Sheena Chohan Interview

নিজের চারপাশে মহিলাদের গণ্ডি টানতে হবে, ভেদাভেদের বিরুদ্ধে আমরা আজও লড়ছি: শিনা

জন্ম চণ্ডীগড়ে হলেও, বড় হয়ে ওঠা কলকাতায়। তাই ঝরঝরে বাংলা বলতে অসুবিধা হয়নি কোনও দিনই। অভিনয় করেছেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবিতে। সেখান থেকে বাংলাদেশ, হলিউড পেরিয়ে এ বার হিন্দি ভাষায় প্রথম বার বড় পর্দায় শিনা চৌহান।

Advertisement

স্বরলিপি দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০২৫ ১২:৫৪
Share:

কলকাতায় বড় হওয়া শিনার। ছবি: সংগৃহীত।

কলকাতার সঙ্গে তাঁর বহু দিনের সম্পর্ক। জন্ম চণ্ডীগড়ে হলেও, বড় হয়ে ওঠা কলকাতায়। তাই ঝরঝরে বাংলা বলতে অসুবিধা হয়নি কোনও দিনই। অভিনয় করেছেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবিতে। সেখান থেকে বাংলাদেশ, হলিউড পেরিয়ে এ বার হিন্দি ভাষায় প্রথম বার বড় পর্দায় শিনা চৌহান। মহারাষ্ট্রের সন্ত তুকারামের স্ত্রীর চরিত্রে তিনি। ছবি ইতিমধ্যেই সাড়া ফেলেছে। কিন্তু আবার কি শিনা ফিরবেন বাংলা ছবিতে? এমনই নানা বিষয় নিয়ে আনন্দবাজার ডট কমের সঙ্গে কথা বললেন অভিনেত্রী।

Advertisement

প্রশ্ন: কলকাতায় বড় হয়েছেন। এখনও মনে পড়ে এই শহরকে?

শিনা: হ্যাঁ অবশ্যই। অভিনয় সফরের শুরু তো এখান থেকেই। আর সবচেয়ে খুশির খবর ‘সন্ত তুকারাম’ কলকাতার প্রেক্ষাগৃহেও রমরমিয়ে চলছে। এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে!

Advertisement

প্রশ্ন: ‘সন্ত তুকারাম’ সমাজের জাতি, লিঙ্গ-সহ বিভিন্ন ভেদাভেদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। বর্তমানে আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি, যেখানে ধর্ম, জাতি, ভাষাগত ভেদাভেদের খবর বার বার উঠে আসছে। কী ভাবে দেখেন আপনি?

শিনা: এই ছবিরও মূল বার্তা ভেদাভেদের বিরুদ্ধে। এটাও সত্যি, ৩০০ বছর আগে আমরা যে বিষয়গুলির বিরুদ্ধে লড়াই করছিলাম, এখনও তা করে চলেছি।

প্রশ্ন: আপনি নিজেও একজন সমাজকর্মী, মানবাধিকারের জন্য কাজ করেন। এখনও সমাজে এই ধরনের ভেদাভেদ কেন রয়ে গিয়েছে বলে মনে হয়?

শিনা: গত দশ বছর ধরে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছি। আমার পর্যবেক্ষণ হল, সমাজে, মানুষের মধ্যে এবং শিশুদের মধ্যে সমতার গুরুত্ব নিয়ে সচেতন করতে হবে। সেটাই একমাত্র পথ। লড়াই করে সমাধান সম্ভব নয়। বরং মানুষকে বুঝতে হবে এবং বোঝাতে হবে, ভারতের এই বৈচিত্র কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ছবিতেও এই সংহতির কথাই বলা হয়েছে। সন্ত তুকারাম নিজে ছিলেন তথাকথিত ‘নিচু জাতের’। ঈশ্বরের নাম জপ করার অনুমতি পর্যন্ত পেতেন না। তিনিই নিজের লেখালিখির মাধ্যমে সংহতি ও সাম্যের কথা বুঝিয়েছেন। এই ভেদাভেদের লড়াই আজকের নয়। যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা তো মানবিকতার প্রথম পদক্ষেপ।

প্রশ্ন: আপনার কাজের পরিধিরও ব্যাপ্তি রয়েছে। একই সঙ্গে মঞ্চে অভিনয়, ওটিটি-তে কাজ, বড় পর্দা, এবং সমাজকর্মীর কাজ। কিন্তু ঠিক কোন ক্ষেত্র আপনাকে পরিচিতি দিয়েছে?

শিনা: সত্যি বলতে, প্রথমেই মঞ্চের অভিনয়ের কথাই বলতে হয়। থিয়েটার আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। কলকাতায় পাঁচ বছর ‘পদাতিক’ নাট্যদলের সঙ্গে ছিলাম। তার পরে দিল্লিতে অরবিন্দ গৌরের নাটকের দলে কাজ করেছিলাম। এখান থেকেই আমি, শিল্প, সৃজনশীলতা ও দর্শকের সঙ্গে যোগ স্থাপন করার বিষয়গুলি শিখেছিলাম।

প্রশ্ন: কলকাতায় নানা বদল এসেছে কলকাতায়। এখন কী ভাবে দেখেন এই শহরকে ?

শিনা: আমি আজ যেটুকু হতে পেরেছি, তার সমস্ত কৃতিত্ব আমি কলকাতাকেই দিই। আমার মা আমাকে অমলাশঙ্করের কাছে নাচ শিখিয়েছিলেন। তার পর দীর্ঘ পাঁচ বছর কলকাতায় মার্শাল আর্টের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। সাঁতার শেখা থেকে সঙ্গীতে প্রশিক্ষণ, সব কলকাতার অবদান। লোরেটো স্কুলে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পড়াশোনা করা থেকে শুরু করে দুর্গাপুজোর ভাসানে নাচ, এর সবটাই আমি করেছি। সংস্কৃতির দিক থেকে সমৃদ্ধ হয়েছি।

প্রশ্ন: প্রথম ছবিতেই আপনি দক্ষিণী তারকা মামুত্তির বিপরীতে অভিনয়ের সুযোগ এল কী ভাবে?

শিনা: মঞ্চে কাজ করতে করতেই এই সুযোগ আসে। প্রথম ছবিতেই বিপরীতে মামুত্তি। প্রথমে ভয় লেগেছিল। কিন্তু ক্রমশ বুঝলাম, ভয় পেলে চলবে না। কারণ পর্দায় মামুত্তির স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। অতএব সব ভুলে মন দিয়ে কাজটাই করেছিলাম।

প্রশ্ন: বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের দু’টি ছবিই— ‘মুক্তি’ ‘পত্রলেখা’ রবীন্দ্রনাথের কবিতানির্ভর। সেই সুযোগ কী ভাবে সুযোগ এল?

শিনা: আসলে আমি বেহালা বাজাতে পারি। স্কুলে বেহালা বাজাতাম। এই চরিত্রের জন্য বেহালা বাজাতে জানার প্রয়োজন ছিল। তার সঙ্গে বুদ্ধদেবদা চেয়েছিলেন অভিব্যক্তিপূর্ণ দুটো চোখ। রবি ঠাকুর তাঁর নির্মিত নারী চরিত্রদের চোখ নিয়ে খুব সুন্দর বর্ণনা করেছেন। গভীর চোখ, দেশীয় ছাপ রয়েছে, এমন মুখ খুঁজছিলেন বুদ্ধদেবদা।

প্রশ্ন: অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

শিনা: খুবই চরিত্রনির্ভর কাজ ছিল দুটোই। খুবই দেশীয়, প্রসাধনহীন, শিকড়ের কাছাকাছি দুটি চরিত্র। ‘মুক্তি’তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যার চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। ‘মুক্তি’র চরিত্রটি খুবই প্রতিবাদী ছিল। আবার ‘পত্রলেখা’য় চরিত্র ছিল এক গৃহবধূর।

প্রশ্ন: তার পরেই মোস্তফা সরোয়ার ফারুকির ‘পিঁপিড়া বিদ্যা’ ছবিতে অভিনয় করলেন। দুই বাংলার কাজের ধরনে কোনও পার্থক্য চোখে পড়েছিল?

শিনা: ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে সামান্য পার্থক্য তো থাকেই। কিন্তু মূল পার্থক্য পরিচালকদের কাজের ধরনে। ফারুকির কাজের ধরন যেমন খুবই স্বতঃস্ফূর্ত। ফারুকি হলেন মুম্বইয়ের অনুরাগ কাশ্যপের মতো। ওঁর সঙ্গে কাজ করতে গেলে সব সময়ে প্রস্তুত হয়ে যেতে হবে। ওই ছবির জন্য তো বাংলাদেশের উপভাষাও আমাকে রপ্ত করতে হয়েছিল। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা ছিল।

প্রশ্ন: বাংলা ছবিতে আর কাজ করলেন না। এখন দেখেন বাংলা ছবি?

শিনা: এমন নয় যে আর বাংলা ছবিতে কাজ করার কথা ভাবিনি। যখনই সময় পাই বাংলা ছবি দেখি। বিজ্ঞাপনী চিত্রতে অনেকের সঙ্গেই কাজ করেছি। যেমন অনীক দত্তের সঙ্গে কাজ করেছি। এ ছাড়াও অঞ্জনদা (অঞ্জন দত্ত), কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, সৃজিত (মুখোপাধ্যায়) সকলের সঙ্গেই যোগাযোগ রয়েছে। ভাল চিত্রনাট্যে সুযোগ পেলে এবং চরিত্র পছন্দ হলে নিশ্চয়ই কাজ করব।

প্রশ্ন: এ বার বলিউডের প্রসঙ্গে আসা যাক। কাজল ও মাধুরী দীক্ষিতের মতো অভিনেত্রীর সঙ্গে অভিনয় করেছেন। সেটে কেমন ব্যবহার পেতেন এমন দুই জনপ্রিয় অভিনেত্রীর থেকে?

শিনা: ওঁরা দু’জনেই খুবই পেশাদার অভিনেত্রী। ওঁদেরকে ‘আইকন’ বলাই যায়। এমন মানুষদের সঙ্গে কাজ করতে গেলে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়। কাজলের সঙ্গে আমার লড়াইয়ের দৃশ্য ছিল ‘ট্রায়াল’ ওয়েব সিরিজ়ে। ‘দ্য ফেম গেম’-এ মাধুরীর আপ্তসহায়কের চরিত্রে ছিলাম। ওঁরা দু’জনেই খুবই আন্তরিক। আমি ওঁদের দু’জনের সঙ্গে কাজ খুবই উপভোগ করেছি। আমি সব সময়ই সহ-অভিনেতাদের থেকে কিছু শেখার চেষ্টা করি।

প্রশ্ন: আবার ‘সন্ত তুকারাম’-এর প্রসঙ্গে ফেরা যাক। ছবিতে লিঙ্গ সাম্যের প্রসঙ্গও রয়েছে। কিন্তু মহিলারা আজও পুরুষতন্ত্রের শিকার। বিনোদন জগতে কখনও লিঙ্গ ভেদাভেদের শিকার আপনি হয়েছেন?

শিনা: অবশ্যই মহিলাদের রোজকার জীবনেই এমন নানা পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। আমিও কখনওই মুখোমুখি হইনি, সেটা বললে ভুল বলা হবে। এই ধরনের ভেদাভেদ দূর করার জন্য মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধার তো প্রয়োজন বটেই। তার সঙ্গে এই ধরনের পরিস্থিতির শিকার হলে, সরব হতে হবে। কথা বলতে হবে। সংগঠিত ভাবে কথা বললে সচেতনতা আসবে।

প্রশ্ন: গত কয়েক বছরে দেখা গিয়েছে, মহিলারা বিনোদন জগতে যৌন হেনস্থার ঘটনা নিয়েও সরব হয়েছেন। মালয়ালাম চলচ্চিত্র দুনিয়ায় এই নিয়ে একটি রিপোর্টও পেশ করা হয়। বলিউড, হলিউ়ড-সহ একাধিক চলচ্চিত্র জগতে কাজ করেছেন আপনি। আপনাকে কখনও হেনস্থার মুখে পড়তে হয়েছে?

শিনা: এটা সত্যিই খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সৌভাগ্যবশত আমাকে সরাসরি মুখোমুখি হতে হয়নি। আসলে নিজেকে সম্মান করতে জানা এবং চারপাশে একটা গণ্ডি টানতে জানা খুব জরুরি। যখনই কোনও কিছুতে অস্বচ্ছন্দ বোধ হচ্ছে, সেটা নিয়ে সরব হওয়া উচিত। কেউ সীমা ছাড়ানোর চেষ্টা করার আগেই একটা গণ্ডি টেনে দিন। এমনকি, কেউ যদি একসঙ্গে কফি খাওয়ার জন্যও ডাকেন, সেখানেও নিজেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

প্রশ্ন: আচ্ছা, নির্দিষ্ট সময় বেঁধে কাজ করা নিয়ে আপনার কী মত? গত কয়েক দিনে দীপিকা পাড়ুকোন ও সন্দীপ রেড্ডি বঙ্গার মধ্যে আট ঘণ্টার শুটিং নিয়ে তরজা চলছে।

শিনা: আমি বিষয়টা সম্পর্কে ভাল ভাবে ওয়াকিবহাল নই। আমি বিশ্বাস করি ‘এগ্রিমেন্ট’-এ। আপনি যদি কোনও কাজ করতে রাজি হন, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন, তা হলে সেটার থেকে সরে আসা উচিত নয়।

প্রশ্ন: আজকের যুগের সম্পর্কের প্রসঙ্গে আসা যাক। ‘সন্ত তুকারাম’ নিজের লক্ষ্যে পৌঁছনোর পথে তাঁর স্ত্রীকে পেয়েছিলেন পাশে। এমন সঙ্গী পাওয়া যায় এই যুগে?

শিনা: ছবিতে দেখা যাবে, প্রথম দিকে স্বামীর সঙ্গে ওঁর (অবলা জিজাবাই) সম্পর্কে ওঠাপড়া থাকে। স্বামীর থেকে প্রত্যাশা মতো ভালবাসা না পাওয়াতেই সমস্যার শুরু। কিন্তু পরে তিনি ক্রমশ বোঝেন, স্বামীর লক্ষ্য অনেক বৃহৎ। তখন স্বামীর স্বপ্নপূরণে যোগ দেন তিনিও। এমন হওয়া সত্যিই কঠিন। বলব না, আজ এমন হয় না। আমি বিশ্বাস করতে চাই, আজও এমন ভালবাসা হয়।

প্রশ্ন: মানুষের অধিকারের জন্য কাজ করেন। কখনও রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে?

শিনা: না, তেমন কোনও পরিকল্পনা নেই। তবে আমার একটা লক্ষ্য রয়েছে। মানবাধিকার নিয়ে সমস্ত বার্তা আমি লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement