পর্দার কিরীটী: ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।
‘‘কিরীটী রায় রোমাঞ্চ-অন্বেষী কিশোর মনের চিরন্তন নায়ক…’’ কিরীটী অমনিবাসের ভূমিকার প্রথম লাইনে এমনটাই লিখেছিলেন প্রমথনাথ বিশী।
তা এ হেন কিরীটীর চেহারা ঠিক কেমন? নীহাররঞ্জন গুপ্তের বর্ণনায়, ‘‘প্রায় সাড়ে ছ’ ফুট লম্বা। গৌরবর্ণ। মজবুত হাড়ের ফ্রেমে বলিষ্ঠ এক পৌরুষ। মাথা ভর্তি ব্যাক ব্রাশ করা কোঁকড়ানো চুল। চোখে পুরু লেন্সের কালো সেলুলয়েডের চশমা। নিখুঁত ভাবে কামানো দাড়িগোঁফ। ঝকঝকে মুখ। মুখে হাসি যেন লেগেই আছে। আমুদে, সদানন্দ, এবং প্রখর রসবোধ। অসাধারণ বাক্চাতুর্য কিন্তু মিতবাক।’’ কিরীটী মানেই কালো অ্যাম্বাসেডর, হাভানা চুরুট আর কালো পানামা হ্যাট। কিরীটী বলে, ‘‘এই সংসারে পাপ পুণ্য পাশাপাশি আছে। পুণ্যের পুরস্কার ও পাপের তিরস্কার এটাই নিয়ম।’’
কোনও এক অজ্ঞাত কারণে এ রকম এক চিরন্তন নায়ক বরাবরই ব্রাত্য থেকে গিয়েছেন বাংলা সিনেমার পর্দায়।
কিন্তু এ বার ছবিটা বদলে যাচ্ছে। পরের বছর তাকে নিয়েই সরগরম হবে টলিউড।
তিন প্রযোজক সংস্থা এর মধ্যেই কিরীটী রায়কে নিয়ে ছবি করার প্ল্যান করে ফেলেছে।
কিন্তু হঠাৎ কী এমন ঘটল যে, কিরীটী রায়কে নিয়ে এত হইচই?
ইন্ডাস্ট্রি বিশেষজ্ঞদের মতে এর কারণ দু’টি। প্রথম, গোয়েন্দা মানেই বক্স অফিসে একরকম অব্যর্থ জয়। তা সে ফেলুদা হোক কী ব্যোমকেশ কী শবর। আর দ্বিতীয় কারণ, ব্যোমকেশ-ফেলু মিত্তির নিয়ে টানাটানি প্রচুর। সে দিক থেকে দেখতে গেলে, কিরীটী রায় ভিড়ের মধ্যে একা।
কিরীটী নিয়ে এতটাই বিহ্বল টলিউড যে ক্যামেলিয়া প্রোডাকশনস এর মধ্যেই নীহাররঞ্জন গুপ্তের গল্পের প্রায় সব স্বত্ব কিনে নিয়েছে।
অন্য দিকে ম্যাকনিল মিডিয়ার প্রযোজক প্রদীপ চুড়িয়ালও কিনেছেন একটি গল্প। বিখ্যাত গোয়েন্দা কিরীটীকে নিয়ে সমান কৌতূহল মুম্বইয়ের এক প্রযোজক সংস্থারও।
এক কথায়, টলিউড এখন কিরীটীময়।
ক্যামেলিয়া প্রোডাকশনসের তরফে তাদের কর্ণধার রূপা দত্ত জানালেন, ‘‘আমরা ডা. নীহাররঞ্জন গুপ্তের অধিকাংশ গল্পের স্বত্ব কিনেছি তাঁর পরিবারের কাছ থেকে। প্রথম ছবিটা হবে নীহাররঞ্জনের সব চেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস ‘কালো ভ্রমর’ নিয়ে। এর পর হবে আরও চারটে ছবি।’’
একই কথা বলছেন প্রদীপ চুড়িয়াল। বললেন, “হ্যাঁ, আমি কিনেছি একটা বড় গল্পের স্বত্ব। নাম ‘মণিকুণ্ডল’। কিন্তু কে অভিনয় করবে কিরীটীর চরিত্রে সেটা এখনও ঠিক করিনি। যদিও পরের বছর শুরু হবে ছবিটা।’’
অন্য দিকে মুম্বইয়ের এক প্রযোজক সংস্থাও কিরীটী রায়কে নিয়ে খুব উৎসাহী। কিরীটী হিসেবে তাদের পছন্দ আবার চিরঞ্জিত।
‘‘মুম্বইয়ের এক সংস্থা আমাকে কিরীটী রায় করার প্রস্তাব দিয়েছে। সইসাবুদ না হলেও কাজটা করছি, এটা কনফার্মড। কিরীটী করতে পারলে আমার দারুণ ভাল লাগবে,’’ উচ্ছ্বসিত চিরঞ্জিত।
মুম্বইয়ের সেই সংস্থা আদিভ ক্রিয়েশনের কর্ণধার শিবাঙ্গী চৌধুরী জানাচ্ছেন, ‘‘আমি ‘বিষকুম্ভ’ গল্পটা কিনেছি ডা. নীহাররঞ্জনের পরিবারের কাছ থেকে। আমিই কিন্তু প্রথম ওই পরিবারের কাছ থেকে অনেক আইনি ঝামেলা পেরিয়ে ছবির জন্য গল্প কিনি। চিরঞ্জিত খুবই আগ্রহী কিরীটী রায় করতে। তবে উনি পরিচালক হিসেবে চাইছেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়কে। পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়েরও ইচ্ছে আছে কিরীটী করার।’’
কিরীটীর চাহিদা এতটাই যে এর মধ্যে কাস্টিংও ঠিক করে ফেলেছেন ক্যামেলিয়া প্রোডাকশনস।
প্রযোজক সংস্থার তরফ থেকে রূপা বলছিলেন, ‘‘ব্যোমকেশ, ফেলুদাকে নিয়ে অনেক এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে। কিন্তু কিরীটী রায়কে নিয়ে কিছুই হয়নি। তাই আমরা এ বার কিরীটীকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে চাই। অন্য আঙ্গিকে গড়া হবে কিরীটী রায়কে। কিরীটীর ভূমিকায় অভিনয় করবেন ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত। ছবিটি পরিচালনা করছেন অনিন্দ্য বিকাশ দত্ত। ক্রিয়েটিভ হেড হিসেবে যোগ দিতে পারেন কলকাতার কোনও বড় স্টার। বড় পর্দার পর আমরা ছোট পর্দাতেও কিরীটী রায়কে আনব।’’
আজকে যখন কিরীটীকে নিয়ে এত হইচই তখন পুরনো একটা কথা এখানে টানাই যায়। প্রসঙ্গত ডা. নীহাররঞ্জন গুপ্তের কাছে কিরীটী রায় করার প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং উত্তমকুমার। কিন্তু নীহাররঞ্জন তাঁর প্রস্তাবে রাজি হননি। আসল কথা, কিরীটী রায়ের চেহারার সঙ্গে উত্তমকুমারকে মেলাতে পারেননি কিরীটীর জনক। মৃত্যুর আগে তিনি আত্মীয়দের বলেছিলেন, ‘‘যত দিন না ঠিকঠাক কিরীটী রায় পাওয়া যাচ্ছে তত দিন বইয়ের কপিরাইট বিক্রি করবে না।’’
তা হলে কি ধরে নেওয়া যায় কিরীটী রায়ের চেহারার সঙ্গে মিলে গিয়েছে ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তের চেহারা? ইন্দ্রনীলের মধ্যে বাঙালি খুঁজে পাবে নীহাররঞ্জনের কিরীটীকে? রূপা দাবি করছেন, ‘‘অবশ্যই খুঁজে পাবে। কারণ কিরীটী রায়ের মধ্যে একই সঙ্গে তীক্ষ্ণতা আছে আবার সারল্যও আছে। সেটা ইন্দ্রনীলের মধ্যেও আছে।’’
কিন্তু সাড়ে ছ’ফুটের কিরীটী রায়ের সঙ্গে ইন্দ্রনীলের উচ্চতার তো কোনও মিল নেই! উচ্চতার এই তফাত দর্শক কি মেনে নেবেন? রূপা বললেন, ‘‘পুরোপুরি মিল তো সম্ভব নয়। তা ছাড়া ইন্দ্রনীলের হাইটও তো কিছু কম নয়।’’ সঙ্গে এও জানালেন যে, কালো ভ্রমরের চরিত্রে থাকতে পারেন কৌশিক সেন।
কেমন লাগছে কিরীটী রায় করার সুযোগ পেয়ে? কাশ্মীর থেকে ইন্দ্রনীল বলছেন, ‘‘কিরীটী করার সুযোগ পেয়ে আমি খুবই খুশি। আরও একটা ব্যাপার। কিরীটী এর আগে কেউ করেনি। তাই আমার ওপর তুলনার কোনও চাপ নেই।’’
‘কালো ভ্রমর’ গল্প মোট চারটে পর্ব জুড়ে। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের পটভূমি মূলত রেঙ্গুন। ছবি শুরু হবে রেঙ্গুনের কাহিনি বাদ দিয়ে তৃতীয় পর্ব থেকে। সুতরাং রেঙ্গুনের শ্যুটিং বাদ দিয়েই শুরু হবে ‘কালো ভ্রমর’। এই গল্পের চিত্রনাট্য লিখেছেন ‘বদলাপুর’, ‘এজেন্ট বিনোদ’য়ের চিত্রনাট্যকার অরিজিৎ বিশ্বাস। তিনি বললেন, ‘‘কালো ভ্রমর’য়ের কাহিনির পটভূমি ছিল ১৯২২ সাল থেকে ১৯৭০ সাল। আমরা সেটাকে শুরু করছি ১৯৭৫ সাল থেকে। গল্প শেষ হচ্ছে ২০১৬য় এসে।’’
কেন বদলাচ্ছে সময়সীমা? উত্তরে রূপা বললেন, ‘‘এই সময়ে দাঁড়িয়ে ১৯২২য়ের পটভূমি তৈরি করাটা সহজ নয়। আমরা সেটা করতেও চাইনি। সেই কারণে সময়সীমাটাকে বর্তমানের কাছাকাছি নিয়ে এসেছি।’’
সময়সীমা বদলালেও গল্পের মূল নির্যাস একই থাকছে বলে দাবি করলেন চিত্রনাট্যকার।
অন্য বাঙালি গোয়েন্দাদের সঙ্গে কিরীটীর একেবারেই কোনও মিল নেই। হেমেন্দ্র কুমার রায়ের জয়ন্ত- মানিক, বা ফেলুদা-তোপসে, বা ব্যোমকেশ-অজিতের চেয়ে একেবারেই আলাদা কিরীটী ও তার বন্ধু সুব্রতর জীবন। সে দিক থেকে দেখতে গেলে বাংলার তামাম গোয়েন্দার মধ্যে প্রথম পরিণতমনস্ক গোয়েন্দা কিরীটী রায়। ব্যোমকেশের দাম্পত্য জীবন থাকলেও প্রেমপর্ব ছিল সংক্ষিপ্ত। সে ক্ষেত্রে কিরীটীর জীবনে কৃষ্ণাকে নিয়ে দীর্ঘ প্রেম পর্ব আছে। তার পর আছে বিবাহিত জীবন। কৃষ্ণার চরিত্রে অভিনয় করছেন অরুণিমা ঘোষ। শ্যুটিং শুরু হবে আগামী বছরের জানুয়ারির শেষে অথবা ফেব্রুয়ারির গোড়ায়।
আর তিন প্রযোজক সংস্থার উদ্যম দেখে স্পষ্ট, আজকের টলিউডে কিরীটীই সম্ভাব্য নতুন তারকা।