‘গ্রাম চিকিৎসালয়’ ওয়েব সিরিজ়ের পোস্টার। —ছবি: সংগৃহীত।
ইঁদুরদৌড়ের জগতে মানুষ একটু শান্তি চায়, দিনের শেষে সহজ, সরল জীবনই তাঁদের মন ছুঁয়ে যায়। হুড়োহুড়ির জীবনে অঙ্কের এই হিসাবটি হেসেখেলে কষে ফেলেছিলেন ‘টিভিএফ’ স্রষ্টারা। ওটিটির পর্দায় যখন ‘পঞ্চায়েত’ হিট হয়েছে, তখন সেই একই মোড়কে আরও একটি গল্প ফেঁদে ফেললেন তাঁরা। কিন্তু সেখানেই যেন মস্ত বড় ভুল হয়ে গেল। গ্রামের সেই সারল্য মনে তো দাগ কাটলই না, বরং পাঁচ পর্বের সিরিজ়টি দেখতে দেখতে আফসোসই হল। সিরিজ় নির্মাতারা একই উপকরণ নিয়ে কাহিনি গাঁথতে বসলেও ‘পঞ্চায়েত’-এর ধারেকাছে ঘেঁষতে পারল না ‘গ্রাম চিকিৎসালয়’।
‘গ্রাম চিকিৎসালয়’ ওয়েব সিরিজ়ের একটি দৃশ্যে অমল পরাশর। ছবি: সংগৃহীত।
সিরিজ় মুক্তির আগেই ঘটা করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল ‘ফ্রম দ্য মেকার্স অফ পঞ্চায়েত’। মুক্তির আগে থেকেই ‘গ্রাম চিকিৎসালয়’ সিরিজ়ের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল ‘পঞ্চায়েত’-এর নাম। গল্পও তো সেই একই ছন্দে বাঁধা! সেই শহরের চাকচিক্য থেকে যেন ‘সাত সমুদ্দুর তেরো নদী’ পার করে এক গ্রাম। সেখানে কর্মসূত্রে গিয়েছে এক তরুণ। তার পর তার দৈনন্দিন বহমান জীবনে নানা ভাবে উঠে এসেছে গ্রামবাসীদের কথা। তবে শুধুমাত্র সাদাসিধে এই চিত্রনাট্য দিয়ে যে সিরিজ়ের জয়জয়কার হয় না, তার জন্য প্রয়োজন হয় দুর্দান্ত অভিনয় এবং গল্পের বাঁধন। ‘গ্রাম চিকিৎসালয়’-এ যেন সেগুলির বড় অভাব বোধ হয়। বিনয় পাঠক এবং অমল পরাশরের মতো চেনা অভিনেতারা রয়েছেন এই সিরিজ়ে। বাকি অধিকাংশই অচেনা। অভিনেতা হিসাবে বিনয় যে ধরনের চরিত্রে কাজ করতে পছন্দ করেন, এই সিরিজ়েও তার অন্যথা হয়নি। তাই তাঁর অভিনয়েও বিশেষ চমক ছিল না।
‘গ্রাম চিকিৎসালয়’ ওয়েব সিরিজ়ের একটি দৃশ্যে বিনয় পাঠক। ছবি: সংগৃহীত।
ওটিটির পাশাপাশি বড় পর্দায় বেশ পরিচিত মুখ অমল। ১৬ বছর ধরে অভিনয় করলেও অমলকে ‘ট্রিপলিং’ সিরিজ়ের কারণে আরও বেশি করে মনে রেখেছেন দর্শক। ‘গ্রাম চিকিৎসালয়’ সিরিজ়ে এমবিবিএস ডিগ্রিধারী চিকিৎসকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন অমল। অন্য দিকে বিনয়কে দেখা গিয়েছে হাতুড়ে ডাক্তার চেতকের ভূমিকায়। কোনও ডিগ্রি ছাড়াই বছরের পর বছর গ্রামবাসীর ভালবাসা এবং বিশ্বাস অর্জন করে চিকিৎসা করে চলেছে সে। রোগ নির্ধারণ করে ‘গুগ্ল’-এর সাহায্যে। ওষুধপত্রের ব্যবস্থা হয়ে যায় গ্রামের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে চোরাই পথে। সেই ভটকন্ডী গ্রামেই দিল্লি থেকে এক শহুরে বড়সড় চিকিৎসক এল। ‘গোল্ড মেডেলিস্ট’ সেই চিকিৎসক বাবার বিশাল নার্সিংহোমে কাজ করতে পারত অথবা বিদেশে উড়ে যেতে পারত অনায়াসেই। কিন্তু দেশের প্রত্যন্ত গ্রামে চিকিৎসার অভাবে মানুষেরা ভোগান্তির শিকার হয়— সেই ভাবনাই তাকে মেডিক্যাল অফিসার হিসাবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে আসে। তার পর থেকেই ‘পঞ্চায়েত’-এর চেনা ছন্দে বয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয় ‘গ্রাম চিকিৎসালয়’কে। যে চেষ্টা পাঁচ পাঁচটি পর্ব শেষ হওয়ার পরেও সফল হয় না। কখনও তা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দুরবস্থা ফুটিয়ে তুলতে চায়, কখনও আবার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বার্তা ছড়িয়ে দিতেও উঠেপড়ে লাগে। তাই সব শেষে সিরিজ়টি কৌতুকের ছন্দেও বাঁধা গেল না। বরং অতিরঞ্জিত মেলোড্রামায় ভরপুর ‘কিছু একটা’য় পরিণত হল।
সিরিজ় নির্মাতা দীপক কুমার মিশ্র গ্রামের সারল্য পর্দায় তুলে ধরতে সিদ্ধহস্ত। সে কারণেই হয়তো কিছু সংলাপ, কিছু দৃশ্য মোটামুটি ভাল লাগে। তবে সেই ভাল লাগার রেশ ক্ষণিকের। ‘পঞ্চায়েত’-এ ফুলেরা গ্রামবাসীদের সঙ্গে দর্শক এতটাই মিশে গিয়েছেন যে এখনও পরবর্তী সিজ়ন মুক্তির জন্য তাঁরা মুখিয়ে। সেখানে ভটকন্ডীর বাসিন্দারা যে শুধু অভিনয়ই করে গেল। আকাঙ্ক্ষারঞ্জন কপূর একটি ছোট চরিত্রে অভিনয় করেছেন এই সিরিজ়ে। চিত্রনাট্য থেকে তাঁর চরিত্রে কাঁচি চালালে খুব একটা অসুবিধা হত না। কিন্তু ‘পঞ্চায়েত’-এর রিঙ্কির মতো হয়তো এখানেও এক নারী চরিত্রের প্রয়োজন ছিল। সেই প্রয়োজন মেটাতেই ‘পঞ্চায়েত’-এর স্বাদ ‘গ্রাম চিকিৎসালয়’-এর কাহিনির ভিতর সতর্ক ভাবে ঢেলে দিয়েছেন নির্মাতারা। পরবর্তী দৃশ্যে কী হতে পারে তা দর্শক আগে থেকেই আন্দাজ করে নিতে পারেন। ফলে দর্শকমনে কোনও ভাবেই সাসপেন্স তৈরি করতে পারে না ‘গ্রাম চিকিৎসালয়’। হাতেগোনা কয়েকটি দৃশ্যে চোখের কোনায় জল আসতে পারে বইকি। তবে ঘোর কাটতেই তা প্রয়োজনের অতিরিক্ত মেলোড্রামা বলে মনে হতে বাধ্য। সিরিজ়ে দু’টি গান রয়েছে যা দু’টি পর্বকে দীর্ঘায়িত করতে সাহায্য করেছে মাত্র। সব শেষে ‘গ্রাম চিকিৎসালয়’ হাজারো চেষ্টা করেও ‘পঞ্চায়েত’-এর মতো হতে পারে না। ওটিটির পর্দায় থেকে যায় হিট হওয়া ওয়েব সিরিজ়ের দুর্বল, অগোছালো অনুকরণ হয়ে।