মহড়া: কয়েদিদের মহড়া চলছে কৃষ্ণনগরের রবীন্দ্র ভবনে। নিজস্ব চিত্র
কান্নাটা কিছুতেই আসছে না কারও। মাথা খাটিয়ে পরামর্শ দিলেন নির্দেশক, “এত দিন তো নিজের জন্য কেঁদেছেন, এ বার দেখুন তো অন্যের জন্য কাঁদতে পারেন কি না?”
জেলা সংশোধনাগারের পাঠকক্ষে তখন পিন পড়ার নিস্তব্ধতা। সকলেই চেষ্টা করছেন কাঁদার। হঠাৎ হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন বছর পঁচাত্তরের মানুষটা। একমুখ ধবধবে সাদা দাঁড়ি। মাথা ভর্তি চুলেও পাক ধরেছে। এটা ছাড়া আলাদা করে তাকে চোখে পড়ার কথা নয়। পড়েওনি কারও। মানুষটা কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরলেন নির্দেশক সুশান্ত হালদারকে, “পেরেছি মাস্টার। আজ আমি অন্যের জন্য কাঁদতে পেরেছি।”
বিচারাধীন মানুষটাকে আরও কাছে টেনে নিয়ে ধীর গলায় বললেন সুশান্তবাবু, “এর পর আর কোনও আদালতের সাধ্যি নেই আপনাকে শাস্তি দেওয়ার।” তিনি মহেন্দ্রনাথন দাস্য। অভিনয় করছেন বিবেকানন্দের কাকা তারক দত্তের চরিত্রে।
গত ক’মাস ধরে এমনই সব ঘটনার সাক্ষী থাকছে কৃষ্ণনগর জেলা সংশোধনাগারের আবাসিকদের মহড়াক্ষেত্র। কখনও দাগী অপরাধীর গলায় শিশুর সারল্য তো কখনও ফুটে উঠছে আত্মবিশ্বাস। অপরাধী চোখের স্নিগ্ধ দৃষ্টি দেখে চমকে উঠছেন নির্দেশক থেকে শুরু করে সংশোধনাগারের পোড় খাওয়া কর্তা-ব্যক্তিরা। তাই তো ভিড়ের এক কোণে বসে থাকা জাকির হোসেনের চোখের দিকে তাকিয়ে মুহুর্তে সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন নির্দেশক, ‘এ নাটকে আপনিই হবেন রামকৃষ্ণ’।
শনিবার বিকেলে কৃষ্ণনগরের রবীন্দ্র ভবনে মঞ্চস্থ হতে চলেছে নাটক ‘মহাবৃত্তে।’ বিবেকানন্দের জীবনী অবলম্বনে এই নাটকের কলাকুশলীরা সকলেই সংশোধনাগারের আবাসিক। চার জন সাজাপ্রাপ্ত। বাকিরা বিচারাধীন। কেউ খুনের আসামী তো কেউ বধূ নির্যাতনের অপরাধে জেলে। আবার কেউ শিশু নিগ্রহে অভিযুক্ত, কেউ মাদক পাচারে। কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে আজ তারা এক-এক জন অভিনেতা হয়ে উঠেছে। দিনভর অনুশীলনের পরে রাতে ঘুমে মধ্যে তারা স্বপ্ন দেখছেন, মঞ্চের আলো, মাইক, সামনে কালো মাথার সারি। তাদের সংলাপের মাঝে মাঝে ঝলসে উঠছে ক্যামেরার আলো। মানুষের হাততালি। ‘‘ওদের তর যে আর সয় না’’, বলছেন জেলের এক কর্তা।
গোটা ব্যাপারটা যে খুব সহজে সম্ভব হয়েছে, তা নয়। কেউ কোনও দিন অভিনয়ই করেননি, মঞ্চে ওঠা তো দূরস্থান। আনকোরা মানুষগুলোকে নিয়ে প্রায় ন’মাস আগে মহড়া শুরু করেন ‘কৃষ্ণনগর সিঞ্চন’-এর নির্দেশক সুশান্তবাবু। অভিনয় সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা থাকা তো দূরের কথা, সকলের ভাষাতেই মারাত্মক আঞ্চলিক টান। সেই ভাষাকে মেজে-ঘষে তাদের ভিতরে আত্মবিশ্বাস আনতেই লেগে গিয়েছে মাসখানেক। সুশান্তবাবু বলেন, “তবু আমি হতাশ হইনি কোনও দিন। কারণ আমি জানতাম, এটা শুধু নাটক নয়। একটা মানুষকে ভিতর থেকে পাল্টে দেওয়ার সুযোগ।” না হলে কেনই বা ভিড়ের পিছন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে খুন-ডাকাতির ঘটনায় অভিযুক্ত বলে উঠবে, “মাস্টার, এই চরিত্রটা তুমি আমাকেই দাও।”
মাস তিনেক আগে সংশোধনাগারের মুক্ত মঞ্চে অভিনীত হয়েছিল মহাবৃত্তে। সেটা দেখে কর্তারা খুশি হয়েই সিন্ধান্ত নেন, যে এই অভিনয় বাইরের মানুষকেও দেখার সুযোগ করে দেওয়া হবে। তার পর থেকে প্রস্তুতি তুঙ্গে। আজ, শনিবার সেই মাহেন্দ্র ক্ষণ। দর্শকাসনে হাজির থাকবে স্ত্রী-ছেলে-মেয়েরাও। চেনা মুখগুলো অচেনা ভূমিকায় স্বজনকে দেখে কী বলবে, তা নিয়ে উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছেন অভিনেতারা।