মীর-রাজ-শুভঙ্কর-রুদ্রনীল। ছবি: অর্পিতা প্রামাণিক।
কথায় বলে, ‘লাফটার ইজ দ্য বেস্ট মেডিসিন’। আর আট থেকে আশি সব দর্শকের মুখে হাসি ফোটাতে টেলিভিশনে কমেডি শোয়ের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলে কমেডি শো দূরবিন দিয়ে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। জনপ্রিয় চ্যানেলগুলোয় ‘মীরাক্কেল’, ‘আই লাফ ইউ’, ‘চকাচক কমেডি চক’-এর মতো হাতে গোনা কয়েকটি শো হয়ে থাকলেও বেশির ভাগের জনপ্রিয়তা ছিল তলানিতে। আর এখন তো তাদের অস্তিত্বই নেই। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, কমেডি কি কম পড়িয়াছে? না কি বাঙালি হাসতে ভুলে গিয়ে ‘হুঁকোমুখো হ্যাংলা’র দলেই নাম লিখিয়েছে?
গ্রাসরুট লেভেল থেকে ফিডব্যাক আসছে না:
এখনকার সময় বাংলায় স্ট্যান্ড আপ কমেডি শোয়ের সব থেকে বড় অ্যাম্বাসাডর নিঃসন্দেহে মীর। তাঁর নামে আস্ত একটি শো-ও রয়েছে। তিনি কমেডি শোয়ের দুর্বল চিত্র প্রসঙ্গে জানালেন, ‘‘বাঙালির রসবোধ বরাবরই তীক্ষ্ণ। কিন্তু আমাদের সমস্যা হল পরিবেশনে। আসলে এখন মানুষের কাছে এত রকম অনুষ্ঠানের বিকল্প রয়েছে যে, গুণমানে কোনও রকম আপস মেনে নিতে রাজি নন দর্শক। আরও একটা বিষয় হল, আমরা দর্শকের থেকে ঠিকমতো ফিডব্যাক নিতে পারছি না। হাস্যরস তো উঠে আসে গ্রাসরুট লেভেল থেকেই। কিন্তু সেখানে পৌঁছতে না পারলে কমেডি তৈরি হবে কী করে? সে জন্য আমাদের কমেডিও ব্যাহত হচ্ছে। বাঙালিয়ানাতেও খাদ থেকে যাচ্ছে। ‘মীরাক্কেল’-এর গত কয়েকটি সিজনে সেটা আমরা উপলব্ধি করেছি। অনেকে তো এটাও বলেছেন, আগে এটা পারিবারিক শো ছিল। সেই কারণে কনটেন্ট প্রস্তুত করার জন্য এখন বিরাট দল তৈরি করা হচ্ছে। সেই টিমের সদস্যের সংখ্যা হবে প্রতিযোগীদের সমান। কনটেন্ট ভাল না হলে শুধু মাত্র দক্ষ প্রতিযোগী দিয়ে তো জনপ্রিয়তা পাওয়া সম্ভব নয়।’’
তা হলে উপায়? পথ একটাই, কনটেন্ট শক্তিশালী করা। আজকের যুবসমাজ কী ভাবছে সেই বিষয়ে খেয়াল রাখাটাও জরুরি। কোনটা ট্রেন্ডিং, সেখানেও নজর রাখতে হবে। গতে বাঁধা জিনিস, এখন যে চলবে না, সে বিষয়ে এক মত মীরও। মেনে নিলেন কমেডি শোয়ের ঘাটতির বিষয়টাও। তাঁর মতে, ‘‘মানুষ হয়তো ক্লোনিংটা নিতে পারেনি!’’ আর কনটেন্ট প্রসঙ্গে মীরের টিপ্পনী, ‘‘ সেক্স, পলিটিক্স কোনও কিছু নিয়েই কাজ করা যাবে না। যাঁরা গেল গেল রব তুলছেন, তাঁরাই হোয়াটসঅ্যাপে মেতে থাকেন স্থূল বিনোদন নিয়ে! স্যাটায়ার, হিউমরকে জুড়তে না পারলে ভাল কমেডি তৈরি হবে কী ভাবে? বাক্স্বাধীনতার অস্তিত্ব যেন শুধু খাতায়-কলমেই।’’
টিআরপি-ই যত নষ্টের মূল
ছবি পরিচালনারও আগে রিয়্যালিটি শো ডিরেক্ট করেছেন রাজ চক্রবর্তী। সেই সুবাদেই কমেডি শোয়ের সঙ্গে তাঁর গাঁটছড়া। নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে রাজ জানালেন, ‘‘কমেডির গ্রাফ কখনও পড়ে না। বাঙালি দর্শক কমেডি, ইমোশন সব সময় পছন্দ করেন। মূল বিষয় হল, দশ বছর আগে দর্শক যা দেখে এসেছেন, এখনও কেন তা দেখবেন? সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কনটেন্টও উন্নত করতে হবে। একেই তো টেলিভিশনে কমেডির গুটিকয়েক শো। সেগুলোও ক্রমশ একঘেয়ে হয়ে পড়ছে। পুরনো জোকসের প্রাসঙ্গিকতা কি সারা জীবন থাকে? ন্যাশনাল টেলিভিশনে নানা ধরনের কাজ হচ্ছে। কিন্তু এখানকার অনুষ্ঠানগুলো সেই তিমিরেই পড়ে রয়েছে। আরও একটা বিষয় হল, টিভির ক্ষেত্রে টিআরপি একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে। সেই গ্রাফের উত্থান-পতন স্বতঃস্ফূর্ত কাজে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। দর্শকের মানোন্নয়ন হয়েছে কি না, সেই নিয়েও দ্বিধাগ্রস্ত চ্যানেলগুলো।’’
আরও পড়ুন: হেনস্থার শিকার নায়িকা
জোকস তৈরি হলেই হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়ে পড়ছে
‘মীরাক্কেল’-এর চালিকাশক্তি এখন তাঁর হাতেই। পরিচালক শুভঙ্কর চট্টোপাধ্যায় জানালেন, ‘‘যে কোনও ফরম্যাটেই একঘেয়েমি রয়েছে। সেখানে পরিবর্তন আনতে কিছুটা সময় লাগে। আমার শোয়েও বদল আনার চেষ্টা করছি। এ বছর নিছক স্ট্যান্ড আপ কমেডি না করে ইন্টার্যাকটিভ কমেডি করার কথা ভাবছি। আমাদের শোয়ের শুরুর সময় মানুষ বই থেকে জোকস পড়ত। কিন্তু এখন জোকস তৈরি হওয়া মাত্র হোয়াটসঅ্যাপে তা ছড়িয়ে পড়ছে।’’ আর কমেডি শোয়ের অভাবের জন্য নতুন চিন্তাভাবনাকেই দায়ী করেছেন শুভঙ্কর। ‘‘‘মীরাক্কেল’-কে কপি না করে নতুন ফরম্যাটের উদ্ভাবন কী ভাবে করা যায়, সেই নিয়ে ভাবতে হবে। মৌলিক চিন্তার অভাবটাই এ ক্ষেত্রে বড় বাধা।’’
নতুন লেখক কোথায়?
কিছু দিন আগেই একটি বেসরকারি চ্যানেলে নিজের শো ‘চকাচক কমেডি চক’ অনুষ্ঠানটি নিয়ে এসেছিলেন রুদ্রনীল। যদিও তা আশাপ্রদ সাফল্য পায়নি। কিন্তু তাঁর পারফরম্যান্স নজর কেড়েছিল। ব্যক্তিগত জীবনেও বেশ সরস রুদ্রনীল। কিন্তু দর্শকের মুখ ব্যাজারের প্রশ্ন উঠতেই জানালেন, ‘‘পারফরম্যান্সের কঠিনতম অংশ কমেডি। চূড়ান্ত পারদর্শী অভিনেতারাই কমেডি করতে পারেন। সিরিয়াস অভিনয় তুলনামূলক সহজ। শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, যিশু সেনগুপ্ত, রজতাভ দত্তরা ব্রিলিয়ান্ট কমেডি করতে পারেন। কিন্তু শুধু অভিনয় দিয়ে তো চলবে না। কনটেন্টও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে শিবরাত্রির সলতে পদ্মনাভ (দাশগুপ্ত)। ও কমেডি রচনায় বেশ দক্ষ। কিন্তু পদ্মনাভর পক্ষে টেলিভিশনে সময় দেওয়া সম্ভব নয়। নতুন লেখক তুলে আনতে হবে। নতুন প্রতিভা খুঁজে েবর করার ক্ষেত্রে পরিচালক বা প্রযোজকদের সেই তাগিদ কোথায়? শুধু কমেডি শো কেন, হাসির ধারাবাহিকও দেখি না। অথচ এটা এমন একটা বিষয়, যাতে মজে থাকে আট থেকে আশি সকলেই। এ বার পারফরম্যান্সের প্রসঙ্গে আসি। কমেডি করতে গেলে যে শিক্ষার প্রয়োজন, সেটাও নতুন প্রজন্মের অনেকেরই নেই। জাতীয় পর্যায়ে তো নানা ধরনের বিকল্প রয়েছে। বাংলার পাশাপাশি হিন্দি ভাষাতেও দর্শক স্বচ্ছন্দ। সে ক্ষেত্রে বাংলায় ভাল কমেডি শো না থাকলে, দর্শক হিন্দিকেই বেছে নেবেন।’’
আগামী দিনে চিত্রটা কি একই থাকবে, না কি শক্তিশালী কনটেন্ট ও নতুন উপস্থাপনায় হাসি ফুটবে শিবরাম চক্রবর্তী, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের এই বাংলায়?