International Women's Day special

নারী মানেই দেহসর্বস্ব নয়, তাদের মধ্যে বুদ্ধিমত্তাও রয়েছে, এটা বোঝাতে আর কত যুগ কেটে যাবে: ঋতুপর্ণা

হতেই পারে, কোনও পুরুষের মধ্যে নারীসুলভ গুণ বা বৈশিষ্ট্য বেশি। তাতে সমস্যা কোথায়? আমার তো কোনও সমস্যা হয় না! উদাহরণ হিসাবে মনে পড়ছে ঋতুপর্ণ ঘোষের কথা।

Advertisement

ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২৫ ১৭:৪৭
Share:

নারী দিবসে অকপট ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। ছবি: সংগৃহীত।

নারীদের লড়াইয়ের কোনও আদি-অন্ত নেই। লড়াই চলতেই থাকে এবং এর কোনও বিকল্প নেই। আমার জীবনে ধারাবাহিক ভাবে চলে আসছে লড়াই। এই জায়গা থেকে আমার উপলব্ধি, লড়াই আর লড়াইয়ের ক্ষমতা নিয়েই বুঝি নারী জন্মেছে। এত প্রতিকূলতার মধ্যে সে লড়ে যায়, লড়ে নেয়। যত দিন থাকব, থাকবে সে আমাদের সঙ্গে। তবে হ্যাঁ, লড়াইয়ের লক্ষ্য যেন স্থির থাকে। লক্ষ্যহীন লড়াই একটা সময়ের পর অর্থহীন, মূল্যহীন— অন্তত আমার কাছে তা-ই। এই লক্ষ্য নিজেকেই তৈরি করতে হবে। সেই লক্ষ্য ধরে এগিয়ে যেতে হবে। অনেক সময়েই হয়তো নানা কারণে পিছু হটতে হয়। তার পরেও এগিয়ে চলাই কাম্য।

Advertisement

আমার মনে হয়, নারী যেন বহমান নদী। নদীপথে অনেক নুড়ি, বালি, কাঁকর জড়ো হয়। তাতে নদীর গতি রুদ্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। নদী কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে সব পেরিয়ে এগিয়ে চলে। আমরা নারীরাও যেন তাই-ই। এ ভাবেই বাধা-বিপত্তি ঠেলে সরিয়ে প্রতি মুহূর্তে এগিয়ে যাই। যত ক্ষণ না আমাদের কেউ এসে ধ্বংস করে দেয়। যদিও নারীকে ধ্বংস করা এত সহজ নয়।

একুশ শতকেও নারী পণ্য না মানুষ— এই নিয়ে তর্ক হয়। আমার চোখে নারী স্বাধীন, নিজস্ব পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকা সম্পূর্ণা। যে নারী সংসার-সন্তান সামলে এগিয়ে চলেন। যিনি পারেননি, পারেন না বা করতে চান না— তিনিও। নারীকে দশভুজা হতেই হবে— এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। সে যেমন, তাতেই সে পরিপূর্ণ। হ্যাঁ, একসঙ্গে অনেক কিছু করতে পারলে আরও ভাল। অবশ্যই সেটি তার বাড়তি গুণ। একই ভাবে না থাকলেও কোনও ক্ষতি নেই।

Advertisement

এগুলো যদি নারীর গুণ হয় তা হলে কোনও পুরুষ যদি নারীসুলভ হন সেটিও তাঁর গুণ, অন্তত আমি মনে করি। হতেই পারে, কোনও পুরুষের মধ্যে নারীসুলভ গুণ বা বৈশিষ্ট্য বেশি। তাতে সমস্যা কোথায়? আমার তো কোনও সমস্যা হয় না! বরং যাঁরা এই ধরনের মানুষদের কটাক্ষ করেন, ব্যঙ্গ করেন— আমার তাঁদের নিয়ে আপত্তি, তাঁদের নিয়ে সমস্যা। এটা তাঁদের অশিক্ষা। উদাহরণ হিসাবে মনে পড়ছে ঋতুপর্ণ ঘোষের কথা। ঋতুদার সঙ্গে যতগুলো কাজ করেছি সেগুলো আলাদা মাত্রা যোগ করেছে আমার জীবনে। আজ মনে হয়, ঋতুদা শরীরে-মনে নারীর বৈশিষ্ট্য ধারণ করেছিলেন বলেই যে কোনও মেয়েকে খুব ভাল বুঝতে পারতেন। ওঁর ছবিতে নারী চরিত্র তাই অন্য ভাবে ধরা দিত। ওঁকেও অনেক কটাক্ষ সহ্য করতে হয়েছে। ঋতুদার জীবদ্দশায় ওঁর কাজ, ওঁর গুণের থেকে ওঁর নারীসুলভ আচরণ বেশি আলোচিত। এটা সমাজের অশিক্ষা, আমাদের সমস্যা। ঋতুপর্ণ ঘোষের নয়।

এই জায়গা থেকেই বলতে ইচ্ছে করছে— নারী মানেই দেহসর্বস্ব নয়, তাদের মধ্যে বুদ্ধিমত্তাও রয়েছে। এটা বোঝাতে আর কত যুগ কেটে যাবে? প্রকৃতি নারীকে এ ভাবেই তৈরি করেছে, তাকে সাজিয়েছে। তার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। সেই দেহকাঠামোই নারীর প্রতি লোলুপ করেছে পুরুষকে, আজও! আদিম, বর্বর যুগের কথা না হয় আলাদা। তখন মানুষের শিক্ষা ছিল না। নারী-পুরুষ লিঙ্গভেদ নয়, সকলেই মানুষ— এই বোধ তাদের ছিল না। এখন তো আমরা নিজেদের শিক্ষিত বলে দাবি করি! তার পরেও নারীদেহ কেন ভোগ্যপণ্য? কেন তার উপর এখনও পাশবিক অত্যাচার চলবে? আমাদের সমাজের ত্রুটি। প্রকৃত শিক্ষার অভাব। তাই এখনও নারী পাশবিক অত্যাচারের শিকার। আরও সচেতনতার প্রয়োজন। আরও বেশি করে প্রতিবাদী হতে হবে। নারীর নিজের অধিকার নিয়ে সরব হতে হবে, তবে যদি অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। ইদানীং কেন জানি মনে হয়, সহ্য করতে করতে নারী এমন জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে যে সে-ও প্রয়োজনের তুলনায় বেশিই নীরব!

সমাজ, সমাজে নারীর অবস্থান নিয়ে অনেক কথা হল। এ বার আমার পেশা দুনিয়ার দিকে ফিরে দেখি?

সপরিবার ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। ছবি: সংগৃহীত।

হ্যাঁ, আমাদের পেশায় এখনও নায়কেরাই এগিয়ে। উপার্জন, সম্মান, যশ, খ্যাতি, প্রতিপত্তি— সব দিক থেকে। ইদানীং কখনও-সখনও নায়িকা বেশি পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন। সেটা যদিও খুব কমই ঘটে। এখন আগের তুলনায় নারীকেন্দ্রিক ছবিও বেশি তৈরি হচ্ছে। সেই সব ছবিতে কাজ করে উপার্জনের ক্ষেত্রে হয়তো নায়িকা এগিয়ে থাকেন। কিন্তু তার সংখ্যাও খুবই কম। যে দিন নায়ক-নায়িকা উভয়েই সমান গুরুত্ব পাবেন, একমাত্র সে দিন এই সমস্যা মিটবে।

এর সঙ্গে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জড়িয়ে রয়েছে। সেই নায়িকা যদি উচ্চাকাঙক্ষী হন, তা হলে কী হবে?

কেন বললাম এই কথা? কারণ, একজন নারীর এই চাওয়া পেশা এবং ব্যক্তিগত জীবন— দু’দিকেই চরম অশান্তি ডেকে আনে। আশা ভোঁসলেজিও এই মত সমর্থন করে এক সময় বলেছিলেন, এই মানসিকতার মেয়েদের সংসার করা উচিত নয়। মেয়েদের উচ্চাশা এখনও পরিবার, সমাজ এবং পুরুষ মেনে নিতে পারে না। নারীদের উচ্চাকাঙক্ষী হওয়াতে আমি দোষের কিছু দেখি না। উঁচুতে উঠতে কে না চায়?

এই প্রসঙ্গে শর্মিলা ঠাকুরের একটা কথা মনে পড়ছে। সুমন ঘোষ পরিচালিত ‘পুরাতন’ ছবি দিয়ে ১৪ বছর পরে বাংলা ছবিতে ফিরলেন। ছবির প্রযোজনা এবং অভিনয়ের সুবাদে খুব কাছ থেকে দেখলাম ওঁকে। পরিপূর্ণ এক নারী। সৌন্দর্য, শিক্ষা, রুচি, অভিনয় প্রতিভার সমাহার তাঁর মধ্যে। পেশাজীবনের পাশাপাশি সংসার সামলানো, নিখুঁত ভাবে স্ত্রী-মা-দিদার ভূমিকা পালন করা— একজন নারীই পারে এত কিছু করতে। আমার চোখে শর্মিলা ঠাকুর তাই আদর্শ নারী।

আর এক নারীর কথা না বললে নারী দিবস নিয়ে আমার ভাবনা যে অসম্পূর্ণ। তিনি আমার মা নন্দিতা সেনগুপ্ত। মাত্র তিন মাস আগে মাকে হারিয়েছি। আমার জীবনপথের ধ্রুবতারা। সারা ক্ষণ মাকে মনে পড়ছে। মায়ের বলা কথা, মায়ের গায়ের গন্ধ, মায়ের ভাবনা— আমাকে যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছে। মা আমার জীবনকে যে ভাবে গুছিয়ে দিয়ে গিয়েছেন, তিনি না থাকলে আজকের ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তকে কেউ পেতেন না। মায়ের কথা বলতে বসলেই ইদানীং চোখ ভিজে যায়, ‘মা হারানো কী যন্ত্রণা বোঝাই বলো কেমন করে।’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement