Durga Puja Song

দুর্গোৎসবের গান

দুর্গাপুজো তো এ বাংলায় এই রকমই। সবাই মানে সব্বাই, কেউ বাদ নেই। যে যার নিজের মতো করে সামিল এই উৎসবে, আবার সবাই মিলেও সামিল যখন-তখন, যেখানে-সেখানে। আসিফ হয়তো অঞ্জলি দেবে না, কিন্তু নতুন জামা-জুতো অবশ্যই কিনবে।

Advertisement

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ১৬:৩৪
Share:

শাহেনশাহ মামা তুমুল হইচই জুড়ে দিয়েছে প্যান্ডেলে। অষ্টমীর অঞ্জলির জন্য বেশি করে ফুল আনতে বলা হয়েছিল। দায়িত্ব ছিল জয়ন্ত মামার উপর। অঞ্জলির সময় হয়ে গিয়েছে, গোটা হাউজিং প্যান্ডেলে জড়ো হয়েছে, কিন্তু ফুল তখনও আসেনি। তাই শাহেনশাহ মামা বেজায় চটে গিয়েছে, গজগজ করছে আর বলছে, ‘জয়ন্তদার উপর কোনও দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না।’

Advertisement

বিরাট হাউজিং কমপ্লেক্স। উমার ঘরে ফেরা উদ্‌যাপন করতে হাউজিং-এর সব মেয়ের ঘরে ফেরা। আর দিন পাঁচ-ছয় গোটা হাউজিং একান্নবর্তী হয়ে কাটানো। কখনও মনে প্রশ্নই জাগেনি, এই শাহেনশাহ নামের হাউজিং-তুতো মামাটি হিন্দু না মুসলমান। বিজয়ার পর যখন ‘পি’ ব্লকের পাপ্পু মামা আমাদের ‘এল্‌’ ব্লকের বাড়িতে এসে দিদাকে প্রণাম করত আর তার পর লুচি, ঘুঘনি, পায়েস, নাড়ু, নিমকি, মিষ্টির সৎকার করত, তখন পাপ্পু মামার মাথার পাগড়ি দেখে কখনও এক বারের জন্যও মনে হয়নি, শিখদের আবার বিজয়া দশমী কীসের?

আরও পড়ুন, দ্বিতীয়া থেকেই পুজো শুরু কাজলের

Advertisement

আজকাল কিন্তু এ সব প্রশ্ন মনে একটু একটু উঁকি দিচ্ছে। ছোটবেলা থেকে দুর্গাপুজোকে যে ভাবে দেখে ও বুঝে এসেছি, তাতে এর সর্বজনীনতা নিয়ে কোনও সংশয় ছিল না চেতনায়। পুজোটা সবারই, পুজোয় সবাই মিলেই মাততে হয়, এই রকম একটা উপলব্ধিই ছিল বরাবর। পুজোয় কেউ ঘর অন্ধকার করে বসে রয়েছে দেখলেই বরং মন কেমন করত। কিন্তু ইদানীং অনেকগুলো জিজ্ঞাসা ঘিরে ধরছে। দুর্গোৎসব কি শুধু হিন্দুর, নাকি সব বাঙালির? পুজো কি শুধু বাঙালির, নাকি এই বঙ্গের সব বাসিন্দার? এই রকম কয়েকটা প্রশ্ন মাথাচাড়া দিচ্ছে। বাংলার সবচেয়ে বড় উৎসবের দিশাটাকেই বদলে দেওয়ার একটা চেষ্টা শুরু হয়েছে সম্প্রতি। সে সব দেখেশুনেই যে এই বিভ্রান্তিটা আসছে, সে বেশ বুঝতে পারছি।

বিভ্রান্তিটা চিরস্থায়ী হবে না, উত্তর পাবই, বিশ্বাস ছিল। একটা ভিডিও-গান সেই বিশ্বাসকে আরও মজবুত করল। আনন্দবাজার ওয়েবসাইটের জন্য গানটা তৈরি হয়েছে— দুর্গোৎসব গান। কয়েক মিনিটের একটা মিউজিক ভিডিও। ঝাঁ-চকচকে প্রেজেন্টেশনের বদলে রিয়েল লাইফ ভিডিওগ্রাফির উপরেই ভরসা রেখেছেন নির্মাতারা। কিন্তু রিল না রিয়েল, সাজানো সেট না ব্যস্ত রাস্তা, এ সব প্রশ্ন একেবারেই ফালতু হয়ে পড়েছে গানটার অসামান্য দর্শনের সামনে। আসিফের নতুন জুতো/ সোহিনীর নতুন শাড়ি/ জুলিয়া বিদেশ থেকে/ পুজোতে ফিরবে বাড়ি— একেবারে সাদামাটা, সহজ শব্দের গান, একেবারে সরল, প্রাণ ছুঁয়ে যাওয়া সুর। কিন্তু বাংলার এবং বাঙালিয়ানার অনন্ত গভীরে গিয়ে তুলে আনা একটা উপলব্ধি।

দুর্গাপুজো তো এ বাংলায় এই রকমই। সবাই মানে সব্বাই, কেউ বাদ নেই। যে যার নিজের মতো করে সামিল এই উৎসবে, আবার সবাই মিলেও সামিল যখন-তখন, যেখানে-সেখানে। আসিফ হয়তো অঞ্জলি দেবে না, কিন্তু নতুন জামা-জুতো অবশ্যই কিনবে। নভজ্যোতের বাড়িতে হয়তো সন্ধিপুজোর জন্য কেউ উপোস করছেন না। কিন্তু অপার উৎসবের দিনে-রাতে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে গোটা শহর দাপিয়ে বেড়াতে নভজ্যোতের বাধা কীসের?

ছোট থেকে এই রকমটা দেখেই তো বড় হয়েছি। যেমনটা আজকের বাতাবরণে দেখছি, তেমন উপলব্ধি ছিল না তখন। দশমীতে অপরাজিতা পুজা হয়, দর্পণ বিসর্জন হয় দেখেছি, কিন্তু শস্ত্র পূজা হতে কখনও দেখিনি। বিসর্জনের মিছিলে নাচ-গান হয়, সিঁদুর খেলা হয় দেখেছি, কিন্তু মহরমের তাজিয়ার জন্য বিসর্জনের মিছিল আটকে দিতে দেখিনি। সম্প্রতি এ সব দেখছি, শুনছি। বিভ্রান্তও হচ্ছিলাম, তবে আর হচ্ছি না। এত দিন যে ভুল বুঝে আসিনি, আজকের বাতাসটাই যে ভুল বোঝানোর চেষ্টা করছে, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।

আরও পড়ুন, এখন পুজোয় একটা জিনিস খুব মিস করি…

আনন্দবাজার ওয়েবসাইটের জন্য তৈরি হওয়া দুর্গোৎসবের গানটার নির্মাতা ‘এসওএস আইডিয়াস’। সংস্থার সৌভিক মিশ্রর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। সৌভিক বললেন, ‘‘গানটার কনসেপ্ট আর কথা দেখে দেবজ্যোতি মিশ্র এত খুশি হলেন যে, আমাদের আর ভাবতেই হল না বিষয়টা নিয়ে। উনি জাস্ট মুভড্‌। এই ছোট্ট গানটার জন্য ওঁর মতো সুরকার এত খাটাখাটনি করবেন, এত যত্ন নিয়ে কাজ করবেন, ভাবতেই পারিনি।’’

গানটার সঙ্গে এত একাত্ম হয়ে পড়ার যথেষ্ট কারণও কিন্তু রয়েছে। আসিফ, সোহিনী, জুলিয়া, নভজ্যোৎ, সনিয়া— গানের চরিত্রগুলো তো লহমায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে ছোটবেলাটায়, দেখা করিয়ে দিচ্ছে পুজো প্যান্ডেলে শাহেনশাহ-জয়ন্ত-পাপ্পুদের সেই মিলিজুলি ফোটোফ্রেমের সঙ্গে। এ বাংলার অধিকাংশ মানুষ তো পুজোটাকে এ ভাবেই চেনেন। গোটা ভারতে এই সময় নবরাত্রি উৎসব পালিত হয়। দেবী দুর্গারই আরাধনা হয়। কিন্তু সে উৎসব শুধু হিন্দুর উৎসব হয়েই থেকে যায়। কারণ একগুচ্ছ বিধিনিষেধ আর উপবাসেই ন’দিন কাটিয়ে দেন নবরাত্রির ব্রতীরা। বাঙালির পুজো তো উপোসের নয়, বিধি-নিষেধেরও নয়। পুরোহিত মশাই মণ্ডপে নিষ্ঠা নিয়েই পুজো করবেন, মা-কাকিমাদের ষষ্ঠী-অষ্টমীও থাকবে। কিন্তু তার মাঝেই পাঁচ দিন চলবে চর্ব্য-চোষ্য ভূরিভোজ, দেদার হুল্লোড়, সব বিধি-নিষেধ কয়েক দিনের জন্য শিকেয় তুলে রাখার বন্দোবস্ত। এ বাংলায় দুর্গোৎসব তো ‘পূজা’ নয়, এ হল ‘পুজো’। কঠোর ধর্মীয় অনুশাসনের গেরোয় দেবীকে দূর থেকে প্রণাম জানানো নয়, হৃদয়ের আত্মীয়তায় উমাকে ঘরের মেয়ে বানিয়ে নেওয়া— বাংলার সবচেয়ে বড় উৎসব অনন্য তো সেখানেই।

আরও পড়ুন, ফেসবুকে আড্ডা লাইভ @ মহালয়া

রাজনীতির গেরোয় এই উপলব্ধিটাই হারাতে বসেছিল। সঙ্কটকালে পুজোর গানটা খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে ধরা দিল। উৎসব ভাবনার যাবতীয় মরচে নিঃশেষে উধাও। একটা অভূতপূর্ব সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আনন্দবাজার ওয়েবসাইট এ বারের উৎসবের গান এনেছে। এই উৎসব কোনও নির্দিষ্ট ধর্মের, সম্প্রদায়ের বা ভাষার নয়, আপামর বাংলার, দুর্গোৎসব গান এই বার্তাটা দিয়েছে। লক্ষ লক্ষ বাঙালি সম্ভবত অপেক্ষা করছিলেন এমনই একটা কিছুর। ইন্টারনেটের দেওয়া হিসেবই সে কথা বলছে— মাত্র তিন দিনে ৭ লক্ষ ভিউস। সৌভিক মিশ্র আরও একটা অসামান্য তথ্য দিলেন— গোটা গানটার কম্পোজিশনে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁরা বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেছেন। সম্প্রীতির বার্তাটায় আসলে প্রত্যেকে নিজের কিছু কিছু অবদান রেখে দিতে চেয়েছেন।

গানের নির্মাণ থেকে পরিবেশন, রিঅ্যাকশন থেকে ভিউয়ারশিপ— বাঙালির মন পড়তে আর কারও অসুবিধা হবে না আশা করা যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন