শোভা সেন
গণনাট্য আন্দোলনের পথিকৃৎ নাটক ‘নবান্ন’ এবং তাঁর মঞ্চে আবির্ভাব একই সঙ্গে ঘটেছিল। প্রথম নাটকেই গোটা বাংলার দর্শক সাধারণের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন শোভা সেন। সেই প্রবীণ অভিনেত্রীর রবিবার সকালে জীবনাবসান হয়েছে।
৯৪ বছরের শোভা বছর পাঁচেক আগে অবধিও নিয়মিত মঞ্চে অভিনয় করেছেন। প্রথম পক্ষের সন্তান উদয়ন মারা গিয়েছিলেন সম্প্রতি। শোভাও মাসখানেক আগে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। মেয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া দত্ত রবিবার জানিয়েছেন, বার্ধক্যজনিত কারণেই ভুগছিলেন লাগাতার। এ দিন সকালে দক্ষিণ কলকাতার বাড়িতেই তিনি মারা যান। তাঁর ইচ্ছা অনুসারে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শোভার দেহ দান করেন পরিজনেরা।
বরাবরের বামমনস্ক শোভার প্রয়াণে শোকপ্রকাশ করেছেন সিপিএম নেতৃত্ব।
সাবেক পুববাংলায় ফরিদপুরে ডাক্তার-বাড়িতে জন্মানো বেথুন কলেজের ছাত্রী শোভার সঙ্গে গণনাট্য সংঘের যোগাযোগ হয় বাম মনস্ক দেবপ্রসাদ সেনের সঙ্গে বিয়ের পরে। যদিও অভিনয়কে কেন্দ্র করেই অশান্তির সূচনা এবং বিচ্ছেদ। উৎপল দত্তকে বিয়ে করার পরে শোভার জীবনে মোড় ঘুরে যায়। এলটিজি বা পিএলটি গ্রুপে শোভার ভূমিকা ছিল অভিভাবকের মতোই।
উৎপল দত্ত, শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্যদের সঙ্গে নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’, ঋত্বিক ঘটকের ‘নাগরিক’-এর মতো ছবিতে অভিনয়ও করেন তিনি। অসমাপ্ত ছবি ‘বেদেনি’তেও অভিনয় করছিলেন তিনি। ১৯৫২ সালে হিন্দি ছবি ‘বাবলা’-য় অভিনয়ের সুবাদে দেশের সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কারও পেয়েছিলেন শোভা। উৎপল দত্তের পরিচালনায় ‘লেডি ম্যাকবেথ’-এর ভূমিকায় অভিনয় শোভার শিল্পীজীবনের আর একটি দিকচিহ্ন।
শোভা-উৎপলের কন্যা বিষ্ণুপ্রিয়ার কথায়, ‘‘বাবার বহু নাটকের চরিত্রচিত্রণই মাকে ভেবে!’’ ‘অঙ্গার’, ‘কল্লোল’, ‘ফেরারি ফৌজ’, ‘টিনের তলোয়ার’, ‘ব্যারিকেড’— বহু নাটকেই জাত চিনিয়ে গিয়েছেন শোভা। আবার মৃণাল সেনের ‘এক আধুরি কহানি’, ‘একদিন প্রতিদিন’-এও দাপটে অভিনয় করে গিয়েছেন। ক’বছর আগেও ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘আবহমান’-এ প্রবীণ শোভা সেনের অভিনয় দর্শককে স্পর্শ করেছিল।
নাট্যব্যক্তিত্ব অসিত বসু-র সংযোজন: উৎপল দত্তের এলটিজি-র শেষপর্বে এবং পিএলটি-র গোড়ার পর্বে প্রোডাকশন ইনচার্জ হিসেবে খুব কাছ থেকে দেখেছি শোভাদিকে। উৎপলদার অনেক কিছু ছেলেমানুষের মতো ছিল। চট করে রেগে
যেতেন, যাকে-তাকে যা খুশি বলে ফেলতেন। শোভাদি সব সামলাতেন ঠান্ডা মাথায়। শুধু দাপুটে অভিনয়বৈচিত্র্যই নয়, দলের জন্য টাকা তোলার মতো সাংগঠনিক কাজেও সমান দক্ষ ছিলেন তিনি। আমি তো বলব, পৃথিবীতে এমন প্রেমিকা আর দেখিনি। উৎপল দত্তের উত্থানের নেপথ্যে শোভার ভূমিকা সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে।
শোভাদির একটা স্নেহের দিক ছিল। কখনও বকেছেন, আবার ভালবেসে খোঁজ নিয়েছেন। পিএলটি ছাড়ার পরেও ব্যক্তিগত সম্পর্ক টাল খায়নি। ওঁকে শেষ দেখতে গিয়েছি, গত বছরের বিশ্বকর্মা পুজোয়, শোভাদির জন্মদিনে। শেষ দিকে, সব ভুলে যাচ্ছিলেন। তখন দেখতে কষ্ট হতো খুব। মনে হচ্ছে, বাংলার প্রতিবাদী নাটক এবং আমি, উভয়েই আবার মাতৃহারা হলাম।