সঞ্জয়ের লীলা ক্যামেরার মস্তানি

এ যেন চলচ্চিত্রে অমর চিত্রকথা। লিখছেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়‘ওয়েটিং ফর গোডো’ নাটকে রাগের মাথায় দুই চরিত্রের গালাগালির তরজায় সর্বোচ্চ খারাপ শব্দটা ছিল ‘ক্রিটিক’ অর্থাৎ ‘সমালোচক’! এই শব্দটা ব্যবহার করার পর প্রতিপক্ষ চরিত্রটি এর চেয়ে খারাপ শব্দ খুঁজে না পেয়ে চুপ মেরে যায়!

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:২৩
Share:

‘ওয়েটিং ফর গোডো’ নাটকে রাগের মাথায় দুই চরিত্রের গালাগালির তরজায় সর্বোচ্চ খারাপ শব্দটা ছিল ‘ক্রিটিক’ অর্থাৎ ‘সমালোচক’! এই শব্দটা ব্যবহার করার পর প্রতিপক্ষ চরিত্রটি এর চেয়ে খারাপ শব্দ খুঁজে না পেয়ে চুপ মেরে যায়!

Advertisement

যত বার চিত্রসমালোচনার ভার বর্তেছে, তত বারই এই গল্পটা মনে আসে, আর আমি সমালোচক থেকে গোপনে আলোচক হয়ে যাই। তবে আমার এই ভাগ্য বেশ ভাল। পরপর এমন এমন ছবি আমার কপালে পড়েছে যে সিনেমা দেখার আনন্দে ছবির পোস্টমর্টেম করার চাপটাই অনুভব করিনি এবং সেই সব ছবির নামডাকও কম হয়নি। যেমন ‘বরফি’, ‘পিকু’, এ বার ‘বাজিরাও মস্তানি’। লেখা শুরুর আগেই বলে রাখি সিনেমাটোগ্র্যাফি আর প্রোডাকশন ডিজাইনিং-এর জন্য আগামী বহু বছর সিনেমার ছাত্রদের উপপাদ্য
হয়ে থাকবে সঞ্জয়ের লীলা আর ক্যামেরার মস্তানি।

আমি যখন ছবি দেখতে গেছি, তত দিনে বেশ ক’জন ক্রিটিক এই ছবির বাপান্ত করেছেন! ঐশ্বর্যের বড়াই করতে গিয়ে নাকি পরিচালক ছবিটির চক্ষুদান করতেই ভুলে গিয়েছেন। আশ্চর্য হলাম ছবি দেখার পর! কেন যে ও রকম ভ্রান্ত উপলব্ধি ও প্রচার হল এই ছবির! শহরের বুকে প্রবীণ প্রেমের পুরনো চাল যখন আর ভাতে বাড়ছে না, যখন গেরুয়া ওড়না উড়িয়ে, দু’হাত ছড়িয়েও বরফ উপত্যকায় সেকেলে সিনেমার গল্পকে বাঁচানো গেল না, ঠিক তখনই পুরনো মরাঠি ইতিহাসের প্রায় ভুলে যাওয়া এক প্রেমগাথাকে চূড়ান্ত আধুনিক প্রযুক্তি ও শিল্পবোধে স্থাপন করলেন পরিচালক সঞ্জয় লীলা বনশালি। ভারতীয় সিনেমায় এমন ভাবে, এমন যত্নে তৈরি চলচ্চিত্রে অমর চিত্রকথা আমি বিশেষ দেখিনি।

Advertisement


প্রিয়ঙ্কা চোপড়া

শিল্পনির্দেশনার যত্ন নিয়ে সঞ্জয় চিরকাল ঋতুপর্ণর গুণগান করতেন। কিন্তু ঋতুপর্ণর তা ঘর সাজানোর দক্ষতায় সীমাবদ্ধ থাকত, একটা রাজ্য সাজাবার বা একটা বিশাল ইন্দ্রপ্রস্থ নির্মাণের ভার তাঁকে নিতে হয়নি।

রুচি, বিচক্ষণতা, মেধা ও শিল্পবোধ দিয়ে যাচাই করে করে নির্মাণ প্রতিটি কোণ, প্রতিটি শূন্য। নিখুঁত ফ্রেমের অনর্গল বর্ষণ আর মণিমুক্তোর মতো ছড়ানো অভিনেতাদের শরীর-মন আর কণ্ঠস্বর। সর্বভারতীয় দর্শক নাকি একটু উচ্চকিত নাটকে বেশি মজে। সেটা করতে গিয়ে বহু বার বহু সিনেমাকে পথভ্রষ্ট হয়ে হাস্যকর হয়ে যেতে দেখেছি। ‘বাজিরাও মস্তানি’র বাঁধুনিতে, ব্যাপ্তিতে সে ভুলের স্থান নেই। বললাম না, একদম ছায়াবাজির অমর চিত্রকথা। শুরুতেই টাইটেলে পেন্টিং আর গ্রাফিক্স যোগ করে ইতিহাস ভিত্তিক রূপকথার গল্প বলার মেজাজটা দিব্যি বুঝিয়ে দিলেন। তার পর দীর্ঘ আড়াই-পৌনে তিন ঘণ্টা চলল সঞ্জয়ের ইন্দ্রজাল! বেশ কিছু বাচ্চাও হলে ছিল। কেউ একটা শব্দও করল না। একটা মোবাইলও বাজল না! কেউ কাশল না, কথা বলল না, উঠল না! এ তো মনগড়া, নেকুপুশুমুনু প্রেমের ভেজা গল্প নয়। এ তো ইতিহাসের এক প্রেমগাথার বলিউডি ক্লাস চলছে! আর পর্দায় বাস্তব সুন্দরী প্রিয়ঙ্কা চোপড়া, অবাস্তব সুন্দরী দীপিকা পাড়ুকোন আর রণবীর সিংহ! কোটি কোটি টাকার গ্রাফিক্স করে এদের সুন্দর বানাতে হয়নি। এরা এ রকমই। এরা সত্যি। ভাগ্যিস দীপিকাকে চিনি না। চিনতেও চাই না। রাজ্যে রাজ্যে যুদ্ধ লাগার যে ইতিহাস আমরা কচিবেলায় পড়েছি, তার পিছনে সামান্য একটি নারীর সৌন্দর্য কী করে কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে! এর জবাব দীপিকা। এমন অব্যর্থ কাস্টিং ও চরিত্রনির্মাণের জন্য পরিচালককে কুর্নিশ!

প্রিয়ঙ্কার মতো সুন্দরী হজমযোগ্য ও বাস্তব। প্রেসিডেন্সি বা যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে তাঁকে শেষ ২০০০ সালে হয়তো দেখেছি। এতটাই চেনা। কিন্তু দীপিকাকে দেখিনি, কেউ দেখেনি! কেবল মাত্র মশালের আলোয় ভোররাতের রহস্যময় এক দুর্গের গলিতে বাজিরাও তাকে দেখেছিল। তরোয়ালের মতো ভ্রু তুলে নিজের মনের কথা অকপটে বলেছিল মস্তানি!

প্রিয়ঙ্কাকে নিয়ে ‘বরফি’তে মুগ্ধ হয়েছি, ‘পিকু’তে দীপিকার ঘরোয়া রূপ দেখেছি। এ বার দুই কন্যা একসঙ্গে জুটল পর্দায়। এবং দায়িত্ব নিয়ে বলছি, দু’জনেই তাঁদের পাওনাগণ্ডা বুঝে নিয়েছেন ও বুঝিয়ে দিয়েছেন। জাত অভিনেতারা পর্দা ভাগ করতে ভয় পায় না। ভয় পায় যারা দুর্বল, যারা নিজেরাই জানে না তাদের ঘড়ায় ঠিক ক’টি মোহর আছে।

রণবীর অনবদ্য ও বিশ্বাসযোগ্য। তবে একদম শেষবেলায়, মৃত্যুর দৃশ্যের আগে বেশ ক’বার যেন ছন্দপতন হয়েছে। তবে ওটুকু মাফ! তা ছাড়া এত বড় বীরকে জন্মে জ্বরে কাবু হতেও তো দেখিনি যে বলব, কই, সিরাজের তো ওরম প্রলাপ বকার মতো স্টেজ হয়নি! রূপকথার আর ইতিহাসের গলিতে রণবীরের ওই সামান্য ত্রুটি লুকিয়ে রাখলাম।

তবে অভিনেতাদের মধ্যে সেরা মায়ের চরিত্র তনভি আজমি। বাপরে বাপ, কী অভিনয়! কী সংযত ব্যক্তিত্ব! মনে থাকবে।

সঙ্গীত সঞ্জয় লীলার নিজেরই। আয়োজন চূড়ান্ত। পরিকল্পনা মাফিক অঢেল বাদ্যযন্ত্রের স্তর। তবে সুর যেন ‘দেবদাস’-এর চেনা পথেই হেঁটেছে। এমনকী মেডলির মতো এ ছবির গান থেকে ‘দেবদাস’-এর গানে অনায়াসে চলে যাওয়া যায়। এটা ত্রুটি না বলে ঘরানা বলাই ভাল।

সঞ্জয় সঙ্গীতের সঙ্গে পরিচিত কেবল কানে শুনেই। স্বরলিপির সব চরিত্র ওর কাছে কাল্পনিক! সেই মানুষটি দিব্যি এমন বিশাল ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করে বুঝিয়ে দিলেন, শিল্পের গোড়ায় হল সাহস আর নিষ্ঠা! দীপিকার প্রথম নাচের একটা অংশে, একটি কোমল সুর লাগানোর সময়, উল্টো দিকে ‘কোমল’ পাল্টে, ভঙ্গি বদলে ওরম ভাবে ‘কোমল’কে উদযাপন করতে দেখিনি। স্তব্ধ হয়েছি সুরের সঙ্গে বোঝাপড়া দেখে!

এ বার ম্যান অব দ্য ম্যাচ-এর পালা। বঙ্গসন্তান। ইদানীং সঞ্জয় লীলার সব ছবি উনিই করেন। আগে ‘চক দে ইন্ডিয়া’, ‘গুজারিশ’-এ আলাদা আলাদা রূপ দর্শন করেছি তাঁর। ‘চতুষ্কোণ’-এও চমৎকার সে। ভারতের শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহকের পুরস্কার তাঁর ঝুলিতে। চিত্রগ্রাহক সুদীপ চট্টোপাধ্যায়! অনবদ্য! কম্পিউটারে গ্রাফিক্স আর অজস্র গ্রিন স্ক্রিনের আকাশ সামলে এমন নরম ত্বক ভারতীয় সিনেমায় খুব কম দেখেছি। কম্পিউটার গ্রাফিক্স হাজার খরচেও আমাদের দেশে এখনও আন্তর্জাতিক মানের হয় না। তার সামনে আসল অভিনেতাদের আলোর ভারসাম্য না রাখলে সব তালগোল পাকিয়ে মিথ্যে হয়ে যায় যেন। এটা যত সহজে লিখে ফেললাম, ততটা সহজ কাজ আসলে নয়। শাবাস সুদীপ! আমরা গর্বিত তোমার অবদানের জন্য। তুমি না থাকলে এ ছবিতে সঞ্জয় লীলা বনশালি কিছুতেই অবন ঠাকুর হয়ে উঠতে পারতেন না। মিথ্যে হয়ে যেত প্রিয়ঙ্কার চোখের মণি, ঠোঁট! দীপিকার কোমর, ভ্রু অমন আঁকাই হত না। রণবীর অত বড় যোদ্ধাও যেন হতেই পারত না তোমার মহাকাব্যিক রশ্মিমালা না পড়লে।

শেষে পরিচালকের সঙ্গে অন্তরঙ্গ দু’একটি কথা। সঞ্জয় ছোট্টবেলার অভাবের কষ্ট আজ দশ ফুট বাই দশ ফুটের ঘরকে তোমার ইচ্ছেতে প্রাসাদে প্রতিপন্ন করেছ তুমি। ছোট্ট ঘরে তোমার নৃত্যশিল্পী মা দু’হাত ছড়িয়ে নাচতেও পারেননি অভাবে। চ্যাপলিনের মতো সেই কষ্ট বুকে নিয়ে ব়ড় হয়েছ তুমি। তাই আজ প্রতিটি ছবিতে মায়ের জন্য চূড়ান্ত বিলাসবহুল নাচ-ঘর বানিয়ে উপহার দাও তুমি। মনে মনে ভাবতে চাও মা নাচছেন, যত খুশি! হাত দেওয়াল বা ফ্রিজে ধাক্কা খাবে না। কারণ তোমার স্বপ্নের নাচমহলে কেবলমাত্র মায়ের গালে সন্তানের চুম্বনের বাস্তবতা ছাড়া আর কোনও আসবাবের স্থান নেই। সেই ছোট্টবেলার সঞ্জয়কে আলিঙ্গন। আর আজকের বলিউডের অবন ঠাকুরকে বলি— সাধু... সাধু... সাধু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন