Celebrity interview

‘লোকে হয়তো বলবে, শান আর কী গাইবে, বয়স হয়ে গিয়েছে ’, অকপট গায়ক

বাংলা ছবিতেও রয়েছে তাঁর অসংখ্য হিট গান। গেয়েছেন রবীন্দ্রসঙ্গীতও। এখন গান নিয়ে কী ভাবেন? মুম্বই থেকে খোলামেলা আলোচনায় শান তথা শান্তনু মুখোপাধ্যায়।

Advertisement

স্বরলিপি দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৮:৫৭
Share:

শান্তনু মুখোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।

তাঁর গানে মেতেছিল নব্বইয়ের দশক। এখনও ওই প্রজন্মের পছন্দের গানের তালিকায় তাঁর গান থাকে। ছবির গান থেকে স্বাধীন গান, সর্বত্রই তাঁর বিচরণ। বাংলা ছবিতেও রয়েছে তাঁর অসংখ্য হিট গান। গেয়েছেন রবীন্দ্রসঙ্গীতও। এখন গান নিয়ে কী ভাবেন? মুম্বই থেকে খোলামেলা আলোচনায় শান তথা শান্তনু মুখোপাধ্যায়।

Advertisement

প্রশ্ন: ‘উয়ো পহলি বার’, ‘তনহা দিল’, ‘যব সে তেরে নয়না’, ‘চাঁদ সিফারিশ’— অসংখ্য সফল গান আপনার সফরে পার হয়ে গিয়েছে তিন দশকেরও বেশি এখন পিছন ফিরে দেখলে কেমন লাগে?

শান: সফর এখনও চলছে। তাই পিছন ফিরে খুব একটা দেখি না। তবে অবসর সময় মাঝেমধ্যে ভাবি, সত্যিই তো! অনেকগুলো বছর কাটিয়ে ফেলেছি। সেই ১৯৯০ সালে এসেছিলাম। কত কী হয়ে গেল তার পরে। এই সফর সত্যিই সুন্দর। আমার কোনও অনুশোচনা নেই এই সফরে। অনেক ভালবাসা পেয়েছি। বহু দেশে বহু ভাষায় কাজ করেছি! জানি না, আমি কতটা যোগ্য ছিলাম।

Advertisement

প্রশ্ন: এত সাফল্যের পরেও নিজের যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ! এটা কি বিনয়?

শান: এটা বিনয় নয়। আমার বাবার জন্মদিন ৯ সেপ্টেম্বর। বাবা (মানস মুখোপাধ্যায়) বেঁচে থাকলে আজ ৮২ বছর বয়স হত। তিনি তো অনেক বেশি যোগ্য ছিলেন। কিন্তু যোগ্যতা অনুযায়ী সাফল্য তিনি পাননি। কত প্রতিভাবান শিল্পী রয়েছেন, তাঁরা পরিচিতি পান না। সেই দিক থেকে আমি তো সত্যিই সৌভাগ্যবান।

প্রশ্ন: রিয়্যালিটি শো-তে বিচারকের আসনে আপনি থেকেছেন সঞ্চালনাও করেছেন এখনকার রিয়্যালিটি শো-তে কি কোনও বদল দেখতে পান?

শান: কিছু বদল তো এসেছে বটেই। এখন ভুলভ্রান্তিগুলো মেরামত করার পরে গানগুলো শ্রোতাদর্শকের কাছে তুলে ধরা হয়। কোনও সুরে ভুল থাকলে সেগুলি প্রযুক্তির মাধ্যমে ঠিক করে, তার পর প্রকাশ করা হয়। শ্রোতা-দর্শক হয়তো নিখুঁত গানটাই শুনতে চান।

প্রশ্ন: তা হলে রিয়্যালিটি শো-তে রিয়্যালতো রইল না বিষয়টা!

শান: একেবারেই তা-ই। আমি মনে করি, প্রতিযোগীরা প্রত্যেকে খুব প্রতিভাবান। তাই প্রযুক্তির মাধ্যমে নিখুঁত করার প্রয়োজনই পড়ে না। আসল গানটাই মানুষের ভাল লাগবে। মানুষকেও তো বিচার করতে দিতে হবে, কার গান একটু বেশি ভাল। কার গানে সামান্য সুর নড়েছে। কারও কণ্ঠ ভাল, কিন্তু গায়কি ভাল না। আগে কিন্তু এইগুলো শ্রোতারাও উপভোগ করতেন। কিন্তু এখন হয় না। সকলে যেন একই মাত্রায় গান গাইছেন। বিচারকদের পক্ষেও বিষয়টা কঠিন হয়ে যায়। তাঁরা ভুল ধরিয়ে দিচ্ছেন, কিন্তু কিছু ক্ষণ পরে সেই ভ্রান্তিগুলো ঢেকে দেওয়া হচ্ছে।

প্রশ্ন: তা হলে কে ভাল, কে একটু কম ভাল মানুষ বিচার করবে কী ভাবে!

শান: রিয়্যালিটি শো-এর একজনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, পরের সিজ়নে নাকি এই সব প্রযুক্তির কারিকুরি থাকবে না। আমিও এই বছর একটি নামী রিয়্যালিটি শোয়ের বিচারকের আসনে থাকছি (হাসি)।

প্রশ্ন: নতুন প্রজন্মের অনুভ জৈন, প্রতীক কুহাড়, এপি ঢিল্লোঁদের মতো স্বাধীন শিল্পীদের গান বেশ জনপ্রিয়! রেকর্ডে তাঁদের গান শুনতে ভাল লাগলেও, লাইভ অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে কিন্তু অন্য প্রতিক্রিয়া দেন শ্রোতারা কী বলবেন?

শান: এঁরা আসলে কেউই শুধু কণ্ঠশিল্পী নন। এঁরা সিঙ্গার-সং রাইটার। ভারতে বিষয়টা খুব প্রচলিত নয়। তবে আমিও কিন্তু বেশ কিছু গান নিজে লিখেছি ও গেয়েছি। তার মধ্যে ‘তনহা দিল’ও রয়েছে। তাই আমি মনে করি, গীতিকার ও সুরকার হওয়ার পাশাপাশি কণ্ঠশিল্পী হতে চাইলে, সেই দিকটাও ঘষামাজা করা উচিত। মানুষ টাকা খরচ করে শুনতে আসে, তাদের ভুলভাল শোনানো যায় না। মানুষের ভাল না লাগলে তো তারা হতাশ হয়ে চলে যাবে। সেটা হওয়া উচিত নয়।

প্রশ্ন: তা হলে কী করণীয়?

শান: রাতারাতি ভাল কণ্ঠশিল্পী তো হয়ে ওঠা যাবে না। তবে লেগে থাকতে হবে। আমার মনে হয় এই সিঙ্গার-সং রাইটাররাও সেটাই করছেন। তাঁরা দিন দিন উন্নতি করছেন। পেশাদার কণ্ঠশিল্পীদের সঙ্গে সরাসরি তুলনাও ঠিক নয়। তাই কতটা নিখুঁত হচ্ছে সেই দিকে না দেখে ওদের চেষ্টাটাই দেখা উচিত। কিছু চেষ্টা তো থাকা উচিত। চেষ্টা থাকলে সেটা গানের মধ্যে প্রতিফলিত হবেই।

প্রশ্ন: শাহরুখ খান, সইফ আলি খান, আমির খানদের কণ্ঠে আপনার অসংখ্য গান প্রত্যেক তারকার কণ্ঠের সঙ্গেই মিলে যেত আপনার কণ্ঠ

শান: একটা ঘটনা বলি। ‘তারে জ়মিন পর’ ছবিতে ‘বম বম বোলে’ গানের মাঝে কিছু কথা ছিল। আমি সেগুলো রেকর্ড করি। কিন্তু সেটা শুনতে বেমানান লাগছিল। ওই কথাগুলো আমিরের কণ্ঠের সঙ্গে মিলছিল না। তাই শেষ পর্যন্ত ওই সংলাপগুলিতে ওঁর কণ্ঠই থাকে। আমার গানের সঙ্গে ওঁর কথা মিলে যায়। এর থেকেই বোঝা যায়, কেন তিনি ‘মিস্টার পারফেকশনিস্ট’। আমিরকে অন্য একটা গানের উদাহরণ দিয়েছিলাম। ‘হম তুম‍’ ছবিতে একটি গানের মধ্যে কিছু সংলাপ ছিল। সেগুলি আসলে সইফ বলেছিলেন। সেটা আমির জানতেন না, কারণ আমার আর সইফের কণ্ঠ মিলেমিশে গিয়েছিল। সেই একই পদ্ধতি অনুসরণ করে ‘বম বম বোলে’ রেকর্ড করা হয়।

প্রশ্ন: আচ্ছা, এখন প্রায় সব ছবিতেই প্লেব্যাক গাইছেন অরিজিৎ সিংহ নতুন গায়কেরা সেই গায়কি কি নকল করার চেষ্টা করছেন?

শান: অরিজিৎ আমাদের বাংলার গর্ব। আর নতুনরাও ওঁর গায়কি নকল করার চেষ্টা করছেন। কারণ তাঁদের কাছে আর কোনও উপায় নেই। আমি নিজেও কিছু গাইড ভোকাল শুনেছি। মনে হয় যেন অরিজিতের গায়কি নকল করেই পাঠানো হয়েছে। ওই উচ্চারণ, ওই গাওয়ার ধরন। অনেক ছবির প্রযোজকদের ধরাছোঁয়ার বাইরে এখন অরিজিৎ। তাঁরাও অরিজিতের মতো কাউকে খুঁজে পেতে চাইছেন। অগত্যা সেই চাহিদা পূরণের জন্য নতুন গায়কেরা অরিজিৎকে অনুকরণ করছেন।

প্রশ্ন: কিন্তু একসময় আপনি, সোনু নিগম, কেকে, উদিত নারায়ণদের গায়কি স্বতন্ত্র ছিল নানা রকমের গায়কি শোনা যেত

শান: আসলে মানসিকতার একটা বিষয় রয়েছে। আজকাল ভাল গান বা খারাপ গান বলে কিছু হয় না। আজকাল হিট আর ফ্লপের দাঁড়িপাল্লায় সবটা মাপা হয়। অরিজিৎ গাইলেই গান হিট, এটা তো তৈরিই হয়ে গিয়েছে। সত্যিই তো সেটাই হচ্ছে। তাই অরিজিৎ না হলে, ওঁর অনুকরণকারী দিয়ে কাজ চালালেই হয়ে যাচ্ছে। এটা তো একটা মানসিকতা। অনুকরণের থেকে স্বতন্ত্র গায়কি শুনতে পেলেই তো ভাল লাগে। সবাই তো অরিজিৎ হতে পারবেন না!

প্রশ্ন: রবীন্দ্রসঙ্গীতও গেয়েছেন আপনি

শান: (হেসে) খুব কড়া ভাবে স্বরলিপি মেনে গান গেয়েছি।

প্রশ্ন: এখন অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা হচ্ছে আপনার জীবনে এখন রবীন্দ্রসঙ্গীতের অবস্থান ঠিক কোথায়?

শান: সঙ্গীতায়োজন নতুন ভাবে করাই যায়। পরীক্ষানিরীক্ষা করা যায়। কিন্তু ভাল ভাবে করতে হবে। ফলাফল যেন ভাল হয়। শুধু হুজুগের বশে করলে সেটা খুব একটা সম্মানজনক হয় না। সম্প্রতি বাবুল সুপ্রিয় একটা প্রজেক্ট করছেন অমিতাভ ভট্টাচার্যের সঙ্গে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের হিন্দি অনুবাদ থাকবে সেখানে। আমার তো খুব ভাল লেগেছে।

প্রশ্ন: রবীন্দ্রসঙ্গীতের হিন্দি অনুবাদ আপনি কী ভাবে দেখেন!

শান: ভাষা দুটো অন্য। অবশ্যই সরাসরি অনুবাদ তো হয় না। কিন্তু গানের অর্থ বজায় রেখে ওরা কাজটা করেছে। আবেগটা তুলে ধরতে পেরেছে ওরা। আসল গানের সঙ্গে যতটা মিল রাখা যায়, ওরা তা চেষ্টা করেছে। আমি শুনেছি। অসাধারণ কাজ করেছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত বহু মানুষ শুনতে চান। কত সুন্দর কথা রয়েছে এই গানে। কিন্তু বাংলায় বলে অনেকের কাছে পৌঁছোয় না। তাঁদের কাছেও এই গানগুলো পৌঁছোবে। এমন পরীক্ষামূলক কাজ করলে তো ভালই লাগে।

প্রশ্ন: সোনু নিগম একসময়ে মিউজ়িক মাফিয়াদের কথা বলেছিলেন বলিউডের স্বজনপোষণ নিয়ে ছিল তাঁর এই মন্তব্য সম্প্রতি তাঁর গাওয়া পরদেসিয়াগানকে অনেকেই সোনু নিগমের প্রত্যাবর্তন বলছেন আপনারও এমন প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় অনুরাগীরা

শান: হ্যাঁ অসাধারণ একটা গান গেয়েছে সোনুভাই। কামব্যাক তো একমাত্র সোনু নিগমই করেছে! (হাসি) ও যাদের একসময় ‘মিউজ়িক মাফিয়া’ বলেছিল, তাঁরাই ওকে কাজ দিয়েছেন। এই জন্য ব্যক্তিগত ভাবে কোনও কিছু গ্রহণ না করাই ভাল। কেউ শত্রু নয়। আমি তখনও বলেছিলাম, সবই বাণিজ্যকে ঘিরে। সোনুর অসংখ্য অনুরাগী। মিউজ়িক কোম্পানিগুলোও সেটা বুঝেছে যে, সোনুকে দিয়ে গাওয়ালে, ওর অসংখ্য অনুরাগী গানটা শুনবেন। সবই ব্যবসার উপর নির্ভর করছে। আমি যদি বলি, ‘কাল থেকে গান গাইব না’। তার পরের দিনই একটা দারুণ সুযোগ এলে কি আমি গানটা গাইব না? সোনুভাইয়ের সাফল্য দেখে আমারও মনে হচ্ছে, আমারও একটা কামব্যাক হতে পারে (হাসি)।

প্রশ্ন: আপনি কাজ ছেড়ে দেওয়ার কথা বললেন সত্যিই কি সঙ্গীতশিল্পীদের একটা সময় পরে অবসর নেওয়া উচিত?

শান: আমি মনে করি না অবসর নেওয়া উচিত। আসলে মানুষ ভাবে, কণ্ঠশিল্পীদের একই রকম গলা থেকে যাবে সারা জীবন। একটু আমাদের কথাও ভেবে দেখুক মানুষ। গান ছেড়ে দিলে আমরা কী করব? যেমন অভিনেতাদের একটা সময়ের পরে কলেজপড়ুয়ার চরিত্রে অভিনয় করা ছেড়ে দেওয়া উচিত। তেমনই কণ্ঠশিল্পীরাও নিজেদের বয়স অনুযায়ী গান গাইতেই পারেন। ৭০-৭৫ বছর বয়সেও আমি নায়কের গান গাইলে মানুষ গ্রহণ করবে না। মান্নাদা ৯০ বছর বয়সে অনুষ্ঠান করতেন। মানুষ সেটা মন দিয়ে শুনতেন। সেখানে যদি কেউ বলেন, আগের মতো শুনতে লাগছে না, সেটা তো মেনে নেওয়া যায় না। সেটা খুবই বোকা বোকা। বয়স নিয়ে মানুষকে লজ্জায় ফেলা, যেন সবাই চিরকাল যুবক-যুবতী থেকে যাবে। তবে অবশ্যই নিজের কণ্ঠের সঙ্গে মানানসই গান গাওয়া উচিত।

প্রশ্ন: খুব শীঘ্রই কলকাতায় অনুষ্ঠান করছেন কেমন অনুভূতি হচ্ছে?

শান: অনেক দিন পর এই শহরে অনুষ্ঠান। ভয়ও করছে। এটুকুই চাই, সবাই যেন আসেন। নব্বইয়ের দশকের বলিউডের গানের সঙ্গে আমি বাংলা গানও গাইব। গাইতে গাইতে নাচবও।

প্রশ্ন: এখন মঞ্চে গানের সঙ্গে পারফর্ম করা, নাচাও একই রকমের জরুরি?

শান: হ্যাঁ অবশ্যই। নতুন প্রজন্মও দেখতে আসবে। তবে অনেকেই হয়তো বলবেন, শানদার বয়স হয়ে গিয়েছে, কী এমন করবে। তবে আমি বিশ্বাস করি, অনুষ্ঠান দেখার পরে তাঁরাই বলবেন, শানের তো বয়স আরও কমে গিয়েছে। বরং আগের চেয়ে আমার সেই উদ্যম আরও বেশি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement