ডুয়ার্সে শ্যুটিংয়ে আবীর চট্টোপাধ্যায়।
দূরের পাহাড়গুলোর ওপর দিয়ে সরে যাচ্ছে সাদা মেঘ। এক ঝলকে দূর থেকে মনে হচ্ছে, এ যেন এক মেঘ মুলুক। ঠোঁটে সিগারেট ধরিয়ে সবে একটু হাঁটতে বেরোলেন ব্যোমকেশ, হঠাৎ মেঘ পেরিয়ে এক ফালি রোদ।
ঠিক মিনিট কয়েকের মধ্যেই আকাশ কালো করে মুষলধারায় বৃষ্টি। দুধ-সাদা পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে দৌড়লেন সত্যান্বেষী।
পাশ থেকে মুচকি হেসে অজিত বললেন, ‘‘রহস্য সমাধানে এসেছি, আর আবহাওয়া একটু রহস্যময়ী হবে না, তা কি ঠিক?’’
এবং গত কয়েক দিনে, ডুয়ার্সের আনাচে কানাচে, প্রতি মুহূর্তে এই রহস্যের সন্ধান পেয়েছে ব্যোমকেশ বাহিনী। কখনও গরুমারা অভয়ারণ্যে ঘন জঙ্গলের মধ্যে হাতির আক্রমণ, আবার কখনও বা দেড়শো বছরের পুরনো গোরস্থানে ‘ভূত’ দেখা —ব্যোমকেশ-এর এই ‘পর্ব’ সব অংশেই রহস্য-রোমাঞ্চে ভরপুর!
“প্রায় ১৬-১৭ ঘণ্টা কাজ হচ্ছে। ঘুম নেই। তার মধ্যে এইটুকু সাসপেন্স মন্দ কী,” চশমার কাচ মুছতে মুছতে বলছিলেন আবীর চট্টোপাধ্যায়। পর্দার ব্যোমকেশ।
একমত পরিচালক অরিন্দম শীলও। ‘ঈগলের চোখ’ সুপারহিট। তবু ব্যোমকেশ নিয়ে বাড়তি সতর্ক তিনি। গত শীতে ‘হর হর ব্যোমকেশ’-এর সাফল্যের পর, ‘ব্যোমকেশ পর্ব’ তাঁর এই সিরিজের দ্বিতীয় ছবি। এবং পরিচালক মানছেন, পর্দার রহস্যের সঙ্গে প্রাকৃতিক রহস্য মিলে যাওয়াতে থ্রিলটা আরও বেড়েছে। কথা শেষ হতে না হতেই ঝুপ করে সন্ধে নামল লাটাগুড়ির রাঙামাটি চা-বাগানে। প্রায় ঘুটঘুটে অন্ধকারে মোবাইলের আলো জ্বেলে গাড়িতে ওঠার আগেই, ইউনিটের এ দিক ও দিকে ফিসফাস — ওই ঝোপের আড়ালে কে যেন হেঁটে গেল! তবে কী ওটা…?
• জঙ্গলে ওরা কারা?
…ভূত?
শুনে ব্যোমকেশ কোনও উত্তর দিলেন না। মৃদু হাসলেন শুধু। সিগারেটে টান দিয়ে অজিতও জাস্ট উড়িয়ে দিলেন। কিন্তু, লোকে বলে রাঙামাটি চা-বাগানের দেড়়শো বছরের পুরনো গোরস্থানের আশেপাশে সন্ধে নামলেই নাকি দেখা মেলে ‘তাদের’।
ভূত নয়। চিতাবাঘ।
মাসখানেক আগে বাগানে ঢুকে পড়েছিল একটি চিতাবাঘ, এবং এই ভরা বর্ষায় বাগান চত্বরে কড়া সতর্কবার্তা — বাঘ হইতে সাবধান।
তবে, ব্যোমকেশরা আর সে সব মানছেন কই। ‘অমৃতের মৃত্যু’-অবলম্বনে তৈরি ‘ব্যোমকেশ পর্ব’ ইউনিটের এখন একমাত্র লক্ষ্য, আবহাওয়ার রহস্য উদঘাটন করে, নির্বিঘ্নে শ্যুটিং শেষ করা।
• প্রেম নেই, ব্যোমকেশ!
রাস্তার দু’ধারে ঘন জঙ্গল, হালকা বৃষ্টি। গাড়িতে পাশে বসে স্ত্রী সত্যবতী। তবু, ব্যোমকেশের মুখ ভার। পুরনো কাগজপত্র ঘাঁটছেন। পড়ছেন কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ নথি। পাশে সুন্দরী স্ত্রী। বাইরে রোম্যান্টিক লোকেশন, তবু যেন উত্তরবঙ্গে এসে ব্যোমকেশের প্রেম উধাও!
কখনও তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন বদ্রী দাসের পুরনো বাংলোয়। আবার কখনও বিশু মল্লিকের (কৌশিক সেন) সঙ্গে গোপনে দেখা করছেন দেড়শো বছরের পুরোনো গোরস্থানে। মুখ চোখ সিরিয়াস, সব সময়েই যেন কী একটা ভাবছেন। ‘হর হর ব্যোমকেশ’-এ যদিও প্রকাশ পেয়ে থাকে তার রোম্যান্টিক সত্তা, এই ‘পর্ব’-এ কেমন যেন প্রেম কম পড়িয়াছে। মানছেন আবীরও। “এ বারের ব্যোমকেশ আগের থেকে সিরিয়াস। কাউকে ভয় পায় না। আর সবটাই অন ইয়োর ফেস,’’ বলছিলেন আবীর।
চেনা মাঠেও সতর্ক। কলকাতায় ঘোড়ায় চড়া শিখেছেন। এবং বোধহয় সে কারণেই, নেওড়ানদী চা-বাগানের শতাব্দী প্রাচীন বাংলোয় ঢোকার আগে মুচকি হেসে অজিতের উক্তি — ‘‘তুমি বদলে গেছ ব্যোমকেশ!’’
• ‘নীলকন্ঠ পাখি’ আর হাতির খোঁজে...
মাঝরাতে শ্যুটিং সেরে লাটাগুড়ির হোটেলে ফেরার সময় গরুমারা অভয়ারণ্যের মাঝখানে থামল একটা গাড়ি। রাস্তার দু’পাশে ঘন অন্ধকার। জনমানবহীন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর, জানলার কাচ নামিয়ে মুখ বাড়ালেন এক সুন্দরী মহিলা। সত্যবতী। আসলে সোহিনী সরকার। পাশেই বসে যূথিকা ওরফে জুন মাল্য। তো এই ঘন অরণ্যে কী করছেন তাঁরা?
উত্তরটা দিলেন সোহিনীই। “হাতি দেখতে চাই। তাই একটু ওয়েট করছিলাম।”
ব্যোমকেশ যখন ব্যস্ত নিজের কাজে, বই পড়ে আর বান্ধবী জুনের সঙ্গে ঘুরে-বেড়িয়ে দিন কাটছে সত্যবতীর। মেক-আপ ভ্যানে বসে পড়ছেন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে’।
‘অমৃতের মৃত্যু’ গল্পে সত্যবতীর কোনও উল্লেখ নেই, তবু ছবিতে তাঁকে রেখেছেন পরিচালক। ‘‘ব্যোমকেশ-সত্যবতীর কেমিস্ট্রিটা দারুণ। এ বারেও অন্য ফ্লেভার থাকবে,’’ বলছিলেন অরিন্দম।
• হাওয়া বদল
শুধু ব্যোমকেশ কেন, এই ‘পর্ব’-এ তো অনেকটা বদলেছেন অজিত নিজেও। ‘হর হর ব্যোমকেশ’য়ের ঋত্বিক চক্রবর্তীর সঙ্গে এ বারের তফাত অনেকটা। গতবার যেমন প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর কবি সত্তা, এ বার তিনিও তাঁর বন্ধুর মতোই অ্যাক্টিভ। “আরে, ওটাই তো আসল অজিত। ব্যোমকেশ সরকারি কাজে এসেছে, আর অজিত ছুটি কাটানোর মুডে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, সমানে ব্যোমকেশের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে,” বলছিলেন ঋত্বিক।
• মুশকিল আসান!
সেবক স্টেশনে শিলিগুড়িগামী ট্রেনটা ঢুকতেই যাত্রীদের চোখে মুখে এক অদ্ভুত কৌতূহল। স্টেশনের সাইনবোর্ডে বড় বড় হরফে লেখা—সানতালগোলা। তবে কি রাতারাতি নাম বদলে গেল স্টেশনের?
আসলে, গল্পের সানতালগোলা স্টেশনকে পর্দায় তুলে আনতে সেবক-য়ে শ্যুট করছে ইউনিট। আর, তাই এই নামবদল!
স্টেশন চত্বরে অবশ্য আরেক অভিজ্ঞতা। ট্রেনের দৃশ্য শ্যুট করার কথা ছিল ভোর ছ’টায়। কিন্তু প্রচণ্ড বৃষ্টি পেরিয়ে ইউনিট যখন গন্তব্যে পৌঁছল, ঘড়ির কাঁটায় তখন প্রায় সাড়ে ন’টা। একেই ঘণ্টা তিনেক দেরি, তার ওপর স্টেশনে দাঁড়িয়ে একটা মালগাড়ি। ড্রাইভারের ডিউটি বদল, সুতরাং, দুপুর সাড়ে তিনটের আগে সেই মালগাড়ি সরানো যাবে না স্টেশন থেকে। কিন্তু পরিচালক নাছোড়, এই স্টেশনে, এই আলোতেই শট নেবেন তিনি।
“সিনেমা করতে এসে গোঁ ধরে থাকলে চলবে না। ফ্লেক্সিবিলিটি থাকাটা ভীষণ জরুরি,” মনিটরে চোখ রেখে বলছিলেন পরিচালক। একটু থেমে, যোগ করলেন: “এইটা কিন্তু দুই পরিচালক বন্ধু — কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় ও অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে শেখা। যেমন পরিস্থিতি, তেমন কাজ।”
• আবীর না যিশু
গাড়িতে ফেরার সময়, আবীর অবশ্য সাফ জানালেন অন্য ব্যোমকেশ যিশুর সঙ্গে তাঁর কোনও প্রতিযোগিতা নেই। “কীসের কম্পিটিশন? আমরা তো দু’ জনেই নিজেদের কাজ করছি,” বলছিলেন আবীর। কৌশিক সেন অবশ্য রাখঢাকে বিশ্বাসী নন। “আমার অঞ্জনদার শেষ ব্যোমকেশটা ভাল লাগেনি। যিশু অসাধারণ অভিনয় করেছিল, কিন্তু কোথাও যেন, আবীরকেই ব্যোমকেশ হিসেবে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমরা,” বলছিলেন কৌশিক।
এ ব্যাপারে মুখ খুলতে রাজি নন পরিচালক। শট পছন্দ না হওয়ায়, আরেক বার টেক করলেন। শট ওকে হল একটু পরে। অরিন্দম চেঁচিয়ে বললেন, “গ্রেট শট, আবীর!”
তখন সন্ধে নামছে জঙ্গলে। ঝিঁঝি পোকার ডাক। টিম ব্যোমকেশ চলল পরের লোকেশনে…
টেলিপ্যাথির জোর আছে...
সেই ‘সোনার কেল্লা’-র ফেলু-তোপসে। — নতুন ছবি ‘অন্দর কাহিনি’- তে
আবার একসঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়। ছবি: কৌশিক সরকার।