৮০ র্বাণী

ভাল থেকো জ্যাঠামশাই

অপুর আশি বছর হচ্ছে আগামী সোমবার! তাতে শুধু টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রি নয়। আলোড়িত অনেকেই। যেমন মুম্বইয়ে বিদ্যা বালন। জুহুর সমুদ্র ঘেঁষা অ্যাপার্টমেন্ট থেকে তিনি ফোনে ধরলেন গল্ফ গ্রিন বাড়ির বাগানে বসে থাকা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-কে। উদ্দেশ্য ছিল জন্মদিনের সাক্ষাৎকার! হয়ে গেল তুমুল ফোন-আড্ডাঅপুর আশি বছর হচ্ছে আগামী সোমবার! তাতে শুধু টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রি নয়। আলোড়িত অনেকেই। যেমন মুম্বইয়ে বিদ্যা বালন। জুহুর সমুদ্র ঘেঁষা অ্যাপার্টমেন্ট থেকে তিনি ফোনে ধরলেন গল্ফ গ্রিন বাড়ির বাগানে বসে থাকা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-কে। উদ্দেশ্য ছিল জন্মদিনের সাক্ষাৎকার! হয়ে গেল তুমুল ফোন-আড্ডা

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
Share:

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

বিদ্যা বালন এমনিতে খুব আত্মবিশ্বাসী। শ্যুটিং থেকে ফিল্ম প্রোডাকশন কোনও কিছুতেই তাঁর নার্ভাসনেস নেই। কিন্তু সেদিন একদম অন্য অভিজ্ঞতা। বড় পর্দায় ডিটেক্টিভ, আইটেম গার্ল সেজে অভিনয় করা এক ব্যাপার। আর বাস্তবে রিপোর্টার হয়ে সাক্ষাৎকার নেওয়া অন্য ঘটনা।

Advertisement

কিন্তু বিদ্যা রাজি।

আনন্দplus-এর হয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিনের ৮০-তম সাক্ষাৎকারটা নেবেন তিনি।

Advertisement

তাঁর আগে ব্যক্তিগত মেসেজ সঙ্গে নিয়ে ফুলের তোড়া পাঠালেন সৌমিত্রর কাছে। সঙ্গে জন্মদিনের কেক আর উষ্ণ অভিনন্দন।

‘ভাল থেকো’ দিয়ে একদিন যে যাত্রা শুরু করেছিলেন এই শহরে, আবার ফিরে গেলেন সেখানেই। কথার পরে কথা সাজিয়ে লিখে ফেললেন অন্য এক ‘কহানি’।

বিদ্যা: এত নার্ভাস লাগছে... আমি কি বাংলাতে বলব?

আনন্দplus: বিদ্যা, সৌমিত্রবাবুকে ফোনটা দিচ্ছি।

সৌমিত্র: বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে বলো বিদ্যা। অসুবিধে নেই।

বিদ্যা: ওহ্ গড! কেমন আছেন সৌমিত্রদা? আপনি কিন্তু আমার জ্যাঠামশাই। মনে আছে তো?

সৌমিত্র: বেশ মনে আছে। বেশ আছি। এই বয়সে তো কিছু কিছু অসুবিধে হয়ই। কিন্তু তা-ও ভাল আছি। তুমি কেমন আছ?

বিদ্যা: আমিও ভাল আছি।

সৌমিত্র: তোমার পাঠানো ফুল আর কেকটা দারুণ সুন্দর।

বিদ্যা: হ্যাপি বার্থডে ইন অ্যাডভান্স। অ্যাম সরি, কথায় কথায় খুব হেসে ফেলছি। আসলে খুব নার্ভাস হয়ে আছি। থ্যাঙ্ক গড সৌমিত্রদা মুখোমুখি বসে তো আপনার সাক্ষাৎকার নিতে হয়নি!

সৌমিত্র: আমি যখন বাড়িতে বললাম তুমি আমাকে ফোন করবে, আমার বাড়িতেও সবাই সেটা শুনে খুব খুশি।

বিদ্যা: আমার মনে আছে টেকনিশিয়ান্স স্টুডিয়োতে প্রথম আপনার স্ত্রী-র সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার। প্লিজ ওঁকে আমার প্রণাম জানাবেন।

সৌমিত্র: নিশ্চয়ই। তুমি এখন কী ছবি করছ?

বিদ্যা: আমি মহেশ ভট্টর চিত্রনাট্যে একটা ছবি করছি। নাম ‘হমারি অধুরি কহানি’।

সৌমিত্র: ওহ্, বেশ। নিশ্চয়ই ভাল হবে।

বিদ্যা: আমরাও তাই আশা করছি। মহেশ ভট্ট ১৪ বছর পর চিত্রনাট্য লিখেছেন। আশা করছি ভাল হবে।

সৌমিত্র: আমিও সদ্য সুজয় ঘোষের সঙ্গে একটা শর্ট ফিল্ম করলাম। আমার সঙ্গে অভিনয় করেছে রাধিকা আপ্তে।

বিদ্যা: রাধিকা? ওহ্, ও তো ‘অন্তহীন’য়ে ছিল।

সৌমিত্র: আর টোটা রায়চৌধুরী। সুজয়ের সঙ্গে কাজ করেও খুব মজা পেয়েছি।

বিদ্যা: জানি, জানি। ও তো পুরো পাগল! খুব মজা করে কাজ করে।

সৌমিত্র: এ রকম সিনেমা-পাগল মানুষেরই তো দরকার।


ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

বিদ্যা: সেটে দেখেছি কী অসম্ভব এনার্জি সুজয়ের।

সৌমিত্র: সত্যিই তাই। কোনও কিছুতেই হতাশ হয় না। ধরো একটা শট দিচ্ছি। হয়তো প্রথম বার সেটা ঠিক মতো হল না। ও কিন্তু বলবে দারুণ হয়েছে। তার পর বলবে, ‘প্লিজ, আরও একবার নিই।’ তার ফলেই কিন্তু ব্যাপারটা অন্য রকম হয়ে যায়।

বিদ্যা: জানেন, ‘হয়তো তোমারি জন্য’ গানের কথাগুলো আমি সুজয়কে দিয়ে জোর করে রোমানে লিখিয়েছিলাম। ওই গানটা আমার খুব পছন্দ। তার পর আমি গানের কথাগুলো শিখেওছিলাম কিছুটা।

সৌমিত্র: গানটা সত্যিই চমৎকার। এ রকম দু’তিনটে গানই এখনও বেঁচে আছে।

বিদ্যা: আমি টিভিতে বহু কাল আগে এই গানটা দেখেছি। কিন্তু একজন অবাঙালি হয়েও...যদিও আমি নিজেকে বাঙালি মনে করি...তবে সে অন্য প্রসঙ্গ... এই গানের রেশ আমার মধ্যে থেকে গিয়েছে।

সৌমিত্র: ওই গানটা মান্নাদা গেয়েছিলেন। তখন ওঁর খুবই অল্প বয়েস। গলাও ছিল তরতাজা।

বিদ্যা: আমি তো মান্নাদার সঙ্গে দেখা করতে বেঙ্গালুরু গিয়েছিলাম। অনুরোধ করেছিলাম ‘হয়তো তোমারি জন্য’ এবং ‘আমি যে জলসাঘরে’ এই গানদু’টো যদি গেয়ে শোনান। উনি অনুরোধ রেখেছিলেন। কী অসাধারণ অভিজ্ঞতা! আচ্ছা, এ বার তা হলে সাক্ষাৎকারটা শুরু করি?

সৌমিত্র: হ্যাঁ, শুরু করো তা হলে।

বিদ্যা: পাঁচটা প্রজন্মের পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন আপনি...

সৌমিত্র: এ ভাবে তো ভেবে দেখিনি কখনও... কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ঠিকই বলছ। সত্যজিৎ রায় থেকে তপন সিংহ, এখন সুজয় ঘোষ...

বিদ্যা: পাঁচ প্রজন্মের যে পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করেছিলেন, তাঁদের এক এক জনের ধরন ছিল এক এক রকম। কী ভাবে তাঁদের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন? যেমন আপনি বললেন সুজয় আপনাকে কাজ করার সময় বলেন, আরেকটা টেক দেবেন...

সৌমিত্র: প্রাথমিক স্তরে তেমন তফাত নেই। যাঁরা নিজেদের কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস, তাঁরা খুব ফোকাসড্। কিন্তু তাঁদের কাজের ভাষাটা আলাদা। তাই অভিনেতাদের তাঁরা একেক রকম ভাবে ট্রিট করেন। পরিচালক তপন সিংহের কথা যেমন মনে পড়ছে। উনি যখন কোনও নির্দেশ দিতেন, সেটা অভিনেতাদের অনুভূতিকে মাথায় রেখেই দিতেন। খেয়াল রাখতেন অভিনেতারা যেন বিরক্ত না হন। এখনকার পরিচালকেরা অভিনেতাদের বন্ধু হয়ে যান।

বিদ্যা: একদম ঠিক। কখনও কখনও তাঁরা আপনাকে সম্ভ্রম করলেও, বন্ধুত্বটা কিন্তু থেকেই যায়।

সৌমিত্র: আমার কখনও কখনও মনে হয় ওরা একটু ভয়ও পায়। সে জন্যই আমি কাজের শুরুতেই পরিচালকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নিই। সেটা না করলে আমিই অস্বস্তিতে পড়ে যাই। এতে কাজ শেষ হলেও বন্ধুত্বটা থেকেই যায়।

বিদ্যা: আপনার কি মনে হয় বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ ভাল কাজ বের করে আনতে পারে?

সৌমিত্র: একে অপরকে প্রশংসা করাটা ভাল কাজের জন্য খুব দরকারি। ৫৫ বছরের কেরিয়ারে আমি তিনশোরও বেশি ছবি করেছি। মাত্র একবারই এক পরিচালক আমার কাজের প্রশংসা করেননি। খুব খারাপ লেগেছিল আমার। সেই ছবিটার কথা আজও ভুলতে পারিনি। আমিও পরিচালকদের ভাল দিকগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনদের সঙ্গে কাজ যে করেছি এই ভাবমূর্তিটা আমি কখনওই জাহির করি না। একজন পেশাদার অভিনেতার সব পরিচালকের সঙ্গেই সমান স্বচ্ছন্দ হওয়া উচিত।

বিদ্যা: এটা তো অবিশ্বাস্য! আপনি তো সে অর্থে এমন অনেক পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন। তা সত্ত্বেও আপনি চেষ্টা করেন তাঁদের সেরাটা খুঁজে নিতে।

সৌমিত্র: এটা না করলে আমি টানা এত দিন ধরে কাজ করতে পারতাম না। একজন পেশাদার অভিনেতাকে খারাপ ছবিতেও অভিনয় করতে হয়।

বিদ্যা: সত্যিই সেটা অসাধারণ সৌমিত্রদা। ক্ষমা করবেন এটা বলার জন্য, কিন্তু এখন এমন অনেক অভিনেতার সঙ্গে আমরা কাজ করি যাঁরা মনে করেন তাঁদের জ্ঞান পরিচালকদের থেকে অনেক বেশি। অনেক নতুন অভিনেতা। কিন্তু তাঁদের কী ব্যাগেজ। আমার ধারণা কাজ করতে গেলে পারস্পরিক শ্রদ্ধাটা খুব জরুরি। সত্যি এটা দারুণ বলেছেন! অভিনেতাদের এর থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।

সৌমিত্র: এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা ছাড়া সিনেমা কখনও এত এক্সাইটিং হত না। একটা ছবি ঠিক যেন একটা জাহাজের মতো। আর পরিচালক হল সেই জাহাজের ক্যাপ্টেন। অভিনেতারা হল অসাধারণ সব নাবিক।

বিদ্যা: ৫৫ বছর ধরে অভিনয় করছেন আপনি...

সৌমিত্র: হ্যাঁ। আমি ১৯৫৮-তে প্রথম অভিনয় করি।

বিদ্যা: উফ্, ভাবা যায় না। এখনও এত অনুপ্রেরণা কোথায় পান?

সৌমিত্র: না। আসলে আমি খুব খুঁতখুঁতে। কিছুতেই সন্তুষ্ট হই না।

বিদ্যা: সত্যি? এই অতৃপ্তির কারণেই কি এত দিন চালিয়ে যাচ্ছেন?

সৌমিত্র: হ্যাঁ অবশ্যই। এই অতৃপ্তি থেকেই যায়। আজও রাতে বাড়ি ফিরে ভাবি সারাদিন কী করলাম? ভাবি এই জায়গাটায় ভুল করেছি, বা আমার ওই ভাবে তাকানোটা ঠিক হয়নি।

বিদ্যা: কী আশ্চর্য! এখনও রাতে ফিরে আপনি আপনার অভিনয়ের দৃশ্যের কথা ভাবেন?

সৌমিত্র: কখনও মনে হয় এটাই ঠিক আছে। ইন্ডাস্ট্রি থেকে যতই পাই না কেন আমি কখনওই আমার জায়গা আঁকড়ে বসে থাকি না। ওটা করে আমি মোটেই পরিতৃপ্ত নই। অভিনেতা হিসেবে আমার একটা দায়িত্ব থেকেই যায়। আমাকে কাজ করে যেতেই হবে। থেমে থাকলে চলবে না। ভাবনা থামিয়ে দিলে চলবে না। কাজ নিয়ে নানান পরীক্ষানিরীক্ষা করে যেতে হবে। তবে যদি বলা হয় তিরিশ বছর আগে করা কোনও ছবিকে কি এখন করলে আরও ভাল করব আমার উত্তর হবে ‘না’। এটাই আমার থিয়োরেটিক্যাল প্রোপোজিশন। তিরিশ বছর আগে আমার সমস্ত সত্তা দিয়েই আমি সেই ছবিতে অভিনয় করেছি। সেই সত্তাটা আমি আবার ফিরিয়ে আনতে পারব না। টেকনিক্যালি হয়তো তখন আরও ভাল অভিনয় করতে পারতাম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার অভিনয় আরও পরিণত হয়েছে। তবু মনে হয়, আবার ‘অপুর সংসার’য়ে অভিনয় করতে পারব না।

বিদ্যা: এত অতৃপ্তির মধ্যেও কাজের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও যা করেছেন, তা নিয়ে সন্তুষ্টি রয়েছে।

সৌমিত্র: ঠিক তৃপ্তি নয়। নিজের একটা অ্যাসেসমেন্ট। তিরিশ বছর আগে যা করেছি, আমার সেই সত্তাটা সেখানেই রয়েছে... আমি জীবন নিয়ে কী ভেবেছি, জীবনকে কী ভাবে দেখেছি, সেই সব অনুভূতিই আমার কাজের মধ্যে আছে। তোমার কী মনে হয়, বিদ্যা?

বিদ্যা: একদম তাই।

সৌমিত্র: তুমি আমার চেয়ে অনেক ছোট। তোমার পাঁচ বছর আগের কোনও ছবি যদি দেখো, দেখবে তুমি তোমার এখনকার অভিজ্ঞতা আর পরিণত মন নিয়ে অভিনয় ক্ষমতাকে আরও ভাল কাজে লাগাতে পারতে। কিন্তু ওই ছবিটা করার সময় যে আবেগ তোমার ভেতর ছিল, সেটা কিন্তু আর ফিরিয়ে আনতে পারবে না।

বিদ্যা: ইন্টারেস্টিং। এত বছরের অভিজ্ঞতার পরেও আপনি এ কথা বলছেন। অভিনেতারা এটা পড়ে স্বস্তি পাবেন। আমরা যে রিক্রিয়েট করতে পারি না তা জেনেও ভাল কাজ করার খিদেটা আমাদের মধ্যে সমান ভাবে রাখা যায়...

সৌমিত্র: হ্যাঁ, খিদেটা থেকেই যায়।

বিদ্যা: একটা কথা বলা হয়নি। আপনার মতো কিন্তু আমিও কেপ্রিকর্ন। ১ জানুয়ারি আমার জন্ম।

সৌমিত্র: ওহ্, বিলেটেড হ্যাপি বার্থডে।

বিদ্যা: ধন্যবাদ সৌমিত্রদা। আমি সবাইকে বলি ভাল অভিনেতারা সবাই কেপ্রিকর্ন হন। আমি সব সময় আপনার নাম নিয়ে বলি, দেখুন, উনি কত ছবিতে অভিনয় করেছেন। আমিও আশা করতে পারি। কী ভালই যে লাগে একই আবেগ নিয়ে আপনাকে এ ভাবে কাজ করে যেতে দেখে।

বিদ্যা: মন খারাপ হলে কি নিজের পুরনো কোনও ছবি দেখেন?

সৌমিত্র: ‘চারুলতা’। ‘অশনি সংকেত’। শুধু মাত্র ‘অশনি সংকেত’য়ের ‘র’নেস-এর জন্যই দেখব। আসলে যে অঞ্চলকে ঘিরে ওই ছবির গল্পটা তৈরি হয়েছে, আমি সেই অঞ্চলের লোক। আমি দেখেছি মানিকদা কী চমৎকার ভাবে একইসঙ্গে মানুষের অসহায়তা, প্রেম দু’টোই দেখিয়েছেন।

বিদ্যা: কোনও হিন্দি বা ইংরেজি ছবি দেখতে ইচ্ছে করে না?

সৌমিত্র: আমি যে কোনও দিন ‘গরম হাওয়া’ দেখতে পারি।

বিদ্যা: ‘গরম হাওয়া’? বাহ্ দারুণ।

সৌমিত্র: আরও আছে। তপন সিংহের শর্ট ফিল্ম ‘আদমি অউর অওরত’ বা মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’।

বিদ্যা: হ্যাঁ, আমি ‘ভুবন সোম’য়ের অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করেছি।

সৌমিত্র: সুহাসিনী মুলে?

বিদ্যা: হ্যাঁ, আমি ওঁকে বলেছিলাম আমি ‘ভুবন সোম’ দেখেছি। উনি শুনে বেশ অবাক হয়েছিলেন ।

সৌমিত্র: এতক্ষণে বুঝতে পারলাম কেন তোমার অভিনয়ের ক্যানভাসটা এত বড়। এই ধরনের ছবি দেখার অভ্যেস আছে বলেই তোমার কাজের মান এত উন্নত।

বিদ্যা: আবারও আপনাকে ধন্যবাদ। আজকের এই কথাগুলো আমি আমার ডায়েরিতে লিখে রাখব।

সৌমিত্র: আমি যেটা ফিল করি তোমার ব্যাপারে, সেটাই কিন্তু বলেছি। আমি মনে করি কোনও ব্যক্তি যদি সংস্ক্ৃতিমনস্ক না হন, তা হলে তিনি নিজে থেকে কোনও সংস্কৃতি তৈরি করতে পারেন না।

বিদ্যা: আমি খুব ভাগ্যবতী যে প্রথম থেকেই সঠিক সুযোগগুলো পেয়েছি এবং সেই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে নিজেকে তৈরি করতে পেরেছি। সিনেমায় ‘ভাল থেকো’র হাত ধরেই আমার যাত্রা শুরু।

সৌমিত্র: জানো, যখন নতুন কোনও ছবির অফার পাই, একটাই চিন্তা মাথায় ঘোরে। সুস্থ থাকব তো? চ্যালেঞ্জ নিতে ভয় পাই না। শুধু প্রার্থনা করি যেন সুস্থ থাকতে পারি।

বিদ্যা: আমরাও প্রার্থনা করি। বছরের পর বছর আপনি ভাল থাকুন। আর অতৃপ্তি নিয়ে বাঁচুন...

সৌমিত্র: আমার খুব ভাল লাগে প্রতিভাবান নতুন সব অভিনেতাদের দেখতে। আমি দেখেছি জাতীয় স্তরে প্রচুর ভাল ছেলেমেয়ে কাজ করছে।

বিদ্যা: রাইট। একদম ঠিক। আচ্ছা সৌমিত্রদা এমন কোনও চরিত্র আছে, যেটা করতে আলাদা করে নিজেকে তৈরি করতে হয়েছিল?

সৌমিত্র: কখনও কখনও হয় যখন চরিত্রের প্রেক্ষাপট জানতে হয়, চরিত্র নিয়ে ভাবতে হয়। তবে সিনেমার থেকেও মঞ্চে অভিনয় করতে আমি অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ পাই। যেমন কিছু বছর আগে কলকাতায় ‘কিং লিয়ার’য়ে অভিনয় করেছিলাম। খুব সফল হয়েছিল সেটা। দারুণ চ্যালেঞ্জিং। প্রত্যেকটা দৃশ্যেই আমাকে প্রয়োজন ছিল। ক্লান্তি আসাটাই স্বাভাবিক। এই বয়সে লম্ফঝম্প করে সিঁড়ি চড়া, মঞ্চজুড়ে দাপিয়ে বেড়ানো মোটেই সহজ নয়। ভয় ছিল যাতে আহত না হই। কিন্তু সত্যিকারের চ্যালেঞ্জটা ছিল মনের। মানুষের মন বোঝা। সেটাও তো কম ব্যাপার নয়। ওটা ছিল আমার প্রথম কোনও শেক্সপিয়রের নাটকে অভিনয়। হয়তো ওটাই আমার শেষ শেক্সপিয়র অভিনয়।

বিদ্যা: আমি নিশ্চিত, ওটাই আপনার শেক্সপিয়রের শেষ অভিনয় হবে না। এবং মঞ্চে আপনি শেক্সপিয়র নিয়ে আরও অভিনয় করবেন। কোনও দিন যদি খুব কঠিন কোনও দৃশ্যে অভিনয় করতে হয়, তখন কি নির্দিষ্ট কোনও রুটিন মেনে চলেন?

সৌমিত্র: না, সে রকম কিছু নয়। আমি শরীরচর্চাটা কখনও বাদ দিই না। তুমি একজন অভিনেতা। তাই এটা তো মানবেই যে অভিনয় করতে গেলে প্রচুর এনার্জি দরকার। সেটা শরীরচর্চার মাধ্যমেই আসে।

বিদ্যা: তার মানে এক্সারসাইজের জন্যই আপনি এখনও এত তরুণ? এত সুদর্শন?

সৌমিত্র: (লজ্জায় লাল হয়ে) কী যে বলো? আমি এখন আর মোটেও সুদর্শন নই।

বিদ্যা: আপনি জানেন, এটাই সত্যি সৌমিত্রদা।

সৌমিত্র: এখন অবশ্য অতটা শরীরচর্চা করতে পারি না। তার ছাপও পড়েছে চেহারায়। ছোট্ট একটা ভুঁড়িও হয়েছে।

বিদ্যা: আপনি কি কোনও ডায়েট মেনে চলেন?

সৌমিত্র: এখন মেনে চলতে হয়। হার্টের আর অন্যান্য শারীরিক কিছু সমস্যাও দেখা দিয়েছে। যেমন আমার পাঁঠার মাংস খাওয়া উচিত নয়। আমি সেই সব নিরামিষাশিদের কথা ভাবি যাঁরা কখনওই পাঁঠার মাংস খাননি। যাই আমার জন্য ধার্য থাক, তা নিয়েই আমি খুশি।

বিদ্যা: আচ্ছা, আমরা যখন নাটক নিয়েই কথা বলছি তখন নাসিরসাবের কথা বলতে চাই। আপনি আর নাসিরসাব বাংলা ছবিতে একসঙ্গে কাজ করেছেন। যদিও দুর্ভাগ্যবশত আপনাদের একসঙ্গে কোনও দৃশ্য ছিল না। নাটকে কি আপনি একসঙ্গে কাজ করতে চান?

সৌমিত্র: নাসির মঞ্চে খুব অ্যাকটিভ। গত দশ বছরে যত বার ওকে মিট করেছি, আমরা একসঙ্গে কাজ করার কথাই বলেছি। ও বলে, ‘দাদা চলুন, একসঙ্গে কিছু করি।’

বিদ্যা: সত্যি?

সৌমিত্র: হ্যাঁ, যদিও তা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু নাসিরের সঙ্গে কাজ করতে আমার খুবই ভাল লাগবে। ওকে যে কী অসম্ভব শ্রদ্ধা করি, সেটা বুঝিয়ে বলতে পারব না।

বিদ্যা: আপনাদের একসঙ্গে কাজ করাটা আমাদের কাছে একটা ট্রিট হবে।

সৌমিত্র: ও আমাকে বেশ পছন্দ করে। একবার বলেছিল ওর অভিনেতার জীবন পরিপূণর্র্তা পাবে তখনই, যখন ও কাউকে এমন ভাবে অনুপ্রাণিত করবে যে ভাবে আমি ওকে করেছি।

বিদ্যা: চমৎকার! আমি নাসির সাবের সঙ্গে তিনটে ছবিতে অভিনয় করেছি। খুব কম কথার মানুষ...। এ রকম কোনও চরিত্র আছে যা আপনি করতে চান? মঞ্চে যেমন আপনি শেক্সপিয়র করতে চেয়েছিলেন। শুনেছি আপনি না কি একটা ছবিতে এক পাড়ার গুন্ডার ভূমিকায় অভিনয় করতে চেয়েছিলেন?

সৌমিত্র: (হাসি) এ রকম কয়েকটা ইচ্ছে বোধহয় ছিল। কিন্তু এখন আর মনে পড়ছে না। আশি বছর বয়সে স্মৃতি বিস্মৃত হতে থাকে। হ্যাঁ, এ রকম কিছু চরিত্র বোধহয় আছে যাতে অভিনয় করতে আজও ইচ্ছে হয়।

বিদ্যা: আমার দুর্ভাগ্য, হিন্দি ছবিতে আপনাকে দেখতে পেলাম না।

সৌমিত্র: হ্যাঁ, অভিনয় ছেড়ে দেওয়ার আগে একটা করতেই হবে। বলো (হাসি)?

বিদ্যা: অবশ্যই। কত মানুষ মুখিয়ে আছে হিন্দি ছবিতে আপনার অভিনয় দেখবেন বলে। যদি ভাল চিত্রনাট্য পান, অভিনয়ের সম্ভাবনা কি আছে?

সৌমিত্র: তুমি তো ইন্ডাস্ট্রিটা জানো। সবটাই সুযোগের ওপর নির্ভর করছে।

বিদ্যা: ঠিক তাই। তবু আশা ছাড়ছি না।

সৌমিত্র: এবং আমি আশা করছি যদি সত্যিই হিন্দিভাষী ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ আসে, তা হলে আমি যেন আমার প্রিয় অভিনেতা নাসির আর বিদ্যা বালনের সঙ্গেই অভিনয় করি।

বিদ্যা: ওহ্, ধন্যবাদ। আমি এক্ষুনি জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম। হিন্দি ছবিতে আপনাকে যদি কাস্ট করতে বলা হয়, আপনি কাকে নেবেন? থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ। আপনাকে আরও কয়েকটা প্রশ্ন করার আছে। আসলে আপনার সঙ্গে কথা ফুরোতেই চায় না।

সৌমিত্র: প্লিজ...

আগামী সোমবার শেষ অংশ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন