ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।
সে দিন সন্ধে সাতটা থেকে তাজ বেঙ্গল-এ পতৌদি মেমরিয়াল লেকচার।
‘দাদাগিরি’র শ্যুটিং শেষ হতেই পৌনে সাতটা। এপিসোড শেষ করে সৌরভ ছুটলেন তাঁর গাড়ির দিকে। পাশে বসে চালককে বললেন, “চালাও... চালাও... জোরে চালাও... উফফ্ এত দেরি হয়ে গেল না।”
পুরো রাস্তায় তাঁকে গাড়িতে দেখতে পেয়ে সেই চেনা ‘গাঙ্গুলি গাঙ্গুলি’ আর্তনাদ আজও। অবসরের ছ’বছর পরেও। তারাতলার মোড়ের অটোচালক থেকে আলিপুরে পুলিশ, পথে তাঁকে দেখে হাত নাড়ছে সবাই।
এর মধ্যেই, কাচের বাটিতে মুড়ি খেতে খেতে লাল মার্সেডিজেই শুরু হল আড্ডা..
দেরি হয়ে গেল না আজকে শ্যুটিংয়ে...
হ্যাঁ। আমি ভেবেছিলাম সাড়ে ছ’টার মধ্যে হয়ে যাবে আজকে। কোনও মানে হয়, সাতটা থেকে ভিভিএস (লক্ষ্মণ) স্পিচ দেবে আর এখনই পৌনে সাতটা! ছাড়ুন... ভেবে লাভ নেই....বলুন.....
দাদাগিরি ব্যাক। আজকে দশটা থেকে আবার সেই চেনা সিগনেচার টিউন... বাঙালির ডিনারটাইমের সঙ্গী আপনি...
হ্যাঁ, দেখতে দেখতে চারটে সিজন কেটে গেল...
এই সিজনে নতুন কী?
ফর্ম্যাটটা একটু চেঞ্জ হয়েছে, সিলেকশন রাউন্ডটা আরও বেটার করা হয়েছে যাতে সবাই আরও বেশি করে অপরচুনিটি পায়। আমি নিজেও কয়েকটা বদল এনেছি অ্যাঙ্কারিংয়ে।
এ সব আপনি ভাবেন কখন বলুন তো? কমেন্ট্রি করতে করতে?
(হেসে) করতে হয়, করতে হয়। সময় বার করতে হয়...
তা এই সিজনে ‘দাদাগিরি’তে কি আটলেটিকোর ফিকরু আর গার্সিয়াকে দেখা যাবে?
কিন্তু ওরা বাংলা জানে না তো.... (হাসি)
একটা ব্যাপার বলুন, একদিন এমসিজিতে পিচ রিপোর্ট করছেন, তার পরের দিন পার্পল মুভিটাউনে ‘দাদাগিরি’র সেটে বারুইপুরের রত্নাবৌদির সঙ্গে কথা বলছেন.... ফাস্ট বোলিং থেকে এই লেগস্পিন সামলান কী ভাবে?
শ্যুটিংয়ের ফাঁকে দাদা।
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।
হাহাহাহাহা... সামলাই, ক্রিকেটেও সামলেছি। এখানেও। তবে সত্যি আমার এখন দিনে ছত্রিশ ঘণ্টা হলে ভাল হয়। ভীষণ ব্যস্ত হয়ে গিয়েছে জীবনটা। বড্ড বেশি কাজ করছি।
এখন অবধি চেষ্টা করে চলেছি সব দিক সামলে চলার। সামহাউ আই অ্যাম ম্যানেজিং। কিছু অ্যাডেড রেসপন্সিবিলিটিও এসে গিয়েছে....
সিএবি-র জয়েন্ট সেক্রেটারি, টিম আটেলেটিকো...
হ্যাঁ। সিএবি-র কাজ আছে, আটলেটিকো আছে। কিন্তু এ ভাবে চলতে পারে না। সময় বের করাটা নাইটমেয়ার এখন আমার কাছে....মার্চ মাসে বসব সব নিয়ে...
বসবেন কী নিয়ে?
বসব আমার শিডিউল নিয়ে। আই হ্যাভ টু টেক এ হার্ড লুক যে কোনটা করা উচিত কোনটা করা উচিত নয়। কাজগুলো প্রায়োরেটাইজ করতে হবে।
মানে ওয়ার্ল্ডকাপের পর?
হ্যাঁ, ওয়ার্ল্ডকাপের পর।
ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে একবার একটা চেয়ার দেখেছিলাম, চেয়ারের পেছনে লেখা ছিল ‘রিজার্ভড ফর দ্য ইন্ডিয়ান টেস্ট ক্যাপ্টেন।’ যে জায়গায় আপনি ছিলেন সেখান থেকে আজকের দাদাগিরির পৃথিবীর জার্নিটা কেমন লাগে আপনার?
দেখুন আমি মনে করি অপারচুনিটি সকলের কাছে আসে না। আর যদি অপরচুনিটি আসেই তা হলে ইউ শ্যুড টেক আপ দ্য অফার। সেই রিস্কটা নেওয়ার মানসিকতা আপনার থাকতেই হবে। আমি এই ভাবেই জীবনটা দেখি। ক্রিকেটটাও এই ভাবে খেলেছি। আমি অ্যাঙ্কারিংয়ের অপরচুনিটিটা নিয়েছিলাম, শো-টা মানুষের ভাল লেগেছে... হিউজ হিট। কিন্তু এগুলো হল কারণ, আই টুক মাই চান্স।
মাঝখানে শুনছিলাম ‘দাদাগিরি’ হিন্দিতে হবে। জি নাকি শো-টাকে ন্যাশনাল লেভেলে নিয়ে যেতে চাইছে...
হ্যাঁ, কথা চলছিল। ওদের প্ল্যানে ছিল ছ’মাস আমি বাংলাতে করব ছ’মাস হিন্দিতে। কিন্তু তার মানে পুরো বছরটাই এন্টারটেনমেন্টে দিয়ে দিতে হবে। যেহেতু আমার প্রথম প্যাশন স্পোর্টস, তাই এতটা সময় আমার পক্ষে দেওয়া কোনও মতেই সম্ভব নয়।
আপনার কমেন্টটর বন্ধুরা রাহুল, সুনীল গাওস্কর, সঞ্জয় মঞ্জরেকররা আপনাকে জিজ্ঞেস করে দাদাগিরির বিষয়ে?
হ্যাঁ, সব সময় করে।
কী জিজ্ঞেস করে?
জিজ্ঞেস করে শো-টা কেমন, ফরম্যাটটা কী এই জাতীয়। ওদের কাছেও ব্যাপারটা নতুন, কারণ ক্রিকেটার হয়ে একজন টিভিতে গেম শো করছে এমনটা তো এর আগে হয়নি....
যাঁদের সঙ্গে কমেন্ট্রি করেন, তাঁদের মধ্যে কাকে মনে হয় আপনার মতো এই রকম গেম শো অ্যাঙ্কারিং করতে পারবেন?
আমি ও ভাবে দেখি না। আগে তো অপরচুনিটি পেতে হবে। অপরচুনিটি না পেলে তুমি করবে কী করে? বীরেন্দ্র সহবাগ সুযোগ পেয়েছিল বলেই তো টেস্ট ওপেনার হিসেবে সুনীল গাওস্করের সঙ্গে ওর নামটাও উচ্চারিত হয়। সুযোগ না পেলে কী হত?
আমরা বড্ড বেশি এন্ড রেজাল্টটা নিয়ে ভাবি, কিন্তু জীবনটা তো ও ভাবে চলে না... এন্ড রেজাল্টটা তখনই আসবে যখন তুমি বিভিন্ন ধাপে সুযোগ পাবে।
আচ্ছা, প্রত্যেকটা সিজনের আগে আপনি কোনও অভিনেতার সঙ্গে কথা বলেন আপনার অ্যাঙ্করিং নিয়ে?
না, আমি যা করার নিজেই করি। আর কার সঙ্গে কথা বলব? হু উইল আই টক টু?
দেবের সঙ্গে বলতে পারেন, প্রসেনজিতের সঙ্গে বলতে পারেন। শাহরুখ কি আমির খানের সঙ্গেও তো বলতে পারেন...
কিন্তু ওরা কি এ রকম শো করে? করে না তো। আমি টিভিতে দেখেছি ওদের কাজ কিন্তু আমার শাহরুখ কি আমির হওয়ার কোনও ইচ্ছে নেই। আমি আমার মতো করি।
একটু ক্রিকেটের কথায় আসি। সিএবি-এর একটি অনুষ্ঠানে বিষেন সিংহ বেদী সেদিন সেই অনুষ্ঠানের সঞ্চালক গৌতম ভট্টাচার্যকে বলেছেন, লর্ডসে আপনার জামা খোলাটা ঠিক হয়নি।
তাই? কেন?
উনি মনে করেন, ‘দ্যাটস নট ক্রিকেট’।
কেন, ভুল কি ছিল তাতে? এটা আলাদা ব্যাপার যে আর কোনও দিন আমি ও রকম করব না, কিন্তু ভুলটা কী? আমি তো কারও ক্ষতি করিনি। কাউকে অ্যাবিউজ করিনি। তবে এটা যদি ওঁর মত হয়, তা হলে আমি সেটাকে রেসপেক্ট করি। উনি হয়তো জিনিসটাকে ও ভাবে দেখেন।
আচ্ছা, সচিনের অটোবায়োগ্রাফিতে চ্যাপেল নিয়ে প্রায় চার পাতা রয়েছে। আপনার বায়োগ্রাফিতে চ্যাপেল নিয়ে ক’টা পাতা, ক’টা চ্যাপ্টার থাকবে?
(হাসি) আমি এখনই আপনাকে বলতে পারব না এগজ্যাক্টলি ক’পাতা থাকবে, কিন্তু আমি খুশি যে সচিন সত্যি কথাটা লিখেছে।
অনেকের তো এটাও মনে হয়েছে, সেই সময় কেন সচিন বলেননি। ইউ ডোন্ট ফিল লেট ডাউন?
নো, আই ডোন্ট। কারণ আমার মনে হয় একজন ক্রিকেটার, যে তখনও টিমে খেলছে তার পক্ষে সব কথা বলা সম্ভব নয়।
আপনি লিখবেন না আত্মজীবনী?
হ্যাঁ, ইচ্ছে আছে। কিন্তু ওই যে বললাম, মার্চের পর ও সব নিয়ে বসব।
কলকাতায় তো আরও একটা গুজব আপনাকে নিয়ে?
কী?
আপনি নাকি রাজনীতিতে যোগ দিচ্ছেন। রাজনৈতিক গসিপ, পরের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির হয়ে মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী আপনি নয় বাবুল সুপ্রিয়?
কোথা থেকে যে খবর পায় এরা...
এটাও তো শোনা যাচ্ছে যে, আপনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে মিটিংও সেরে এসেছেন...
নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে আমি মিটিং করলে সেটা কাগজে বেরোবে না? আর ও রকম লুকিয়ে-চুরিয়ে কেউ দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে নাকি...
এটা ইন্টারভিউতে রাখতে পারি?
শিওর। (পাশে চালকের উদ্দেশে বললেন, “একটু তাড়াতাড়ি চলো। ভিভিএস-এর স্পিচ তো শেষ হয়ে যাবে”) ব্যস্ততার কথা বলছিলাম না, আজকে পতৌদি মেমোরিয়াল লেকচার, কাল ইডেন, পরশু সল্ট লেক, শনিবার আবার দাদাগিরির শ্যুটিং...
এর থেকে ক্রিকেটার জীবনটা অনেক রিল্যাক্সড ছিল বলছেন...
ক্রিকেটার হিসেবে জীবনটা আজকের থেকে ৭৫% লেস হেকটিক ছিল।
ওখানে শুধু ব্রেট লি আর শোয়েব আখতার?
হ্যাঁ, ওখানে শুধু ব্রেট লি আর শোয়েব আখতারকে সামলানো। আসলে ও ভাবে দেখতে গেলে দু’টো জীবন আলাদা। এন্টারটেনমেন্ট জগতে যখন আমি প্রথম আসি তখন দেখতাম আমি সব্বার আগে সেটে পৌঁছেছি। আর কেউ নেই, সব্বাই ধীরে সুস্থে আসছে।
আমি তো এ ভাবে কোনও দিন কাজ করিনি। অসুবিধে হত। আমার ক্রিকেটার হিসেবে যে জীবনটা ছিল তা শুরু হত সকাল ৮টায়, শেষ বিকেল সাড়ে চারটেয়। এখানে দেখতাম শেষ কখন হবে কেউ জানে না।
আরে কাজ শেষ কখন না জানলে আমি বেস্ট কাজটা করব কী ভাবে? একদিন সবাইকে ডেকে বললাম, আমি এই সময়ে আসব, আর এই সময়ে বেরোব। এর মধ্যে কাজ করতে হবে। আজ সবাই জেনে গিয়েছে আমার কাজের পদ্ধতিটা। কিন্তু তাও আজকে তো দেরি হয়ে গেল...
(ততক্ষণে হোটেলে প্রায় পৌঁছে গিয়েছে সৌরভের গাড়ি। আলিপুর চিড়িয়াখানার কাছে উল্টো রাস্তায় গাড়ি ঢোকাতেই সামনে পুলিশ দাঁড় করাল তাঁর মার্সেডিজ। কাচ নামাতেই অবশ্য একগাল হাসি হেসে ‘ওকে ওকে স্যর’ বলে সরে দাঁড়ালেন অফিসার।)
আচ্ছা, শেষ প্রশ্ন। এই সিজনে কোন সেলিব্রিটি কাপল ‘দাদাগিরি’তে এলে আপনি বেশি খুশি হবেন? অনুষ্কা-বিরাট নাকি সাক্ষী-এমএসডি?
দুই দম্পতি এলেই আমি খুশি হব। বোথ দ্য কাপল আর মোস্ট ওয়েলকাম (হাসি)।