা ছুটি না পেলে তোপসে কী করে পাবে! আমিও পুজো ভুলে নেপালে। তবে এটা কিন্তু দর্শকদের কাছে বাড়তি পাওনা। পুজোয় দেদার মজার মাঝে ‘ফেলুদা অ্যান্ড কোং’ হাজির।
প্রশ্ন: সকলে যখন ধরে নিয়েছিল, ‘যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে’ হিমঘরে, ছ’বছর পরে তখনই সেটা জেগে উঠল!
টোটা: ছ’বছর নয়। ২০২০ সালের জানুয়ারির শেষে শুটিং শুরু করেছিলাম। সে দিক থেকে পাঁচ বছর। কথায় বলে না, যেটা হয় সেটা ভালর জন্যই হয়। আমরা বাকি যে তিনটি ‘ফেলুদা’ করেছিলাম সেটা একটি নির্দিষ্ট সময় এবং ধারা মেনে তৈরি করেছিলেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়। একমাত্র এই সিরিজ়টি সমসাময়িক। কারণ, সত্যজিৎ রায় যেটা লিখে গিয়েছিলেন সেই নেপালের বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে ২০১৫-র বিধ্বংসী ভূমিকম্পের পর। অর্থাৎ, আধুনিক সময়ের একমাত্র সাক্ষী এই সিরিজ়।
অনির্বাণ: আড্ডা টাইমস ওয়েবসাইটের জন্য ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’ আর ‘যত কাণ্ড কাঠমান্ডু’তে একই সময়ে শুট করা। পাঁচ বছর আগের স্মৃতি সিরিজ়মুক্তির কারণে হঠাৎ আবার সামনে! ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা বলে নেপালের বেশির ভাগ বাড়ি কাঠের। হোটেলে আমার আর টোটার ঘর উপরে-নীচে। মানে, আমার মাথার উপরে ‘প্রদোষ চন্দ্র মিত্র’। তখন অতটা ঘনিষ্ঠতা হয়নি। তো, টোটা ডেকে বলল, মাঝেমধ্যে মাথার উপর ধুপধাপ শব্দ শুনলে চমকে যেয়ো না। শুনে অবাক আমি। জানতে চাইলাম, আওয়াজ কেন হবে? টোটা বলল, আমার একটু শরীরচর্চার বাতিক আছে। কথাটা শুনে মজা পেয়েছিলাম। কোথায় কোথায় খেতে গিয়েছি, কী করেছি— সব চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
কল্পন: আমারও তাই। খুব মজা করেছিলাম আমরা।
নেপালে ‘জটায়ু’ অনির্বাণ চক্রবর্তী, ‘তোপসে’ কল্পন মিত্র, ‘ফেলুদা’ টোটা রায়চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: এ বছরটা কি স্মৃতি ফেরানোর বছর? ১০ বছর পরে ‘ধূমকেতু’ ফিরল। পাঁচ বছর পরে ‘ফেলুদা’ সিরিজ়...
টোটা: (মুখ টিপে হেসে), অতীত ফিরে ফিরে আসে। অতীতের থেকেই শিক্ষা নিতে হয়। অতীত প্রমাণ করে দিয়েছে, ‘পুরনো চাল ভাতে বাড়ে’। ‘ধূমকেতু’র সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়েছি। দাবি করছি, আমাদের সিরিজ় একই ভাবে দর্শক প্রশংসিত হবে।
প্রশ্ন: মুক্তির আগে নিজেদের কাজ দেখলেন? পাঁচ বছর কিন্তু ত্রুটিমুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে ...
টোটা: বিনোদন দুনিয়ায় একটা সময়ে বাজেট হয়তো কম ছিল। তার পর বাজেট বাড়ল। এটা ছবি তৈরির ক্ষেত্রে বলছি। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম কিন্তু এটা নয়। বরং উল্টোটা। ওটিটি-তে শুরুতে প্রচুর বাজেট ছিল। আমরা যখন কাজ করেছি তখন বাজেট নিয়ে এতটাই মাথা ঘামানো হত না। ফলে, আমরা প্রত্যেকটা দৃশ্য ভীষণ যত্ন করে শুটিং করেছি। নতুন করে ব্রাশ আপ আমাদের অন্তত করার দরকার নেই। আপনারা হয়তো জানেন না, সেই সময়ে বাংলা ওটিটি দুনিয়ায় আমাদের সিরিজ় সবচেয়ে বেশি বাজেটে তৈরি হয়েছিল।
অনির্বাণ: আমার নিজের কাজ কখনও পছন্দ হয় না। সেটা যে দ্বিতীয় বার দেখার পরে মনে হয়েছে, তা নয়। শটশেষেই মনে হয়, এ বাবা! এটা কী করলাম। এত খারাপ শট দিলাম!
কল্পন: এক অবস্থা আমারও। শট দিয়ে বেরিয়ে এসে মনে হয়েছে, ইসস! অমুক দৃশ্যটা যদি এ ভাবে না করে ও ভাবে করতাম তা হলে আরও জমে যেত।
প্রশ্ন: ফেলুদা চট করে ফেরেন না, ফিরলে নাকি ‘ডাবল ধমাকা’! পুজোর আগে, আবার পুজোর পরেই?
টোটা: না, পুজোর পরে নয়। অক্টোবরে আসছি না আমরা। আবার শীতে সম্ভবত। এখনও তারিখ ঘোষণা হয়নি।
অনির্বাণ: কলকাতায় তো লম্বা শীত পড়ে... সাত-আট মাস ধরে। সেই দীর্ঘ শীতের মধ্যে কোনও একটা সময় আমরা আবার আসব (জোরে হাসি)। টোটাও যোগ দিলেন হাসিতে।
কল্পন: সেটাই... (হাসি)।
প্রশ্ন: ধরুন, দুই কি তিন মাসের ব্যবধানে আপনারা ফিরছেন। ‘ফেলুদা’র অনুরাগীরা দেখবেন?
টোটা: আমি এটুকু বলতে পারি, দুটো ওয়েব প্ল্যাটফর্মের কর্ণধার খুবই বিবেচক, দায়িত্বশীল। এত বড় গণ্ডগোল ওঁরা করবেন না। কারণ, ‘ফেলুদা’ যে কোনও ওয়েব প্ল্যাটফর্মের কাছেই ‘প্রাইম প্রপার্টি’। ব্যবসা কেউ ছাড়ে? শুধুমাত্র প্রতিযোগিতার জন্য এই ভুল ওঁরা করবেন না।
অনির্বাণ: কোনও প্রতিযোগিতা নেই। পরের বার যে প্ল্যাটফর্মে আমাদের দেখা যাবে, সেখানকার কর্ণধারেরা কিন্তু আমাদের আড্ডা টাইমসের সিরি়জ়ের জন্য শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। রেষারেষির জায়গাই নেই।
কল্পন: আপনারা যেটা দেখেছেন, সেটা সারা বছরে অন্য প্ল্যাটফর্মের যা কাজ সেটাই আরও একবার করে ঘোষিত হয়েছে। না হলে তো তারিখ ঘোষণা করে দিত ওরা।
রহস্য সমাধানে ময়দানে টিম ফেলুদা। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: তিন জনেই সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের পর কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় কাজ করলেন। দু’জনের অনেক পার্থক্য?
টোটা: এখানে একটা ব্যাপার দেখেছি, দু’জন প্রযোজক বা পরিচালকের মধ্যে সব সময় সম্মানের আদানপ্রদান বজায় থাকে। যেমন, কমলদার সঙ্গে শুটিংয়ের আগে জানতে চেয়েছিলাম, তুমি কি অন্য ধারার অভিনয় চাও? উনি সঙ্গে সঙ্গে সেই ভাবনা নাকচ করে দিলেন। জানালেন, যে ভাবে সৃজিতের কাছে অভিনয় করেছি সেটাই আমরা ধরে রাখব। কমলদা আমাদের অভিনয়ে নাক গলাবেন না। দাদা, নিজের মতো করে গল্প বলবেন। এই স্বাধীনতা বা উদারমনস্কতা বাংলাতেই আছে। সৃজিতের ক্ষেত্রেও তা-ই। ওকে যখন জানালাম, কমলদার পরিচালনায় ‘ফেলুদা’ করছি, তখন একবাক্যে গ্রিন সিগনাল দিল। বলল, “চোখ বন্ধ করে এগিয়ে যাও।”
অনির্বাণ: আমরা প্রায় একই সময়ে দুটো আলাদা ওয়েব প্ল্যাটফর্মে, আলাদা পরিচালকের পরিচালনায় ‘ফেলুদা অ্যান্ড কোং’ হয়েছি। এটা শুধু বাংলায় হয়। জাতীয় স্তরে কোনও দিন হয়নি। কমলদা টোটাকে যা বলেছিলেন, আমাকেও একই কথা জানিয়েছেন। ফলে, আমাদের কোনও অসুবিধা হয়নি।
কল্পন: আমারও না।
প্রশ্ন: দুই মুখোপাধ্যায়ের গল্প বলার ধরন আলাদা?
অনির্বাণ: এটাই বলতে যাচ্ছিলাম। ওঁদের মধ্যে গল্প বলার ধরনেই যেটুকু ফারাক। আর সব এক। যেমন, সৃজিত ‘যত কাণ্ড কাঠমান্ডু’তে যতটুকু দরকার ততটুকুই বদল ঘটিয়েছেন। একই ভাবে কমলেশ্বরদাও সেটাই করেছেন। আমরা আমাদের জায়গায় ঠিক ছিলাম।
কল্পন: আমি দু’জনের সঙ্গে কাজ করে খুব আরাম পেয়েছি। সৃজিতদার সঙ্গে বেশি কাজ করেছি। ফলে, সেখানে হয়তো একটু বেশি আবদার বা নিজের কথা বলার সুযোগ তৈরি হয়েছে। কমলদার সঙ্গে প্রথম কাজ। কিন্তু কোনও অসুবিধা হয়নি।
প্রশ্ন: এক মুখোপাধ্যায় সিরিজ় আকারে ‘ফেলুদা’ আর করবেন না ঘোষণা করলেন। অন্য মুখোপাধ্যায় সেই ব্যাটন তুলে নিলেন। হাতবদল হওয়ার প্রথম অনুভূতি?
টোটা: (একটু ভেবে) আমি, সৃজিত আর কমলদা প্রায় সমসাময়িক। তাই আমাদের মধ্যে সৌজন্যবোধ বা পারস্পরিক বোঝাপড়া ছিলই। তাই তফাত খুঁজে পাইনি। আমাদের এক সুতোয় বেঁধেছেন সত্যজিৎ রায়। ওঁর লেখনীকে এড়িয়ে বেশি কিছু করার জায়গা নেই, প্রয়োজনও নেই। ওঁর লেখনিই তেমন। খোদার উপরে কেউ খোদকারি করে? দুই পরিচালক সেটা খুব ভাল করে জানেন।
অনির্বাণ: টোটা যা বলার বলে দিয়েছে। আমার আর কিছু বলার নেই।
কল্পন: একদম তা-ই।
প্রশ্ন: পুজোয় চারটি ছবিমুক্তি। তাই নিয়ে গত দু’বছরের মতো লড়াই শুরু...
টোটা: (থামিয়ে দিয়ে), কোনও আপত্তি নেই। যা খুশি করুন। মারামারি, লাঠালাঠি, কামড়াকামড়ি— সব হোক। কিন্তু বাংলা ছবি সারাক্ষণ আলোচনায় থাকুক। বাংলা ছবি নিয়ে আলোচনা যেন বন্ধ না হয়।
প্রশ্ন: চারটি বড় বাজেটের ছবি ফেলে দর্শক কেন বাড়ি বসে মুঠোফোনে ফেলুদা দেখবে?
টোটা: গত শীতে একই ভাবে চারটি বড় ছবি মুক্তি পেয়েছিল। ‘খাদান’, ‘চালচিত্র’, ‘সন্তান’, ‘পাঁচ নম্বর স্বপ্নময় লেন’। সঙ্গে ‘বহুরূপী’ ছিলই। সেই সময় মুক্তি পেয়েছিল আমাদের ‘ফেলুদা’। তখনও দেখেছি, দর্শক প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে পছন্দের ছবি দেখছেন। আবার মুঠোফোনে আমাদেরও দেখছেন। কারণ, এটা বাংলা বিনোদন দুনিয়ার সেরা সময়। টলিউড আবার ছন্দে ফিরছে। সেই জায়গা থেকেই বলছি, এ বছরের পুজোতেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। লক্ষ্মীপুজোর পর আপনিই ফোন করে আমায় সে কথা জানাবেন (হাসি)। তখন আমি বলব, কী করে সম্ভব হল।
প্রশ্ন: পর্দার ‘ফেলুদা’রা কাঠমান্ডুতে থাকবেন। টোটা, অনির্বাণ, কল্পন পুজোয় কী করবেন?
টোটা: কয়েকটি পুজো উদ্বোধন আছে। সেগুলো করব। তার পর টানা বাড়িতে বিশ্রাম। প্রচুর পড়ব। জানেন, কাজের চাপে পড়াশোনাটা হয় না। খাওয়া-দাওয়া করব। ভোররাতে হয়তো বাড়ির লোকেদের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে পারি।
অনির্বাণ: এ বছর বেড়াতে যাওয়া নেই। অনেক বছর পরে আবার কলকাতায় থাকব। আমারও কয়েকটি পুজো উদ্বোধন আছে। বাকি সময় নিজের সঙ্গে কাটাব। গান শোনা, পড়াশোনা, খাওয়া-দাওয়া আর ঘুম। পুজো বলে বাড়তি উন্মাদনা নেই।
কল্পন: অনেকেই হয়তো ভাবছেন, বিয়ে করেছি বলে হয়তো খুব ঘুরব। না, সেটা হবে না। হ্যাঁ, টুকটাক তো ঘুরবই। আসলে, আমার স্ত্রীও ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখতে খুব একটা ভালবাসেন না। আমরা হয়তো বন্ধুদের বাড়ি যাব। সেখানে বসে আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া হবে।
রহস্য সমাধানে ফেলুদা। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: অনীক দত্তের ‘যত কাণ্ড কলকাতাতেই’ ছবিতে ‘তোপসে’ গোয়েন্দা হয়ে গেল! কোনও পুজোয় বড়পর্দায় টোটা ‘ফেলুদা’ হবেন না?
টোটা: (স্থির দৃষ্টিতে একটু তাকিয়ে), এই স্বপ্ন কে না দেখে? সবটাই উপরওয়ালা আর সন্দীপ রায়ের উপরে নির্ভর করছে। এর জন্য আমি বিশপ লেফ্রয় রোডে রায়বাড়ির সামনে ধরনা দিতে পারি।
অনির্বাণ: বলুন না আপনারা। বাবুদা (সন্দীপ রায়) কথা শুনলে আনন্দবাজার ডট কম-এর নামে ফ্লেক্স বানিয়ে শহর ঢেকে দেব।
কল্পন দরাজ হাসিতে বুঝিয়ে দিলেন, তিনিও এটাই চান।