নতুন পথে হাঁটছে কি বাংলা সিরিয়াল?

কতটা পালাবদল ঘটেছে ছোট পর্দার নায়িকাদের চরিত্রায়নে? মূল সুরও কি পাল্টেছে? খোঁজ নিল আনন্দ প্লাসকতটা পালাবদল ঘটেছে ছোট পর্দার নায়িকাদের চরিত্রায়নে? মূল সুরও কি পাল্টেছে?

Advertisement

মধুমন্তী পৈত চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৯ ০০:১০
Share:

পরিবর্তন এনেছে রাসমণি

বাঙালির সান্ধ্যবিনোদনের নিত্যসঙ্গী ডেলিসোপ। এক দিন জয়ী, কৃষ্ণকলি, মহুলদের টেলিভিশনের পর্দায় না দেখতে পেলে মন কেমন করে ওঠে দর্শকের। তবে ৩৬৫ দিন বিনোদন জোগাতে গিয়ে অনেক সময়েই ধারাবাহিকের গল্প জড়িয়েছে একাধিক সম্পর্ক, বিয়ে, বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক, অবৈধ সন্তানের পাকচক্রে। যার জেরে প্রশ্ন উঠেছে ধারাবাহিকের গুণগত মান নিয়ে। তবে গত কয়েক বছরে যে ধারাবাহিকগুলি টিআরপি রেটিংয়ে শীর্ষ স্থানে ছিল, তাদের গল্পে যেন একটা বদলের বাতাস। হয়তো সেই সংখ্যা বেশি নয়। আসলে ব্যতিক্রমের সংখ্যা তো চিরকালই কম। যেমন ধরুন, বছর কয়েক আগে ‘আমার দুর্গা’ ধারাবাহিকের সাংসারিক গল্পের মধ্যেও ছিল রাজনীতির চোরা স্রোত। শ্বশুর ও বৌমা লড়েছে রাজনীতির ময়দানে। আবার ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ধারাবাহিকে মূল চরিত্রের ব্যাডমিন্টন খেলা, ব্যাডমিন্টন অ্যাকাডেমির রাজনীতি ছিল ধারাবাহিকের অনেকটা অংশ জুড়ে। এখনকার ‘জয়ী’তে আবার সমান্তরালে চলছে দুটো গল্পের বিন্যাস। এক দিকে রয়েছে শ্বশুরবাড়ির কূটকচালি, অন্য দিকে ফুটবলের ময়দান। ‘কৃষ্ণকলি’তে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও কিন্তু রয়েছে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের মিষ্টি সুর।

Advertisement

উল্লেখ্য, ইদানী‌ং বেশ কিছু ধারাবাহিকেই সাংসারিক অশান্তি বা সম্পর্কের জটিলতা থাকলেও একাধিক বিয়ে বা অবৈধ সম্পর্কের পুরনো প্লট থেকে সরে এসেছে। সময়ের সঙ্গে বদল অবশ্যম্ভাবী। আর তাই কি দর্শকের চাহিদাতেই বদলাচ্ছে ধারাবাহিকের গতিপথ? খতিয়ে দেখা যাক...

Advertisement

একাধিক থেকে একটি...

‘রাশি’, ‘রাধা’, ‘ভালবাসা ডট কম’ এমন অনেক ধারাবাহিকই ভারাক্রান্ত হয়েছিল একাধিক সম্পর্ক ও বিয়ের ভারে। চিত্রনাট্যকার লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের বেশ কয়েকটি ধারাবাহিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, একাধিক সম্পর্ক দেখানোর। ‘ইষ্টিকুটুম’, ‘জলনুপূর’, ‘পুণ্যিপুকুর’ সেই ঘরানার। এ ব্যাপারে লীনার যুক্তি, ‘‘ব্যক্তিজীবনেও তো এমন হয়। জীবনের বাইরে থেকে উপাদান আমি নিই না।’’ ‘ইষ্টিকুটুম’-এ শঙ্কর চক্রবর্তী অভিনীত চরিত্রটির বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের সন্তান ছিল বাহা (ধারাবাহিকের মূল চরিত্র)। এ ক্ষেত্রে লীনার মতে, ‘‘ওটা গান্ধর্ব মতে বিয়ে। আপনি মানলে মানবেন, নয়তো মানবেন না!’’ যদিও লীনার ‘অন্দরমহল’ ধারাবাহিকেই সম্পর্কের সমীকরণগুলো অনেক বেশি বাস্তব। পছন্দের মানুষের সঙ্গে পরমেশ্বরীর বিয়ের পরে যোগাযোগ থাকলেও পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল শ্রদ্ধার। ‘ফাগুন বউ’ ধারাবাহিকেও এখনও অবধি সম্পর্কগুলো সরল পথেই চলছে।

রাসমণি ফ্যাক্টর

বাঁধাগত থেকে বেরিয়ে এসে ‘করুণাময়ী রাণী রাসমণি’ সিরিয়াল দুনিয়ায় অবশ্যই ট্রেন্ডসেটার। পাওয়া তো গেল নতুন ফর্মুলা। অতএব পরপর তৈরি হতে থাকে আরও কিছু ধারাবাহিক ।যেমন, ‘আমি সিরাজের বেগম’, ‘দেবী চৌধুরাণী’, ‘জয় বাবা লোকনাথ’ ইত্যাদি। যদিও রাসমণিকে দেখে অন্য চ্যানেলগুলি যে কনটেন্ট তৈরি করছে, টিআরপি-র নিরিখে তা অতটা জনপ্রিয় হয়নি। এ প্রসঙ্গে চিত্রনাট্যকার সাহানার মত, ‘‘রাসমণির উপরে ধারাবাহিক আগেও হিট ছিল, আজও হিট। দশ বছর পরে করলেও হিট হবে। কারণ রাসমণি, সাধক বামাক্ষ্যাপা এই চরিত্রগুলিকে বাঙালি দর্শক দেখতে পছন্দ করেন।’’ নস্ট্যালজিয়ার প্রতি বাঙালির অদম্য আকর্ষণ তো নতুন কথা নয়। সেটাকেই কাজে লাগিয়ে যদি সিরিয়ালের গল্পে স্বাদবদল হয়, তাতে ক্ষতি কি? এ সবের পাশাপাশি প্রতিটি বাংলা চ্যানেলেই এখন একটি বা একাধিক ফ্যান্টাসিধর্মী সিরিয়াল চলছে। এই সিরিয়ালগুলির উত্থানও কি দর্শকের স্বাদবদলের ইঙ্গিতবাহক নয়? এ প্রসঙ্গে প্রথমেই আসে ‘কিরণমালা’র কথা। সিরিয়ালটি হিট হওয়ার পর থেকেই এই জঁরের দিকে ঝুঁকলেন অনেক পরিচালক। তবে ‘কিরণমালা’ শুধুই ফ্যান্টাসি নির্ভর শো নয়, এর মধ্যেও আছে লড়াকু মেয়ের গল্পও। তবে কিরণমালাকে দর্শক পছন্দ করলেও বাকি সিরিয়াল কিন্তু টিআরপি-র দাক্ষিণ্য পায়নি।

নায়িকাদের পেশা

ছোট পর্দার বেশির ভাগ জনপ্রিয় মুখ্য চরিত্রের পেশাগত পরিচিতি দেখালেও গল্প আবর্তিত হয় তাদের ব্যক্তিজীবন ঘিরেই। সেখানে নায়িকা ফুটবল খেলুক বা হকি, গায়িকা হোক বা অফিসে কর্মরতা, পেশার খুঁটিনাটি গোড়ার দিকে থাকলেও সিরিয়াল যত এগোয়, ক্রমশ তা দাঁড়ায় সাংসারিক গল্পের চর্বিতচর্বণে। নায়িকার পেশার খুঁটিনাটি দেখালে কি দর্শক তা দেখবেন না? লীনার স্পষ্ট উত্তর, ‘‘চ্যানেলকে টিআরপির দিকটাও মাথায় রাখতে হয়। চাকরি জীবনে তো দেখানোর মতো অত নাটকীয় উপাদান নেই।’’

অন্য দিকে সাহানার মতে, ‘‘আমি ‘গোয়েন্দা গিন্নি’ বা ‘জয় কালী কলকাত্তাওয়ালী’র মতো শো লিখেছি, যেগুলো টিআরপিও দিয়েছে। তাই মহিলাদের পেশা দেখানো হয় না, সেটা তো আমি বলব না।’’ ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘জয়ী’র পরিচালক সুশান্ত দাস বললেন, ‘‘নায়িকা ফুটবলার, ডাক্তার যা-ই হোক, দিনের শেষে মেয়েটিকে সংসার করে সকলকে খুশি রাখতে হবে। এর বাইরে অন্য কিছু দেখালে ছোট পর্দার দর্শক দেখবেন না।’’ টিআরপির প্রসঙ্গ আসছে সেখানেও।

হ্যাঁ, এটা ঠিক সিরিয়ালের নায়িকারা আজও ‘আদর্শ নারী’র সংজ্ঞা। সংসারই তাদের ধ্যান-জ্ঞান। পুরুষশাসিত সমাজের দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে তোলা সে ছবিতে এত সহজে কি ভাঙন ধরে? কিন্তু এটাও বলতে হবে, ডেলিসোপের একাধিক বিয়ে আর অবৈধ সম্পর্কের বদ্ধ ভাবনার ঘরে একটা হলেও ঘুলঘুলি খুলেছে, যেখান দিয়ে হালকা ভাবে ঢুকছে অল্প পরিবর্তন। দেখা যাক সে ঘুলঘুলি ধীরে ধীরে জানালা হয়ে উঠতে পারে কি না!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন