তাঁর চলে যাওয়া মেনে নিতে পারেননি অনেকেই। শ্রাবণের বৃষ্টি মাথায় নিয়ে গোটা কলকাতা শহর ভেঙে পড়েছিল শেষ বারের মতো দেখে নিতে, সেই রাজপুত্রকে। ৪৫ বছর হয়ে গেল, তিনি নেই। তবু তিনি রয়ে গিয়েছেন। তিনি উত্তম। আজও জনপ্রিয়তায় তাঁর ধারেকাছে ঘেঁষতে পারেননি কোনও নায়ক। শক্ত আগল দিয়ে তাঁকে বন্দি করে করে রেখেছে বাঙালি।
এমন একজন মানুষের ‘যাওয়া তো নয় যাওয়া’। তাই মৃত্যুদিনে শোক ছাপিয়ে উঠে আসে যাপন। সেই উত্তমযাপনেই আনন্দবাজার ডট কমের সঙ্গী হলেন টালিগঞ্জের গৌরবেরা। কড়িবরগার ছাদ। খড়খড়ি দেওয়া জানালায় যেন এক নিমেষে বয়ে গেল নস্টালজিয়ার হাওয়া। দুপুরের রোদ মেখে দক্ষিণ কলকাতা যেন হঠাৎই উত্তমকুমারের রাজত্বে হাজির।
চলতি বছর সেপ্টেম্বর মাস থেকে শুরু হবে মহানায়কের জন্মশতবার্ষিকী। ২০২৬-এ উদ্যাপন। তার ঠিক আগেই তাঁর হঠাৎ চলে যাওয়ার দিনটি। এ দিনে যেন বড় বেশি করে মনে পড়ে তাঁর সরল দু’টি চোখ, আর অনাবিল হাসিটি। প্রেম আর বাঙালিয়ানাকে অমর করে রেখেছেন উত্তম।
ধাক্কাপাড়ের ধুতি আর পাঞ্জাবি পরতে খুব ভালবাসতেন মহানায়ক। সে কথা মাথায় রেখে উত্তমের মতো করেই বর্তমান প্রজন্মের তিন অভিনেতা— গৌরব চট্টোপাধ্যায়, গৌরব চক্রবর্তী এবং গৌরব রায়চৌধুরীকে সাজিয়েছিলেন শিল্পী অভিষেক রায়।
ধুতির পাড়ে সুতোর কাজ। সঙ্গে মানানসই পাঞ্জাবি। নায়ক উত্তমের আদলে সাজিয়েছিলেন অভিনেতাদের। কেউ ‘সন্ন্যাসী রাজা’ ছবির ‘সূর্যকিশোর’, কেউ আবার ‘দেয়া নেয়া’-র ‘প্রশান্ত রায়’, আবার কেউ ‘দুই ভাই’ ছবির ‘উৎপল চ্যাটার্জি’।
তবলা, পিয়ানো, হারমোনিয়ামের সুরে তৈরি হয়েছিল এক অন্য আবহ। ২০২৫–এ দাঁড়িয়ে সত্তরের দশকে ফিরে যাওয়া বেশ কঠিনই। বর্তমানে প্রায় সব পুরনো বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট হয়ে যাচ্ছে। এ দিকে সে যুগের ছবি লক্ষ করলে দেখা যাবে পুরনো আমলের বাড়ি। কাঠের তক্তোপোশ কিংবা পালঙ্ক। দক্ষিণ কলকাতার কালীঘাটের কাছে খুঁজলে এখনও সেই ছবি দেখা যাবে। যেখানে এখনও রয়েছে ঝাড়লন্ঠন।
উত্তমকুমারের সময়, তাঁর আভিজাত্যকে তুলে ধরতে গেলে গৌরব চট্টোপাধ্যায় থাকবেন না, তা কি কখনও হয়! যদিও ঠাকুরদাকে কখনও পাননি গৌরব। তাঁর জন্মের বছর চারেক আগেই চলে গিয়েছেন মহানায়ক। সেই আক্ষেপ এখনও অভিনেতার গলায়। গৌরব বললেন, “আমি নিজেই প্রবীণ অভিনেতাদের কাছে জানতে চাই, দাদু কেমন ছিলেন। কী করতেন!” গৌরবকে দেখা গেল ‘সন্ন্যাসী রাজা’ ছবির সাজে। বিলাসী রাজার নাচমহলে জ্বলে ওঠে ঝাড়বাতি, তালবাদ্যের সামান্য ত্রুটি রাজা সইতে পারেন না। গেয়ে ওঠেন— ‘কাহারবা নয় দাদরা বাজাও...’
গৌরব রায়চৌধুরীর কাছে আবার এই উত্তম-আদলে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর অভিজ্ঞতাটি একেবারে অন্য রকম। উত্তমকুমার তাঁর স্বপ্নের নায়ক। তাঁর আবহে নিজেকে মিশিয়ে ফেলা— সেটাই সব থেকে বড় রোমাঞ্চের বিষয়। তাঁর চেহারায় ফুটে ওঠে উত্তমের এক মোহন রূপ। বেজে ওঠে গান— ‘দোলে দোদুল দোলে ঝুলনা...’ ছবির নাম ‘দেয়া নেয়া’।
অভিনেতা গৌরব চক্রবর্তী জানালেন, অনেক ছোট থেকেই বাড়িতে উত্তমচর্চা। ছোটবেলা থেকেই তাঁর মতো করে হাসার বা দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেন গৌরব। বলতে দ্বিধা করেননি সব্যসাচী-পুত্র। জানিয়েছেন, অভিনয় শিক্ষার হাতেখড়ি বুঝি উত্তমকুমারই দিয়েছেন, পরোক্ষে। গৌরবের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে ‘দুই ভাই’ ছবির উত্তমকুমারকে। আবহে বেজেছে গান— ‘তারে বলে দিয়ো...’
উত্তম-স্মরণে নতুন নায়কদের ছবি তুলে ধরতে সচেতন ভাবেই ঐতিহ্যের আবহে নতুনত্বকে ভরসা করেছেন পোশাক পরিকল্পক অভিষেক রায়।
ধুতির কোঁচা থেকে চুলের কায়দা— সবেতেই উত্তম-স্পর্শ রাখার চেষ্টা করেছেন তিনি। শুধু উত্তমকুমার নয়, মানানসই ভাবে তরুণকুমারকেও ফ্রেমবন্দি করার চেষ্টা করা হয়েছে।
পোশাকশিল্পী অভিষেক রায় বললেন, “এই তিনটি গানই আমার খুব প্রিয়। যদিও উত্তমকুমার অভিনীত প্রতিটি ছবির গানই আমার প্রিয়। রথীজিৎ ভট্টাচার্য আমায় সাহায্য করেছেন এ ক্ষেত্রে। হুবহু তখনকার দৃশ্যায়ন করতে পারব না। বাংলা শার্টের ডিজ়াইন হোক বা আদ্যির পাঞ্জাবিতে নক্শা হোক— উত্তমের সময়ের আদলে একটু অন্য কিছু করার চেষ্টা করেছি। ২৪ জুলাই মহানায়কের প্রতি এটাই আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য।”