ঋত্বিক চক্রবর্তী, প্রিয়াঙ্কা সরকার ‘ফেরা’ ছবিতে। ছবি: সংগৃহীত।
দুপুরের রোদ একটু চড়া। চওড়া রাস্তার ধুলো উড়িয়ে সাঁ সাঁ গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে। দু’পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নির্মীয়মাণ বহুতল। কোনওটার গায়ে রঙের নতুন প্রলেপ। কোনওটা বাসিন্দা আসার অপেক্ষায়।
অনেক দিন ধরে ঋত্বিক চক্রবর্তীর ইচ্ছা, হাত-পা ছড়িয়ে এ রকম একটি বহুতলের উঁচু ফ্ল্যাটে থাকবেন! খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে মঙ্গলবার তিনি রাজারহাটে। নতুন বাড়ির খোঁজে। সেখানেই চমক। একটি নির্মীয়মাণ বহুতলে তিনি মুখোমুখি প্রিয়াঙ্কা সরকারের সঙ্গে। আচমকা সাক্ষাতের প্রাথমিক উচ্ছ্বাস কাটতেই দু’জনে গল্পে বুঁদ। কেজো দিনে দুই অভিনেতা হাত-পা ছড়িয়ে এ ভাবে আড্ডা দিচ্ছেন!
শুটিংয়ে মুখোমুখি প্রিয়াঙ্কা সরকার, ঋত্বিক চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।
আনন্দবাজার ডট কম সেখানে উপস্থিত হতেই দুধ-জল আলাদা। পৃথা চক্রবর্তী তাঁর আগামী ছবি ‘ফেরা’র শেষ দিনের শুটিং করছিলেন এক প্রথম সারির বহুতল আবাসন এবং তার সংলগ্ন অঞ্চলে। ঋত্বিক ছবির নায়ক। পর্দায় তাঁর প্রাক্তন প্রেমিকা প্রিয়াঙ্কা।
পুরোদস্তুর ‘কর্পোরেট লুক’। শার্টের উপরে হাল্কা ব্লেজার। চুল তুলে বাঁধা। প্রিয়াঙ্কাকে এ রকম আধুনিক সাজে কি কমই দেখা যায়? প্রশ্ন শুনে অভিনেত্রীর বক্তব্য, “আসলে চরিত্রের প্রয়োজনেই এই সাজ। কখনও এই সাজে পর্দায় আসিনি, তা নয়। তবে আমার বেশ লাগছে।” তার পরেই জানালেন, ঋত্বিকের সঙ্গে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে মনটা খুশি তাঁর। আপনিই নায়িকা? মুখে কুলুপ এঁটে আড়নজরে তাকালেন পরিচালক পৃথার দিকে।
শুটিংয়ের ফাঁকে ঋত্বিক চক্রবর্তী, সোহিনী সরকার, সঞ্জয় মিশ্র। ছবি: সংগৃহীত।
পৃথা বললেন, “নায়িকা নয়, ঋত্বিকের প্রাক্তন প্রেমিকা।” তা হলে কি যা রটেছে, তা-ই ঠিক?
প্রশ্ন শুনে বিস্ময় পরিচালকের মুখেচোখে। টলিউডে শোনা যাচ্ছে, সোহিনী সরকার নাকি আপনার নায়কের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন? খোলসা করতেই পৃথা হেসে ফেলে জবাব দিলেন, “একেবারেই তা নয়। আমার ছবির গল্প বাবা-ছেলেকে নিয়ে। আগের প্রজন্ম শিকড়ের টানে মাটির কাছাকাছি থাকতে চায়। পরের প্রজন্ম সাফল্যের পিছনে ছুটতে ছুটতে কখন যে দূরে সরে যায় সব কিছু থেকে! কিন্তু তার পরেও সাফল্য ধরা দেয় কি? এই প্রশ্নই তুলবে ‘ফেরা’।” সেখানে সফল ভবিষ্যৎ গড়ার তাগিদে শহুরে বাসিন্দা ঋত্বিক ফ্ল্যাট খুঁজতে বেরিয়েছেন। সোহিনী তাঁকে ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করে দেবেন। ফ্ল্যাট খোঁজার সময়েই আচমকা দেখা প্রাক্তনের সঙ্গে।
মাত্র এটুকু অভিনয়েই খুশি? প্রিয়াঙ্কার কথায়, “প্রথমত, পৃথা আমায় ওঁর ছবির জন্য বেছেছেন, এটাই আমার কাছে অনেক। তার উপরে ঋত্বিকদা। আমি ওঁর ভক্ত। পাশাপাশি, এমন একটি বাংলা ছবির সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারলাম যেখানে সঞ্জয় মিশ্রের মতো অভিনেতা কাজ করলেন। একসঙ্গে এত কিছু কম পাওয়া যায়।”
একের পর এক শট। মাঝেমধ্যে খুনসুটি, চায়ের ‘ব্রেক’। এ ভাবেই শেষবিকেলে প্রিয়াঙ্কার শুটিং ফুরল।
হাসিমুখে পৃথা জানালেন, একটু বিরতি। রাতে তিনটি শট নিয়ে শুটিং শেষ। পরিচালকের কথায়, “টানা ১৫ দিন ধরে শুট করলাম। ১৩ দিন আমাদের সঙ্গে সঞ্জয়জি কাটিয়ে গেলেন। মনটা ভারী হয়ে গিয়েছে।” পৃথার প্রথম ছবি ‘মুখার্জিদার বৌ’-এ শাশুড়ি-বৌমার গল্প। এ বার স্বাদ বদলে বাবা-ছেলের গল্প। কিন্তু টলিউডে কি ‘বাবা’র অভাব? “একেবারেই না”, জবাব পরিচালকের। বললেন, “অঞ্জন দত্ত-সহ টলিউডের কয়েক জন প্রথম সারির বর্ষীয়ান অভিনেতাকে ভেবেছিলাম। চিত্রনাট্য ঘষামাজা করতে করতে মনে হল, সঞ্জয় মিশ্রকে যদি পেতাম।” পৃথার ইচ্ছাকে উস্কে দিয়েছেন প্রযোজক প্রদীপ নন্দী। মুম্বই গিয়ে গল্প শোনাতেই পৃথাকে সঙ্গে সঙ্গে ‘হ্যাঁ’ বলেন বলিউড অভিনেতা। পরিচালককে অভিনেতা বলেছিলেন, “এই সমস্যা আমাদের দেশের সর্বত্র। এই বিষয়ের উপরে ছবি হওয়া দরকার।”
পৃথা চক্রবর্তীর ‘ফেরা’ ছবির লুকে সোহিনী সরকার। ছবি: সংগৃহীত।
পরিচালকের মতে, স্বপ্নের মতো কেটে গেল দিনগুলো। সঞ্জয় মিশ্রের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা অসাধারণ। দর্শকও যাতে ছবিতে সেই স্বাদ পান তাই চার বছরে একটি ছবি করার ভাবনা তাঁর। আগের বার সকলে ‘মুখার্জিদার বৌ’-এর পরিচালক হিসাবে চিনতেন তাঁকে। আগামী বার যেন ‘ফেরা’ তাঁর পরিচয় হয়ে ওঠে, ইচ্ছা পৃথার।
আর ঋত্বিক, তিনি কী বলছেন? তিনিও কি শিকড়কে অগ্রাহ্য করে সাফল্যের পিছনে ছোটেন? অভিনেতা মেকআপ ভ্যানে বসে গরম চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন। মুঠোফোনের রেকর্ডার চালু করতেই আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে উত্তর দিলেন, “না! আমি কোনও কিছুর পিছনেই ছুটি না। হ্যাঁ, ভাল কাজ, ভাল ছবির প্রতি লোভ অবশ্যই আছে। কিন্তু সব ছেড়ে ছুটতে রাজি নই।” ছবিতে আপনার ‘চরিত্র’ উল্টো বলেই কি রাজি? নাকি সঞ্জয় মিশ্র? “পরিচালক পৃথা”, বলেই জোরে হেসে ফেললেন। জানালেন, পৃথার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। ওঁর ‘প্যাশন’কে সম্মান করেন।
আবার সোহিনীও। ‘রান্নাবাটি’ শেখানোর পর আপনাকে ‘আশ্রয়’ও দিচ্ছেন! আবার হাসতে হাসতে উত্তর, “তাই না? সোহিনী আর আমাকে ইদানীং ঘনঘন দেখা যাচ্ছে! মজা হচ্ছে বলতে পারেন।” আপনার ছিমছাম, রোম্যান্টিক নায়ক হতে ইচ্ছে করে না? এ বার গম্ভীর গলায় বললেন, “সত্যিকারের ‘আমি’ ও রকমই। তাকে দেখতে হলে আমার বাড়িতে আসতে হবে। আর পর্দায় ছিমছাম, রোমান্টিক মানেই তো ‘হ্যাপি এন্ডিং’, গল্প শেষ! তা হলে ছবি হবে কী করে? পর্দায় তাই ঋত্বিক চক্রবর্তী, অসুখী, জটিল, ‘সাইকো’-ই থাক।”