Interview of Rita Dutta Chakraborty

মেগাসিরিয়াল হল কারখানা, আমরা কতগুলো ফ্যাক্টরি চালাই, দৈনন্দিন উৎপাদনের জোগান দিই

বর্তমানে বাঙালিদের বাংলা শুনে আহত হন। একই সঙ্গে যাদবপুরের সাংসদ সায়নী ঘোষের ভাষার উপর দখল দেখে গর্ব বোধ করেন। দীর্ঘ টেলিভিশন জীবনে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে অকপট ঋতা দত্ত চক্রবর্তী।

Advertisement

সম্পিতা দাস

শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০২৫ ০৯:০৩
Share:

দীর্ঘ অভিনয় জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে অকপট ঋতা চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।

বাংলা ধারাবাহিকে প্রায় দু’দশক কাটিয়ে ফেলেছেন। বাড়িতে কড়াকড়ি ছিল। কিন্তু অভিনয়ের ইচ্ছেটা বহু বছর ধরে লালন করেছেন। একটা সময় ব্যস্ততা এতটাই ছিল যে, তিনটে শিফ্‌টে কাজ করছেন। রাজা সেন, রবি ওঝা থেকে তরুণ মজুমদারের মতো পরিচালকদের পছন্দের অভিনেত্রী। যদিও এখন ব্যস্ততা কমেছে। সু-অভিনেত্রী বলে নামডাক থাকা সত্ত্বেও সিনেমায় সুযোগ মিলেছে হাতেগোনা কাজে। বাংলা ভাষার একনিষ্ঠ অনুরাগী। বর্তমানে বাঙালিদের বাংলা শুনে আহত হন। একই সঙ্গে যাদবপুরের সাংসদ সায়নী ঘোষের ভাষার উপর দখল দেখে গর্ব বোধ করেন। এক বৃষ্টির বিকেলে যোধপুরের পার্কের সুসজ্জিত ফ্ল্যাটে কালো চা ও ওট্‌স বিস্কুট সহযোগে আনন্দবাজার ডট কম-এর সঙ্গে আড্ডায় অভিনেত্রী ঋতা দত্ত চক্রবর্তী।

Advertisement

প্রশ্ন: তৃপ্তি মিত্রের হাত ধরে অভিনয়ে আসা, তার পর?

তা: যাদবপুরে পড়তে এসে স্বাধীনতা পেলাম, যেটা ছোট থেকে পাইনি। বাড়িতে অভিনয় করার অনুমতি ছিল না। ছোটবেলা থেকে আকণ্ঠ খিদে ছিল অভিনয়ের প্রতি, বিশেষত থিয়েটারের প্রতি। তার পর বাদল সরকারের ওয়ার্কশপ করলাম, কলেজে নাটকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে শুরু করলাম। সেই সময় আমার এক বন্ধুর মারফত যুববাণীতে যাতায়াত শুরু। তার পর পাহাড়ী স্যান্যালের ভাইপো সোমনাথ স্যান্যাল আমাকে রেডিয়োয় অভিনয়ের জন্য বলেন। এ ছাড়াও শুম্ভু ভট্টাচার্যের কাছে নাচ শিখতাম। হঠাৎ পেটে একটা অসুবিধা শুরু হয় তখন তিনি আমাকে তৃপ্তি মিত্রের কাছে নিয়ে যান ।ওঁর কাছেই প্রথাগত ভাবে শিক্ষার শুরু। একটা সময় তো ওঁর বাড়িতে থাকতাম আমি। সাহচর্যটা অন্য ধরনের পেয়েছি। সকাল ৮টায় খাবার খেয়ে তার পর সারা দিন চলছে চর্চা। পরে বুঝেছি এই অভ্যেসটা কতটা দরকার ছিল।

Advertisement

প্রশ্ন: তৃপ্তি মিত্রের কাছে নাটক শিখলে কি বাণিজ্যিক কাজ করা যেত না?

তা: যেত না তো। কারণ শিক্ষা সম্পূর্ণ না হলে তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের বাইরে কাজ করতে দিতেন না। ছাত্রী যদি অভিনয় না পারে, তা হলে উনি মনে করতেন সেটা ওঁর অপমান। রাজা সেন (‘সুবর্ণলতা’ ধারাবাহিকের পরিচালক) জেঠিমার কাছে অনুমতি নিয়ে আমাকে ধারাবাহিকে কাজ করার প্রস্তাব দেন। তার পর থেকে যখন যে ডাকছেন, কাজ করে যাচ্ছি। অভিনয়ের জন্য প্রাণ দিতে পারি, কিন্তু মুখ ফুটে চাইতে পারি না।

প্রশ্ন: বাংলা ভাষা নিয়ে এত হইহই, আপনার সংস্কৃত নিয়ে পড়াশোনা রয়েছে, এখন চিত্রনাট্যে বাংলা ভাষার প্রতি কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়?

তা: আগের সঙ্গে তুলনা করলে এখন পার্থক্যটা ভীষণ রকম চোখে পড়ে। তখন ‘সুবর্ণলতা’ লিখতেন মোহিত চট্টোপাধ্যায়। যখন আমি ‘শ্রীরামকৃষ্ণ’ করি সেটা মানস দত্ত লিখতেন। আসলে ওঁরা তো অত কাজ নিতেন না একসঙ্গে। এখনকার চিত্রনাট্যকারদের তো নিজের হাতে লেখার সময় নেই। একসঙ্গে চার-পাঁচটা কাজ করছেন। লিখতে বসলে একটা ধারাবাহিকে চার-পাঁচটা সিন দেওয়া সম্ভব নয়। চাপটাও অনেক। তাঁরা হয়তো মুখে মুখে বলে দেন, তার পর কিছু লোক আছেন যাঁরা সেটা লেখেন। এ বার সবাই যে সব বানান জানবেন সেটা আশা করাও উচিত নয়। আজকাল চিত্রনাট্যে, বানান তো বললাম না আর, শব্দ অবধি এ দিক-ও দিক হয়ে যায়। ওটা আমাদের অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। আমরা সাজিয়ে নিই এখন। অনেককেই বলতে শুনেছি আজকাল নাকি সব বানান চলে! আসলে চলতে পারে না। বানান ভুল হলে যে সব উচ্চারণ একসঙ্গে ভুল হয়ে যাবে। নতুনদের একটু গাইড করে দিতে হয়। একজন অভিনেতা হিসেবে মনে হয় ‘ই’, ‘ঈ’ এর উচ্চারণগুলো বুঝিয়ে দিতে হবে। হয়তো দর্শক বুঝতেও পারবেন না। কিন্তু এটা আমার দায়িত্ব। তাই বানান জানাটা আগামী সব প্রজন্মের জন্য খুব জরুরি। নয়তো বাংলা ভাষাটা খুব ভাল জায়গায় দাঁড়াবে না।

প্রশ্ন: আজকাল তো চিত্রনাট্যে বড্ড বেশি ইংরেজি শব্দের ব্যবহার দেখা যায়

তা: যাঁরা নিজেরা ভুল জানেন ভুল উচ্চারণ করেন, কিছু পরিচালক তাঁদেরকেই ‘মাস’ বলে মনে করেন। আমি এটাও নিশ্চিত এগুলো কেউ জেনেবুঝে খুব যে করেন তা নয়। আজকাল অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সময়ের তাড়া থেকেই এই মনে হওয়া। তবে কিছু ক্ষেত্রে যুগের দাবি মেনেও সংলাপ লিখতে হয়। যেহেতু টেলিভিশন মানুষের ঘরে ঘরে আছে তাই ঠিক বানান, ঠিক উচ্চারণ, ঠিক ভাষা এগুলোকে পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ ছিল। যাঁদের জীবনে একটু আলো কম তাঁদের জীবনটাকে সুন্দর করার কথা বার বার মনে হয়। সকলেই তো মানুষ। এই পৃথিবীতেই রইল নিজের ভাষা শিখল না, অথচ মানুষ হিসেবে জন্মাল। এটা খুব ভাবায় আমাকে। আমরা শাড়ি, গয়না,খ্যাতি এসব কিছুর পিছনে ছুটছি। তাও আমার মনে হয় যখন মানুষ হয়ে জন্মেছি, বাক্‌শুদ্ধির প্রয়োজন।

প্রশ্ন: নতুন প্রজন্মের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কথাবার্তায় কতটা বদল দেখতে পান?

তা: অশ্লীল শব্দপ্রয়োগ যেন জলভাত হয়ে গিয়েছে। এটাকে যাঁরা ফ্যাশন বলেন সেটাকে অশিক্ষা নয়, কুশিক্ষা বলে। সেটের অন্দরে চলাফেরার মধ্যে এ সব ভাষায় কথা বার্তা চলছে। অনেক শিশুশিল্পীও তো কাজ করে। তারা তো আমাদের মতো সাজঘরে বসে থাকে না। তারা কী শুনছে! যারা বলছে তারা অবলীলায় বলে যাচ্ছে। স্থান-কাল-পাত্র জ্ঞান নেই। আমার সামনে কিন্তু কেউ বলবে না সেটা জানি। তবে এই ধরনের কথা বলার তো একটা পরিবেশ আছে। আজকাল আর আগল নেই।

প্রশ্ন: বর্তমান প্রজন্মের নায়িকাদের সাজসজ্জা কেমন লাগে?

তা: আজকাল নায়িকাদের ফ্যাশনই চোখে পড়ে, স্টাইল নেই। দুটো আলাদা জিনিস। স্টাইলে নিজস্বতা থাকে। যখন যে ধারা উঠছে সকলে মিলে সেটাই অনুকরণ করছে। আমাকে কোনও দিনও ভাড়া করা পোশাক পড়তে হয়নি। কিন্তু এখন সমাজমাধ্যমে উপস্থিতি জানান দিতে বড্ড চাপে থাকতে হয় নায়িকাদের।

প্রশ্ন:আপনাকে নিয়ে কোনও সহশিল্পী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছেন?

তা: আমারা যখন আমাদের সিনিয়রদের সঙ্গে কাজ করতাম এত দারুণ পরিবেশ ছিল। আসলে আমরা ভিতু ছিলাম। গীতামা, ছন্দাদি, বাসন্তীদি এঁদের কাছে খুব সহজ আমি, এতটাই স্নেহ পেয়েছি। আবার অনুরাধাদি, শকুন্তলাদি এঁদের সঙ্গে কাজ করেছি যখন, এঁদের সামনে কখনও পোশাক বদলাতে পারিনি। এটাই আমার শিক্ষা। আমরা সিনিয়র হয়েছি। এখন আমাদের সঙ্গে যারা কাজ করতে এসেছে ওদের সেই ভীতি কাটিয়ে দিয়েছি। এখনকার ছেলেমেয়েরা তো অন্য ভাবে বড় হয়েছে। আমার জন্য কেউ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেনি, কিন্তু অনেককে আমায় ভয় পেতে দেখেছি। অনেকেই আবার আমার কাছে শিখতে চায়। কখনও আবার লজ্জাশরম ছেড়ে বলতে হয়, ও ভাবে বলিস না, সংলাপটা এ ভাবে বল।

প্রশ্ন: এখনকার দিনে সমাজমাধ্যমে উপস্থিতিটা কিন্তু খুব প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে, সেখানে দাঁড়িয়ে আপনি বেশ আড়ালেই থাকেন।

তা: আমি প্রচারবিমুখ। সেটা ভাল বিষয় তেমন নয়। বাবা-মা ছোটবেলা থেকে মাথায় ঢুকিয়ে দেন তুমি ভাল কী মন্দ, সেটা লোকে বলবে। আমি কোনও কিছুই বাইরে থেকে করতে পারি না।গভীরতায় না গিয়ে কাজ করা সম্ভব নয়, সে অভিনয় হোক বা সংসার। মনে আছে আমার, বুম্বাদার সঙ্গে ফোরামের কাজ করতাম। যখন যেতাম দেখা হলে খুব যত্ন করতেন। কিন্তু এখন নিজে থেকে গিয়ে কিছু বলতে বাধোবাধো লাগবে। মনে হয়, উনি তো খুব ব্যস্ত। বিট্টু (সোহম চক্রবর্তী) যখন ভারতলক্ষ্মীতেই শুটিং করছিল ওকে মেসেজ করে জিজ্ঞেস করি আমি দেখা করতে আসব কি না! সরাসরি যাইনি।আমি আগ বাড়িয়ে কিছু করতে পারি না। আসলে এখন মানুষের জীবনে অনেক রকমের ঝামেলা আছে। খুব ফাঁকা মাথা নিয়ে আজকাল খুব কম মানুষ আছেন। একই সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, পরান বন্দ্যোপাধ্যায় এঁদের সামনে কখনও সঙ্কোচ হয়নি। সৌমিত্রদাও তারকা আর বুম্বাদাও তারকা। কিন্তু দুটো সময়ের অনেকটা ফারাক।

প্রশ্ন: ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর সঙ্গে একই রকমের সঙ্কোচবোধ করেন?

তা: ঋতুর সঙ্গে দুটো ছবিতে কাজ করেছি। তাতেই এত বার ওর এত ছবির প্রিমিয়ারে ডেকেছে। আমি কৃতজ্ঞ তার জন্য। কিন্তু আমি যাইনি। মনে হয় প্রিমিয়ারে গিয়ে তো সবাই ভাল বলে। আমি যখন একা সিনেমাটা দেখতে যাই সম্পূর্ণ ভাবে সেটাতে ডুবে যাই।

প্রশ্ন: আপনার চারপাশে যে অদৃশ্য আড়াল রয়েছে তার জন্য কি লোক কখনও নাকউঁচু ভাবেনি?

তা: বহু বার লোকে ভেবেছে। নাকউঁচু অনেকে ভেবেছেন। অল্প বয়সে এসব নিয়ে কষ্ট পেতাম। লোকে ভাবেন যে আমি খুব ব্যস্ত। সেটা নয় কিন্তু। যদিও আগে অনেক কাজ ছিল। এখন কিছুটা কাজের পরিমাণ কমেছে।

প্রশ্ন: এত দিনের কেরিয়ার, ম্যানেজার নেই?

রীতা: ধুস্‌ নাহ্ নাহ্।

প্রশ্ন: এখন তো সকলেই ম্যানেজার রাখেন?

তা: এখনকার এই ব্যাপারগুলো কানে আসে, শুনি। আমরা যা রোজগার করেছি তাতেই ভাবতেই পারি না ম্যানেজারকে মাইনে দিয়ে রাখা যায়। যাঁরা মাচা করেননি তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমি কখনই মাচা করিনি, কারণ রাতে আমি দূর-দূরান্তে যাব এটা আমার স্বামী-সন্তানের পছন্দ নয়। তাতে তাঁদের শান্তি বিঘ্নিত হবে। কারণ, রাতে হাইওয়ে দিয়ে যাতায়াতে বিপদ-আপদের ভয় থাকে। আর মাচা অনুষ্ঠানে গিয়ে যে ধরনের বিনোদন দিতে হয় সেই ধরনের নাচ-গানে আমি পটু নই। আমি কবিতা বলতে পারি, আবৃত্তি করতে পারি। মাচা ছাড়া জনসংযোগ আধিকারিক কিংবা, সহকারী এত কিছু রাখা সম্ভব নয়। আর আমি তেমন ব্যস্ত শিল্পীও নই। একটা-দুটো ধারাবাহিক করি, সিনেমাতে তো কেউ ডাকে না! কী দরকার তা হলে।

প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রির অন্দরে সুঅভিনেত্রী বলে পরিচিতি থাকার পরও ডাক পাচ্ছেন না!

তা: জানি না কেন পাই না। আমারও এটা প্রশ্ন কেন পাই না। বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, তরুণ মজুমদার যে ধরনের পাঠ দিয়েছেন সে রকম তো কেউ দেয়নি। সিনেমা আমাকে খুব টানে। আসলে ধারাবাহিকে তো চরিত্র নিয়ে ভাবার সময়ও থাকে না।

প্রশ্ন: ধারাবাহিকে অভিনয় কী শুধুই টিকে থাকার জন্য?

তা: যারা অভিনয়টা পেশা হিসেবে নিয়েছে, ঘন ঘন সিনেমায় সুযোগ না পেলে জীবন চলবে কি করে? ধারাবাহিক ছাড়া? এখান থেকেই তো অর্থনৈতিক নিশ্চিন্তি। ধারাবাহিকে কাজ যেন অফিসে কাজ করার মত হয়ে গিয়েছে। ধারাবাহিকে লুক সেট হল, কোন চরিত্রে অভিনয় করছি এতটুকুই জানানো হয়। এ বার যখন শুরু হল কোথায় গিয়ে তার শেষ কেউ জানে না, আন্দাজও করতে পারবে না। সবটাই টিআরপি কেন্দ্রিক।এত দিন কাজ করার সুবাদে ধারাবাহিকের কাজটা জলভাত হয়ে গিয়েছে।

প্রশ্ন: ‘এক আকাশের নীচে’ ধারাবাহিকের সেটের দিন গুলো মনে পড়ে?

তা: হ্যাঁ হাসিদি (সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়) আমার খুব প্রিয় ছিলেন। আমি ধারাবাহিকে আম্মা বলতাম। আমার ছেলে টিভিতে দেখে সেও আম্মা বলত। তখন একটা ধারাবাহিক পাঁচ-সাত বছর চলত, সকলের সঙ্গে আত্মীয়তা ছিল। এখনকার মতো তিন মাস, ছয় মাসের পরে বন্ধ হয়ে যেত না। আমার আর আম্মার সম্পর্ক নিয়ে আরও একটু বলি?

প্রশ্ন: হ্যাঁ বলুন।

তা: হাসিদি (সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়) সিনের মাঝেখানে ইম্প্রোভাইস করতেন। এমন এমন সংলাপ বলতেন, অন্য অভিনেতা হলে আপত্তি করতেন। আমিও তেমন ঠিক বুঝে গিয়ে ক্যামেরার সামনে সংলাপ বলে দিতাম। রবি ওঝা আমাকে ‘ম্যানেজ মাস্টার’ নাম দিয়েছিল। একটা দৃশ্যে ওঁর বুকে পড়েছি, উনি আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন। দেখছি বুকের মধ্যে সর্দি ঘড়ঘড় করছে। শট শেষ হতে প্রশ্ন করতেই বললেন, ‘‘স্নান সেরে ভিজে কাপড়টা পরেই চলে এসেছি। গায়ে শুকিয়েছে তো, তাই।’’ শুনে খুব বকেছিলাম। এখন আর এমন হয় না সত্যিটা মানুষ শুনতে চায় না।

প্রশ্ন: শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের এখন যে জায়গায় কেমন লাগে?

তা: ভীষণ খুশি। অপু অভিনেতা হিসেব তো খুব ভাল। ওর সাফল্য আমাকে তৃপ্তি দেয়। কখনও ফোন করে বলা হয়নি। আগে অপু ফোন ব্যবহার করত না তো। এখন মহুয়ার পাল্লায় পড়ে অনেকগুলো কাজ গোছাতে পারছে। খুব ভাল লাগে দেখে।

প্রশ্ন: আপনি যে ধারাবাহিকগুলিতে কাজ করেছেন সেগুলিকে ‘কাল্ট’ বলা যায়, এখনকার ধারাবাহিককে কী বলবেন?

তা: আমার খুব কষ্ট হয়। এখন ধারাবাহিকের নামে লোকে নাক সিঁটকায়। যাঁরা সিনেমা করেন তাঁরা, যাঁরা ধারাবাহিকে থেকে গিয়েছেন তাঁরাও। আবার যাঁরা সিনেমায় কাজ না পেয়ে ধারাবাহিকে ফিরে আসেন তাঁদেরও একই ভাব। মাধ্যমটাকে এতটা হেয় করা উচিত নয়। ধারাবাহিকে অনেকগুলো কঠিন কাজ কিন্তু একসঙ্গে করতে হয়। আমি যখন কাজ করতে এসেছিলাম তাঁরা হয়তো চতুর্থ সহকারী ছিলেন তাঁরাই এখন পরিচালক হয়ে গিয়েছেন। তাই তাঁদের সঙ্গে স্নেহের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছে।ধারাহিকে বহু ছেলেমেয়ে কিন্তু খুব মনোযোগী নিজের কাজের প্রতি। একটু যদি সঠিক শিক্ষক পেত, যার যা কমতি আছে ঠিক হয়ে যেত। আমার ‘কার কাছে কই মনের কথা’ ধারাবাহিকের অভিনেত্রী মানালি যেমন নিজে স্বীকার করে কোন জায়গাটা ওর কমতি আছে। আমি শুধরে দিই। ওর মধ্যে জানার আগ্রহ আছে। আসলে এখনকার দিনে বাচ্চাগুলো এত ছোট বয়স থেকে কাজ শুরু করে, ফলত পড়াশোনায় একটু ঘাটতি থেকে যায়। আর পড়াশোনা একটা দর্শন তৈরি করে।

প্রশ্ন: লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে বহু কাজ করেছেন

তা: হ্যাঁ, লীনাদির লেখা খুব ভাল। আসলে ওঁর লেখা ভীষণ রকম সাহিত্যনির্ভর। মেগাসিরিয়ালের দুভার্গ্য, আমার মনে হয় আমরা কতগুলো ফ্যাক্টরি চালাই, দৈনন্দিন উৎপাদনের মালের জোগান দিই। যার ফলে এই মাধ্যমে বিশাল একটা শৈল্পিক কাজ করা হয়ে ওঠে না। যেগুলি ভাল কাজ হয়েছে সেটা এই মাধ্যমে টেকেনি।

প্রশ্ন: আজকাল শুটিংয়ের ফাঁকে রিল্‌স তৈরি হয়।

তা: আমি এ সব করি না। আমি মেকআপ নেওয়ার পর আর ফ্লোর ছাড়ি না। টানা ১০ ঘণ্টা শুটিং করি। আমি গিয়ে সাজঘরে আড্ডা মারব তার পর পরিচালক লোক পাঠাবে ডাকার জন্য, তার পর এসে আমি চুল ঠিক করব, শাড়ি ঠিক করব, সেটে যেতে যেতে গল্প করব! এতে অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে যায়। এসব আমি করি না। আমি কাজটার প্রতি কখনও অসৎ থাকিনি। আমি এতটুকুই করতে চাই। আমি আমার ফ্লোরে সম্মানের সঙ্গে কাজ করতে চাই। সেই জন্য বহু প্রিয় মানুষের সঙ্গে কাজ করিনি। যেখানে অসম্মানিত হওয়ার সুযোগ থাকে। আমি একবারও বলব না টিভি সিরিয়াল খারাপ। সিনেমায় সময় আছে, ধারাবাহিকে নেই।

প্রশ্ন: কখনও বাদ পড়েছেন কোন ছবি থেকে?

তা: একবার একজন বড় পরিচালকের ছবি করি। প্রায় ১৬ দিন বাইরে শুটিং। তখন আমার ছেলে ছোট, তাকে ফেলেই গেলাম। ছবিটা যখন দেখলাম আমার প্রায় কোনও দৃশ্য নেই। আমি কিন্তু ছবিটা করার আগে পরিচালককে বলেছিলাম, আমি তো দেখতে সুন্দর নই আমি কোন কাজে লাগব! কারণ বাংলা ছবি বাণিজ্যিক ছবি। তখন খুব অভিমান হয় মনে মনে। সেই রাগ গিয়ে পড়ে তরুণ মজুমদারের উপর।

প্রশ্ন: কেন?

তা: পূর্ব অভিজ্ঞতাটা মনে আঘাত দেয়। যখন ‘আলো’র জন্য ডাকেন, বলেছিলাম, ‘কেন ডাকছেন দাদা, আমাদের দিয়ে শুট করিয়ে অর্ধেক তো ফেলে দেবেন।’ উনি বসতে বলেন। আমি বসিনি। বয়স্ক অভিজ্ঞ মানুষ তো, বুঝতে পেরে বললেন, ‘‘ আপনি খুব আঘাত পেয়েছেন কোনও ঘটনায়।’’ উনি আশ্বস্ত করেন যতটা প্রয়োজন ততটাই শুট করবেন। প্রথমে অন্য একটা চরিত্র করার কথা ছিল। তার পর খল একটা চরিত্র দিলেন। কিন্তু কথা দিয়েছিলাম চরিত্র যা-ই হোক করব। আমার কাছে তনুবাবু কবি। কারণ কবিরা ক্রান্তদর্শী হন, মানুষের মন পড়তে পারেন। আমি যে কোনও পরিচালকের বাধ্য হয়ে কাজ করতে পারি। কারণ প্রত্যেকেরই তো রকম আলাদা। প্রতি বার আমাকে কিন্তু সেটার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়েছে। সেটাই আমাদের থিয়েটারের শিক্ষা।

প্রশ্ন: ব্রাত্য বসুর নির্দেশনায় কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন?

তা: ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’ নাটকটা করি। প্রথম দিনই মঞ্চে মেকআপ, প্রপ্‌স, লাইট সবসমেত মহড়া। প্রথম দিনই মিউজ়িক সব প্রস্তুত। এই ধরনের পদ্ধতিতে অভ্যস্ত ছিলাম না। প্রথম দিনই ভেবেছিলাম জমছে না, পালিয়ে যাব। কিন্তু একটা দিন দেওয়ার পর পরের ছয় দিন মহড়া দিলাম, তখন এত আত্মবিশ্বাসী লাগছিল! দারুণ একটা অভিজ্ঞতা।

প্রশ্ন: সামনেই তো নির্বাচন...

তা: থামিয়ে…. কোনও মন্তব্য করব না।

প্রশ্ন: কিন্তু সিরিয়ালপাড়ার তো বহু অভিনেতা-অভিনেত্রী বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন?

তা: যার যে ভাবে চলতে ভাল লাগে, চলছে। প্রত্যেকের লক্ষ্য তো আলাদা।

প্রশ্ন: কোন তারকা সংসদ বা বিধায়কে আপনার পছন্দ?

তা: সম্প্রতি আমি সায়নী ঘোষের সংসদে একটা ভাষণ শুনছিলাম। ও কী বলছে তাতে আমার কান গেল না। কিন্তু ও আমাকে কিনে নিল ওর ভাষার প্রতি দখল দেখিয়ে। হিন্দি, বাংলা, ইংরেজি, তিনটে ভাষায় একজন সাংসদ কথা বলছে। এত স্বাচ্ছন্দ্য, এত দাপট দেখছি, ওর কথা আমাকে প্রভাবিত করেছে। দেখা হলে খুব আদর করে দেব।

প্রশ্ন: আক্ষেপ রয়েছে কোনও?

তা: পৃথিবীতে সবচেয়ে দামি হচ্ছে জ্ঞান। বাদল সরকারের কাছে কী শিখেছি মনে পড়ে। বা তৃপ্তিদির কাছে কী শিখেছি সে সব মনে পড়ে। কত ভাষা শেখা হল না, গান গাইতে পারতাম খুব ভাল, সেটা করতে দেওয়া হয়নি। নাচটা হল না। শিল্পের বিভিন্ন যে বিদ্যা শেখা হল না, সেই আক্ষেপ রয়ে গেল!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement