কেন এত বছর পর মুখ খুললেন অনামিকা? ছবি: সংগৃহীত।
দক্ষিণ কলকাতায় বড় বাড়ি তাঁর। উপর তলায় থাকেন স্বামী। নীচের অংশে তাঁরই আধিপত্য। ও পার বাংলার ঊষা সাহা কী করে হয়ে গেলেন টলিউডের অনামিকা সাহা?
প্রশ্ন: টলিউডে প্রায় ৪০ বছর কাটিয়ে ফেলেছেন। এত দিন যা যা সহ্য করতে হয়েছে সেগুলো এখন কেন বলছেন?
অনামিকা: মেয়েও আমায় এই প্রশ্নই করেছিল। আসলে আগে আমার সব সময় খুব ভয় করত।
প্রশ্ন: কিসের ভয়? কাজ হারানোর?
অনামিকা: হ্যাঁ। ভয় করত সব সত্যি কথা বলে দিলে যদি কাজ না পাই! ইন্ডাস্ট্রি যদি আমায় বাতিল করে দেয়। সবার সঙ্গে কাজ করছি। কাদের নামে বলব! সবাই আমার চেয়ে নামী শিল্পী। মনে হত, কে আমার কথা শুনবে?
প্রশ্ন: এখনও তো কাজ করছেন। তা হলে এখন কী করে বলছেন, ভয় কি তবে কেটে গিয়েছে?
অনামিকা: এখন একটা মনের জোর এসেছে। মনে হয় বয়স হয়ে গেল, এ বার তো আমি শেষের পথে। এখনও যদি চুপ করে থাকি, তা হলে আর কবে বলব! এখন তো যুগ অনেক বদলে গিয়েছে। কিন্তু আমরা যখন শুরু করেছিলাম, তখন পুরনো নামী শিল্পীরা নতুনদের উপর খুব অত্যাচার করতেন। তখন নতুনদের জায়গা ছেড়ে দেওয়ার ভাবনাই কারও মধ্যে ছিল না। শুধুই পুরনোদের রাজত্ব।
প্রশ্ন: পুরনোদের রাজত্বের মাঝেও তো নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন, কেউ না কেউ জায়গা ছেড়েছেন বলেই তো সেটা সম্ভব হয়েছে?
অনামিকা: সব শিল্পীই খারাপ ছিলেন, সেটা বলছি না। কিছু ভাল মানুষ না থাকলে কি আর এই জায়গায় পৌঁছোতে পারতাম? সাহায্য করেছেন অনেকেই। কিন্তু কিছু শিল্পী এত অত্যাচার করেছেন আমার উপর, তাই এখন মনে হয়েছে মুখোশটা টেনে খুলে দেব। আর মুখ বন্ধ করে রাখি না। এখন তো আর কাজ হারানোর ভয় নেই।
প্রশ্ন: তখনও কি ইন্ডাস্ট্রিতে ‘লবিবাজি’, দলবাজি ছিল?
অনামিকা: সিনিয়র অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দাদাগিরি তো অবশ্যই ছিল। সেটাকে দল, ‘লবি’ বলা যায় কি না বলতে পারব না। আমরা ও পার বাংলা থেকে এসেছিলাম। ১৯৬৫ সালে আমরা এ পারে চলে আসি। সে সময় ও পারে হিন্দু পরিবারের উপর খুব অত্যাচার। তবু বাবা রয়ে গেলেন, বড় ব্যবসা ফেলে আসতে পারলেন না। ভাইবোনদের সঙ্গে আমি চলে এলাম। ফলে কলকাতায় এসে আমাদের লড়াইটা ছিল অন্য রকম। তখন যদি অত্যাচারিত হচ্ছি বলে মুখ খুলতাম, তা হলে তো সত্যিই সমস্যায় পড়তাম। এখন এমনটাই মনে হয়। বাইরের মেয়ে বলে কত কাজ হাতছাড়া হয়েছে আমার। আমার তো আসল নাম অনামিকাও ছিল না।
প্রশ্ন: আপনার নাম তো অনামিকা নয়?
অনামিকা: আমার ভাল নাম তো ঊষা সাহা। তখন আমি কলেজে পড়ি। সে সময়ই প্রথম অভিনয়ের সুযোগ আসে। আমার দিদির খুব আগ্রহ ছিল সিনেমা জগতের প্রতি। এমনই একদিন স্টুডিয়োপাড়ায় দিদির সঙ্গে গিয়েছিলাম শুটিং দেখতে। কিন্তু আমার ভাল লাগছিল না। তাই বাইরে ঘুরছিলাম। দিদি বলে দিয়েছিল কেউ কিছু প্রশ্ন করলে যেন জবাব না দিই। তাই স্টুডিয়োর বাইরে আমায় যখন এক জন নাম জিজ্ঞেস করে। মুখ বন্ধ করে দাঁড়িয়েছিলাম। সেই ভদ্রলোক বলেছিলেন, তোমার কি নাম নেই? তুমি কি অনামিকা? সেটাই ঘাড় নেড়ে সায় দিয়েছিলাম। তখন থেকেই আমি হয়ে গেলাম অনামিকা সাহা। তার পর যে এত কিছু দেখতে হবে কে জানত!
প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে পরিবারের যোগ নেই না কি গায়ের রং— কোন বিষয়টার জন্য বেশি সমস্যা পোহাতে হয়েছে?
অনামিকা: সব কারণই ছিল। বিজয় বসু নামের এক জন নামজাদা পরিচালক ছিলেন। আমায় একটি ছবিতে কাজ করার জন্য বলেন। ছবির নায়ক ছিলেন তাপস পাল। নায়িকা ছিলেন শতাব্দী রায়। খলনায়িকার চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি আমায় বলেছিলেন। সেই সুযোগও হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল।
প্রশ্ন: কী করে?
অনামিকা: তখন আমি বেলগাছিয়ায় থাকি। নতুন কাজ আসছে। উত্তেজিত হয়েই গিয়েছিলাম ওঁর (বিজয়) সঙ্গে দেখা করতে। তখন স্টুডিয়োগুলোয় পরিচালকদের ঘর থাকত। আমি বিজয়বাবুর ঘরে গিয়ে দেখা করি। আমায় বসতে বলে উনি তখন প্রযোজকদের সঙ্গে মিটিং করতে যান। তার পরেই জানান যে আমায় নিয়ে তিনি কাজ করতে পারবেন না। কারণ, সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়ের বাজারদর অনেক বেশি আমার থেকে। তাই তাঁকেই নিতে হবে। আসলে আমি তো কোনও দিন প্রযোজকের ঘনিষ্ঠ হতে পারিনি।
প্রশ্ন: কেন, সেই প্রযোজকের কি খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়?
অনামিকা: সে যুগে আলোচিত প্রযোজক ছিলেন কেএল কপূর। তাঁর সঙ্গেই থাকতেন সুমিত্রাদি। তিনিই বিজয়দার প্রযোজকদের বলেছিলেন ওই চরিত্রের জন্য সুমিত্রাকে যেন নেন তাঁরা। অত বড় প্রযোজক বলেছেন, তাঁর কথা কি কেউ ফেলতে পারে!
প্রশ্ন: আপনার সঙ্গে কখনও কোনও পরিচালক, প্রযোজকের ভাল বন্ধুত্ব তৈরি হয়নি? কিংবা কারও তরফ থেকে প্রস্তাব পাননি?
অনামিকা: না, আমি কখনও প্রস্তাব পাইনি। বন্ধুত্বও করার ইচ্ছাও কেউ প্রকাশ করেনি কখনও।
প্রশ্ন: তা হলে আপনার কখনও মনে হয়েছে যদি একটুও বন্ধুত্ব তৈরি করা যায় তা হলে কাজ পাওয়া সহজ হবে?
অনামিকা: এ সবে খুব ভয় পেতাম। ও পার বাংলার মেয়ে তো। খুব রক্ষণশীল ভাবে বড় হয়েছি। তাই কখনও মনে হয়নি নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে কাজ পেতে হবে। তা-ও এক বার যা কাণ্ড!
প্রশ্ন: কী হয়েছিল?
অনামিকা: তখন পার্ক স্ট্রিটে এক প্রযোজকের বড় ফ্ল্যাট ছিল। উনি যখনই নতুন মেয়েদের নিয়ে ছবি করতেন তখনই ডেকে পাঠাতেন ওই ফ্ল্যাটে। ওখানে ডেকে পাঠিয়ে ছিলেন। তার পর যা শুনেছিলাম, ভাবলেই কাঁটা দেয়। হুইলচেয়ারে বসে থাকা এক ভদ্রলোক যে এমন সব কাণ্ড করতে পারেন সেটা ভাবতেই পারিনি। সেই ঘটনা আগে শুনতে পেয়েছিলাম ভাগ্যিস। শোনার পর আর ওখানে যাইনি। তখন অবশ্য আমার জীবনেও নতুন প্রেম।
প্রশ্ন: অভিনেতা বোধিসত্ত্ব মজুমদারের সঙ্গে আপনার আলাপও অভিনয়ের মাধ্যমেই?
অনামিকা: প্রথমে তো আমার অভিনয়ের কথা মেনে নেয়নি আমার পরিবার। খুব মার খেয়েছিলাম। মা, দাদা সকলের আপত্তি ছিল। তখনই এক জন আমায় মঞ্চে অভিনয় করার ভাবনাটা মাথায় ঢোকান। সেই সূত্রেই আমার মঞ্চে ওঠা। তখন রামমোহন হলে ‘রঙ বেরঙ’ বলে একটা নাটক হত। মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করতেন রত্না ঘোষাল। কিন্তু ঝামেলা হওয়ায় সেই কাজটা ছেড়ে দিয়েছিল রত্না। তখনই নতুন মেয়ের খোঁজ পড়ে। সেই সূত্রে আমার সেখানে যাওয়া।
প্রশ্ন: তার পর...
অনামিকা: সেখানে আমার সঙ্গে আলাপ হয় রবীন্দ্রভারতীর অধ্যাপক অমর ঘোষের। যিনি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। তিনি যদিও ওই ‘রঙ বেরঙ’ নাটকটি আর চালাননি। তবে পরে ‘রামমোহন’ বলে একটি নাটক করেছিলেন। সেখানেই বোধিসত্ত্বর সঙ্গে আমার আলাপ। রবীন্দ্রভারতীতে নাটক নিয়ে পড়াশোনা করতেন। রামমোহনের ভাগ্নের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বোধিসত্ত্ব। সেখান থেকেই আমাদের আলাপ, তার পর প্রেম।
প্রশ্ন: তার পরেই কি বিয়ে হয়ে গিয়েছিল আপনাদের?
অনামিকা: বোধিসত্ত্বই আমায় টালিগঞ্জের অলিগলি চিনিয়েছে। আমি তো দক্ষিণ কলকাতার কিছুই চিনতাম না। আর ওর বাড়ি তো একেবারে কালীঘাটের কাছে। বনেদি পরিবারের ছেলে। বসুমতী পত্রিকার সর্বজিৎদা আমায় বলেছিলেন, বোধিসত্ত্বই আমায় স্টুডিয়োগুলো চিনতে সাহায্য করে দেবে। সেই থেকেই আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব, প্রেম তার পর বিয়ে। নাটকই আমাদের বেঁধে দিয়েছিল।
প্রশ্ন: বনেদি পরিবারের ছেলে বোধিসত্ত্ব। শ্বশুরবাড়ি থেকে মেনে নিয়েছিল আপনার এই অভিনয়ের কেরিয়ার?
অনামিকা: বিয়ের পর ছ’বছর আমি অভিনয় করিনি। শাশুড়ি তো আমায় প্রথম দেখে কেঁদেই ফেলেছিলেন। কারণ, আমার গায়ের রং কালো। সে সময় অবশ্য বোধিসত্ত্ব আমায় আশ্বস্ত করেছিলেন যে বিয়েটা আমরা করব। সুতরাং মায়ের ব্যবহার নিয়ে যেন না ভাবি।
প্রশ্ন: ছ’বছর পর আবার কী করে শুরু করলেন?
অনামিকা: মেয়ে হওয়ার পর আবার কাজ শুরু করি আমি। তখন আমার স্বামীও খুব বেশি কাজ করতেন না। চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। তবে সংসার টানার জন্য যে কাজ করতে হয়েছে তেমনটা নয়। কিন্তু মেয়ে হয়েছে। তার তো কিছু খরচ ছিল, সেই জন্য আবারও থিয়েটার শুরু করি। আমার পদবির জন্যও খুব সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে।
প্রশ্ন: পদবির জন্য কী হয়েছিল আবার?
অনামিকা: সে সময় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়রা দাপটের সঙ্গে অভিনয় করছেন। আমায় দেখলে অনেকেই ব্যঙ্গ করে বলতেন ‘বেনোজল ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকে যাচ্ছে’। ব্রাহ্মণ নই তাই এমন ব্যবহার। তাই বিয়ের পরেও জেদের বশে নিজের পদবি পরিবর্তন করিনি।
প্রশ্ন: এখন আলাদা থাকেন বললেন, আপনাদের কি আইনি বিচ্ছেদ হয়েছে?
অনামিকা: না, বোধিসত্ত্বের সঙ্গে আমার আইনি বিচ্ছেদ হয়নি। মেয়ে হওয়ার পর থেকে দূরত্ব তৈরি হয়। নানা কারণে। সেটা বিশদে বলতে চাই না। তবে আমার শ্বশুরমশাই বলেছিলেন যাই হয়ে যাক না কেন, আমি যেন এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও না যাই। ওঁর কথার মর্যাদা রেখেছি। আইনি বিচ্ছেদ না হলেও আমরা আলাদা থাকি, তবে একই বাড়িতে। আমি নিজের কাজে ব্যস্ত। বোধিসত্ত্ব তাঁর কাজে। তবে মেয়ে তাঁর মা-বাবা দু’জনকেই সমান গুরুত্ব দেয়।
প্রশ্ন: ৪০ বছর এত চড়ই-উতরাই পার করে আপনি কি এখন খুশি?
অনামিকা: এখন আমি শান্তিতে রয়েছি। মেয়ে বড় হয়ে গিয়েছে। বিদেশে থাকত এত দিন। এখন দিল্লির কলেজে পড়ায়। লেখালিখি করে। মেয়েকে মানুষ করতে পেরেছি, এতেই আমি সফল। এখনও অনেকে আমায় ডাকেন কাজের জন্য, এত বছরে এটাই তো আমার প্রাপ্তি।